এস কে সাত্তার, ঝিনাইগাতী (শেরপুর) থেকে : ঝিনাইগাতীর কৃষকের স্বপ্ন এখন বোরোয়। ঘরের খোরাকির আমন ধান প্রায় শেষ পর্যায়ে। শীতকালীন সবজির আবাদও প্রায় শেষ, এখন ইরি-বোরোর স্বপ্নেই বিভোর ঝিনাইগাতীর কৃষক। তবে তারা দুশ্চিতায় রয়েছে সেচ সংকটের আশংকায়। বোরো আবাদমুখী বড় গৃহস্থ সরোয়ারদী দুদু ম-ল, আলী হোসেনসহ ক’জন বোরো চাষি জানান, প্রচ- শীত উপেক্ষা করে তারা জমিতে ইরি বোরো বীজতলা রোপণ করেছেন। তারপর থেকেই পড়েছেন তীব্র সেচ সংকটে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কোরবান আলী জানান, উপজেলায় এবার ইরি-বোরো চাষাবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১২ হাজার ৫শ’ হেক্টর জমিতে। তিনি অবশ্য আশা প্রকাশ করেন, গতবারের চেয়ে এবার বোরোর আবাদ এবং ফলন গত বছরের চেয়ে ভালো হবে। কারণ হিসেবে তিনি অনেক সাবমাস পাম্প বসানো এবং বিপুল এলাকা বিদ্যুতায়নের কথা উল্লেখ করেন। এদিকে প্রথম দিকে শীতের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বীজতলা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছিল কৃষক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শীতে বীজতলার খুব একটা ক্ষতি হয়নি। তাই আবাদের প্রথম ধকল কাটিয়ে উঠলেও কৃষক পড়বে সেচ সংকটে এমন আশংকা অভিজ্ঞ কৃষকদের। বিশেষ করে নদী এলাকায় জমিতে নদীর পানিতে এবং উঁচু জমিতে সেচ দিয়ে এই এলাকায় ইরি-বোরো চাষাবাদ করা হয়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে চাষাবাদ করতে ভাটি এলাকায় পানির জন্য হাহাকার অবস্থার সৃষ্টি হয়। এবারও অনুরূপ অবস্থার সৃষ্টি হবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। মহারশী নদীর উজানে নির্মাণাধীন রাবার ড্যামের জন্য বাঁধ দিয়ে পানি আটকানো এবং ফি-বছর সোমেস্বরী নদীর উজানে ৫-৬টি বেআইনি বাঁধ নির্মাণ করে ভাটি এলাকায় পানি সংকট সৃষ্টি করে চুটিয়ে পানি বিক্রি করায় মহাসংকটে পড়ে ভাটি এলাকার বোরো চাষিরা। অপরদিকে চলতি ইরি-বোরো মৌসুমে সেচ পাম্পের ম্যানেজার এবং মালিকরা সেচের জন্য অতিরিক্ত মূল্য নেয়ায় দিশাহারা হয়ে পড়েছেন চাষিরা। উপজেলায় সেচ কমিটি থাকলেও তা নামকাওয়াস্তে হওয়ায় এবং সেচ খরচ নির্ধারণ করে না দেয়ায় পাম্প মালিক ও ম্যানেজাররা ইচ্ছামতো অতিরিক্ত সেচ মূল্য আদায় করছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। উপায়হীন কৃষকরা জানান, তারা অতিরিক্ত সেচ মূল্য দিয়ে বাধ্য হয়েই সেচ কাজ করছেন। তাদের মতে, সরকার বা উপজেলা সেচ কমিটি সেচ মূল্য নির্ধারণ করে না দেওয়ায় সেচ পাম্পের মালিক অথবা ম্যানেজাররা চাষিদের কাছ থেকে ইচ্ছামতো অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। ফলে লোকসানের ভয়ে অনেকেই নিজের ফসলি জমি অনাবাদি রেখে দিতেও বাধ্য হচ্ছেন বলে জানা যায়। উল্লেখ্য, ঝিনাইগাতীর নদী-নালা, খাল-বিলগুলো বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই শুকিয়ে গেছে। ফলে মৎস্যজীবীরাও যেমন হয়ে পড়েছে বেকার, তেমনি কৃষকও পানির অভাবে ইরি-বোরো আবাদ নিয়ে রয়েছে অজানা শঙ্কায়! এখন অনেক কৃষক নদীতে যে সামান্য পানি রয়েছে তাতেই সেচ দিয়ে চাষাবাদ করছে। কিন্তু এই সামান্য পানিও শুকিয়ে যাবে যে কোনো মুহূর্তে। আর এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের কারণেই। যদি এ অবস্থাই চলতে থাকে তবে এখানকার কৃষকরা মাঠে মারা যাবে বলে আশংকা করেছেন অভিজ্ঞমহল। প্রসঙ্গত, এককালের খর¯্রােতা মহারশী-মালিঝি-সোমেশ্বরী ইত্যাদি নদী আজ যেন স্মৃতির অতলেই হারিয়ে যাচ্ছে। শুষ্ক মৌসুম শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই নদী-নালা, খাল-বিলগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ায় সেচনির্ভর কৃষকরা যেমন পড়েছে মহাসংকটে, তেমনি মৎস্যজীবীরাও এখন বলতে গেলে বেকার হয়ে পড়েছে। ফলে পরিবেশ বিপর্যয়সহ কৃষি আবাদে নেমে এসেছে ভয়াবহ স্থবিরতা। নদীসমূহের দুই পাশের মানুষ দাবি করেছেন যে, অতি দ্রুত নদীগুলো ড্রেজিং করে পানির প্রবাহ আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা জরুরি হয়ে পড়েছে। কৃষকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়. নদীগুলোর তলদেশে পলি জমে আস্তে আস্তে ভরাট হয়ে গেছে। এতে দুই পাড়ের জেগে ওঠা চরগুলো এবং নদীসমূহের তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়া নদীর পাড় দখল করে নিয়েছে এক শ্রেণীর ভূমিখেকো। তাছাড়া উপজেলা জুড়ে যেসব বিল রয়েছে তাও পর্যায়ক্রমে ভরাট হওয়ায় ভূমিখেকোরা দখলে নিয়ে চাষাবাদ করছে। ফলে ক্রমেই ঝিনাইগাতী উপজেলা হয়ে পড়ছে নদী-নালা, খাল-বিলশূন্য। এতে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে মারাত্মকভাবে। এমতাবস্থায় নদীসমূহ যেমন এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে তেমনি বিলগুলোও হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে এসব নদী-নালা, খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়ায় সেচ ব্যবস্থাও গভীর সংকটে পড়েছে। নদী ও বিলের পানিতে যেসব দরিদ্র কৃষক সেচ ব্যবস্থার আওতায় ইরি-বোরো চাষ করে থাকে, তাদেরও গত ক’বছর ধরে মাথায় হাত পড়েছে। অবশ্য বিত্তবান কৃষকরা গভীর নলকূপ বসিয়ে জমিতে সেচ দিতে পারে। কিন্তু দরিদ্র কৃষকরা টাকার অভাবে পানি কিনে সেচ দিতে বরাবরই হিমশিম খাচ্ছে। যারা টাকা দিতে পারে তারাই পানি পায়। আর এই সুযোগে সুদখোর মহাজনরা চড়া সুদে হাতিয়ে নেয় দরিদ্র কৃষকদের কষ্টার্জিত ফসলের টাকা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এ বছর ভরা বর্ষায়ও কাক্সিক্ষত বৃষ্টি না থাকায় এবং বর্তমানে এই শুকনো মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিকভাবে নিচে নেমে যাওয়ায় হস্তচালিত নলকূপে পানি না ওঠায় উপজেলাজুড়ে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকটও চরম আকার ধারণ করেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন