দেশের বীমা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত নানা অভিযোগ শোনা যায়। অনেক নামি-দামি কোম্পানীর বিরুদ্ধেও মেয়াদ শেষ হওয়ার পর গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধে হয়রানি, টালবাহানা ও বঞ্চনার শত শত অভিযোগ রয়েছে। মূলত আইনগত অস্বচ্ছতা ও ফাঁক-ফোঁকড় বের করে তারা গ্রাহকদের অভিযোগের কোনো তোয়াক্কা করছে না। আইনগত সীমাবদ্ধতার দোহাই দিয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে গঠিত সংস্থা আইডিআরএ(ইড্রা) অদ্যাবধি গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষায় তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে দেশের ১৭টি বীমা কোম্পানির বিরুদ্ধে গ্রাহকদের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ৬ বছরের বেশি সময় ধরে দুর্নীতি দমন কমিশনে(দুদক) ধামাচাপা থাকার তথ্য বেরিয়ে আসে। বীমা কোম্পানিগুলোর মালিক-পরিচালকরা অতিরিক্ত ‘ব্যবস্থাপনা ব্যয়’ দেখিয়ে গ্রাহকদের প্রাপ্য প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করে, এমন অভিযোগের তদন্ত শুরু করেও আইনগত অস্বচ্ছতার অজুহাত তুলে রহস্যজনকভাবে শেষ পর্যন্ত তদন্ত থেকে সরে দাঁড়ায় দুদকের সংশ্লিষ্ট তদন্তকারীরা। সাধারণ গ্রাহকদের হাজার হাজার কোটি টাকা বীমা কোম্পানির কতিপয় চেয়ারম্যান-পরিচালক দেশে-বিদেশে ব্যক্তিগত সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার অভিযোগও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জানা যায়, ‘ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের নামে গ্রাহকদের ১ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার সুনির্দিষ্ট অভিযোগে ১৭টি বীমা কোম্পানির বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের জুনমাসে দুদকের তদন্ত শুরু হওয়ার পর কতিপয় বীমা কোম্পানির প্রভাবশালী মালিক-পরিচালকরা দুদকের তৎকালীন কর্মকর্তা, মন্ত্রনালয় ও বীমা নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করে বিষয়টি ধামাচাপা দিতে সক্ষম হয়। এরপর গত ৬ বছরেও এ বিষয়ে অভিযোগের কোনো তদন্ত হয়নি। গ্রাহকরাও তাদের অর্থ ফেরত পায়নি। এই অভিযোগের বাইরে এর আগে এবং পরে বীমা কোম্পানিগুলোর যথেচ্ছ অর্থ আত্মসাৎ কখনো বন্ধ হয়নি। কতিপয় বীমা কোম্পানির গ্রাহক হয়রানি ও ঠিকমত পাওনা পরিশোধ না করার অভিযোগ আমলে নিয়ে ২০১৮ সালে অর্থমন্ত্রনালয় সম্পর্কীত সংসদীয় কমিটি তদন্ত ও গণশুনানীর ঘোষণা দিয়েছিল। সংসদীয় কমিটির এ পদক্ষেপে অনেকেই আশার আলো দেখেছিলেন। বাস্তবে সে উদ্যোগও বেশি দূর এগোতে পারেনি। তা না হলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পর দুদকের তদন্ত এবং বীমা আইনের অস্বচ্ছতা ও গ্রাহক হয়রানি, বঞ্চনা ও প্রতারণা এতদিনে বন্ধ হয়ে দেশের বীমা খাত একটি স্বচ্ছ ধারায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ খুঁজে পেত।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর প্রথম পেশা হিসেবে ১৯৬০ সালের ১ মার্চ একটি বীমা কোম্পানীতে যোগ দিয়েছিলেন। সে হিসেবেই সরকার ১ মার্চকে জাতীয় বীমা দিবস হিসেবে পালন করছে। গত বছর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত জাতীয় বীমা দিবসের উদ্বোধন উপলক্ষে দেয়া বক্তৃতায় গ্রাহকদের অর্থ পাওয়া নিশ্চিত করার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ব্যক্তিগত আগ্রহে তিনি বিভিন্ন সময়ে বীমা কোম্পানীগুলোকে গ্রাহকবান্ধব নীতি গ্রহণের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কিন্তু তারপরও অবস্থার কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেনি। বীমা কোম্পানিগুলোর মালিক-পরিচালকদের দায়মুক্তি বন্ধ করে গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষায় প্রয়োজনীয় আইনগত সংস্কার ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ সম্পদ পাচারের সুযোগ নিñিদ্রভাবে বন্ধ করতে হবে। বছরের পর বছর ধরে কিস্তি পরিশোধ করে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও যেখানে গ্রাহকরা তাদের পাওনা আদায় করতে পারছে না, সেখানে নানা কারণে বন্ধ বা অনিয়মিত বীমা গ্রাহকদের জমাকৃত টাকা ফেরত পাওয়ার আইনগত কোনো নিশ্চয়তা নেই। এক শ্রেণীর বীমা প্রতিনিধি সাধারণ মানুষকে নানাভাবে প্রলুব্ধ করে বীমা পলিসি গ্রহণের পর তাদের সাথে প্রতারণা করছে। এভাবেই দেশের সম্ভাবনাময় বীমা খাত সাধারণ মানুষের কাছে আস্থাহীনতার সংকটে পড়েছে। অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা এবং ব্যক্তিগত ও পারিবারিক অর্থনৈতিক ঝুঁকি গ্রহণের ক্ষেত্রে জীবনবীমা এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যে সাধারণ বীমা একটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত খাত। এ খাতের স্বচ্ছতা, নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু বিকাশ সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ও জীবনমান উন্নয়নে বড় ভ’মিকা রাখতে পারে। ¯্রফে আইনগত অস্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতির কারণে এ খাতের দুর্নীতিবাজ রাঘব বোয়ালরা পার পেয়ে যেতে পারে না। বীমা কোম্পানিগুলোর অর্থ আত্মাসাৎ এবং অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় গ্রাহক হয়রানি বন্ধে অর্থমন্ত্রনালয়, বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত সংস্থা(ইড্রা), দুদক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। ছয়বছর আগে করা অভিযোগের বাইরেও আরো অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। সব অভিযোগের অনুপুঙ্খ তদন্ত নিশ্চিত করে দোষীদের শাস্তি এবং গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন