পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই যখন হিসাব-নিকাশের প্রয়োজন দেখা দেয় তখন থেকেই মূলত অঘোষীতভাবে ‘অর্থনীতি’ শব্দের সূচনা হয়, যদিও তার সংজ্ঞায়ীত ব্যবহার আদিসমাজ জানতো না। তবে তার উদ্ভাবন হয় মাত্র ২৫০ পূর্ব থেকে। মানবসভ্যতার উন্নয়নের সাথে সাথে অ্যাডাম স্মিথের ১৭৭৬ সালের ‘অহ ওহয়ঁরৎু ওহঃড় ঞযব ঘধঃঁৎব অহফ ঈধঁংবং ড়ভ ঞযব ডবধষঃয ড়ভ ঘধঃরড়হং’ নামক কালজয়ী গ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে অর্থনীতির আধুনিক যাত্রা শুরু হলেও এর আগে ইউরোপে আরো বেশ কিছু অর্থনৈতিক কালের আবির্ভাব ঘটেছিল, যেগুলো আধুনিক অর্থনীতি তৈরির পূর্বাভাস দিয়ে গিয়েছিল।
“অর্থনীতি”-র আরবি প্রতিশব্দ ইকতিসাদ আর “ইসলামি অর্থনীতি”-র আরবি হলো আল-ইকতিসাদ আল-ইসলামি। “অর্থনীতি”-র ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘ঊপড়হড়সরপং’ শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘ঙরশহড়সরধ’ থেকে উদগত। ‘ঙরশহড়সরধ’ শব্দের দু’টি অংশ হলো ‘ঙরশড়ং’ এবং ‘ঘবসবরহ’। ‘ঙরশড়ং’ শব্দের অর্থ হলো গৃহ এবং ‘ঘবসবরহ’ শব্দের অর্থ হলো ব্যবস্থাপনা। এ দু’টি শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো আর্থিক বিষয়াদির ‘গৃহ ব্যবস্থাপন’ শাস্ত্র। (ইসলামের অর্থনৈতিক ইতিহাস ও ব্যাংকিং, মো. আবু তাহের, পৃ. ১৭)
পারিভাষিক অর্থের ক্ষেত্রে অ্যাডাম স্মিথ ১৭৭৬ সালে প্রভাদতুল্য গ্রন্থ ‘অহ ওহয়ঁরৎু ওহঃড় ঞযব ঘধঃঁৎব অহফ ঈধঁংবং ড়ভ ঞযব ডবধষঃয ড়ভ ঘধঃরড়হং’-এ লেখেন, ঊপড়হড়সরপং রং ঃযব ঝপরবহপব ড়ভ ডবধষঃয. (অর্থনীতি হলো সম্পদের বিজ্ঞান)।
ড. আহমদ মুখতার বলেন, ‘অর্থনীতি ওই শাস্ত্রকে বলা হয়, যাতে উৎপাদন, বণ্টন ও ব্যয় নিয়ে আলোচনা হয়। ’ (মুজামু লুগাতিল আরবিয়্যা আল মুআসিরা, খÐ ৩, পৃষ্ঠা ১৮-১৯)
ইসলামী অর্থনীতির সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে ড. মুসফির কাহতানি লেখেন, ‘ইসলামী অর্থনীতি হলো ওই সব বিধান ও নিয়মনীতি, যা দ্বারা সম্পদ উপার্জন, ব্যয় ও বৃদ্ধি ব্যবস্থাপনা করা হয়। ’ (আন নিজামুল ইকতিসাদি ফিল ইসলাম, পৃষ্ঠা ১)
ইসলামি অর্থনীতির মূল ভিত্তিই হলো কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস। আর হালাল-হারাম বা বৈধ-অবৈধের আলোচনাকে সামনে রেখে এই চার মূলতন্ত্রের আলোকে ইসলামি অর্থনীতির গবেষণা শুরু হয়। যেমন- উল্লেখিত চার মূলতন্ত্রের আলোকে বলা যায় ব্যবসা হালাল আর সুদ হারাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, “আমি ব্যবসাকে হালাল আর সুদকে হারাম করেছি।” (সুরা বাকারা, আয়াত:২৭৫) সুদ বা রিবা আবার প্রধানত দুই প্রকার: ১. রিবা নাসিয়্যাহ ২. রিবাল ফযল; একে রিবাল বাইও বলা হয়। রিবা নাসিয়্যাহর সংজ্ঞা: ইমাম আবু বকর জাস্সাস রাহ. বলেন, “এমন ঋণ যাতে মেয়াদ শর্ত করা হয় এবং গ্রহিতাকে অতিরিক্ত প্রদানের শর্ত করা হয়।” (আহকামুল কুরআন ১/৫৫৭) অর্থাৎ অতিরিক্ত প্রদানের শর্তে কাউকে মেয়াদি ঋণ দেওয়া। একে রিবাল করযও বলা হয়। রিবান নাসিয়্যাহ-এর আরেক প্রকার হল, রিবাদ দাইন। সুদের বিষয়ে অন্য একদিন বিস্তারিত লিখবো,ইনশা আল্লাহ।
পবিত্র কুরআনের শুরুতে সুরা বাকারার তিন নম্বর আয়াতে ইসলামি অর্থনীতির একটি মৌলিক কথা আল্লাহ পাক আমাদের শিক্ষা দিয়ে বলেন, আমাদেরকে যা দিয়েছেন তা হচ্ছে নিয়ন্ত্রিত মালিকানা। মূলত এসবের মৌলিক মালিকানা হলো একমাত্র বিধাতা আল্লাহর জন্য। তিনি বলেছেন, “তাদেরকে যে জীবনোপকরণ দান করেছি তা থেকে তারা ব্যয় করে।” এখানে খুব যতেœর সাথে ‘নিয়ন্ত্রিত মালিকানা’ বিষয়টি বুঝতে হবে। আর তা হলো যেভাবেই হোক বৈধ পদ্ধতিতে সম্পদের মালিক হতে হবে, যেখানে নামমাত্রও সুদের গন্ধ থাকা যাবে না। এবার মালিক হওয়ার অবৈধ ১৮টি পন্থার ব্যাখ্যাহীন শিরোনাম বলা হলো, ১) সুদী ব্যাংক, ২) ডি. পি. এস/ উচঝ ডিপোজিট পেনশন স্কীম, ৩) সুদী ব্যাংকের যে কোনো লোনই সুদী লোন, ৪) প্রাইজবন্ড, ৫) ক্রেডিট কার্ড, ৬) ক্রেডিট কার্ড দ্বারা এটিএম থেকে টাকা উত্তোলন করলে যে চার্জ নেওয়া হয় তা সুস্পষ্ট সুদ। কেননা কার্ডের ফি তো নিচ্ছেই। এখন অতিরিক্তটা ঋণের বিনিময়ে হচ্ছে। ৭) বন্ড, ৮) স্টুডেন্ট লোন, ৯) লটারী, ১০) পোস্ট অফিসের সঞ্চয়পত্র, ১১) জমি বন্ধক, ১২) বাড়ি বন্ধক, বাড়ি ভাড়ার ক্ষেত্রে সিকিউরিটি বেশি দিলে ভাড়া কমিয়ে দেওয়া, ১৩) ঐচ্ছিক প্রভিডেন্ট ফান্ড, ১৪) লাভের হার নির্ধারণ না করে নির্দিষ্ট পরিমাণ মুনাফা প্রদানের শর্তে বিনিয়োাগ করা, ১৫) জুয়েলারী দোকানে স্বর্ণ বন্ধক রেখে সুদের উপর লোন প্রদান করা হয়। তেমনিভাবে ব্রাক, আশা, গ্রামের মহাজন সুদের ভিত্তিতে লোকদেরকে লোন দিয়ে থাকে। ১৬) ফরম বিক্রির ছুতায় রিবা নাসিয়্যাহ, ১৭) কিস্তি-বিক্রি, ১৮) ইনস্টাবাই। এই ১৮টির বিস্তারিত জানতে চাইলে মাসিক আলকাউসার জুন-জুলাই’ ২০১৫ সংখ্যা দেখতে পারেন।
সহীহ মুসলিমে হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লা‘নত করেছেন সুদগ্রহীতার উপর ও সুদদাতার উপর এবং এর দলীল লেখকের উপর ও সাক্ষ্যদাতার উপর। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৯৮) মাসিক আলকাউসার, সেপ্টেমর’১৮ সংখ্যাতে এসেছে কুরআন-সুন্নাহর স্পষ্ট -ে-ঘাষণার পর তো কোনো প্রকারের বাহানা-অজুহাতেরও অবকাশ নেই। সুদমাত্রই হারাম সেটা ঝরসঢ়ষব ওহঃবৎবংঃ (সরল সুদ) হোক বা পড়সঢ়ড়ঁহফ ওহঃবৎবংঃ (চক্রবৃদ্ধি সুদ) কিংবা বর্তমান সময়ের ইধহশরহম ওহঃবৎবংঃ। কারণ সব ধরনের রিবা ও সুদকেই কুরআন-সুন্নাহয় হারাম করা হয়েছে। আর এ কারণেই এই সাম্প্রতিক সময়েও জিদ্দা আলমাজমাউল ফিকহিল ইসলামীতে ৪৫ টি মুসলিম দেশের প্রায় ২০০ শরীয়া বিশেষজ্ঞ সর্বসম্মতিক্রমে ব্যাংকিং ইন্টারেস্টকে সম্পূর্ণ হারাম বলেছেন।
ইসলামি অর্থনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো বলে আজকের লেখার ইতি টানবো, ইনশা আল্লাহ। ইসলামের অর্থনৈতিক ইতিহাস ও ব্যাংকিং গ্রন্থে মো. আবু তাহের ইসলামী অর্থনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলোর ক্ষেত্রে লিখেছেন, ১. নিরংকুশ ও নিঃশর্ত মালিকানা একমাত্র আল্লাহর, ২. ইসলামি জীবনধারা, ৩. শরি‘আভিত্তিক উপার্জন, ৪. ধন-সম্পদের ন্যায্য ও সুষম বন্টন, ৫. যাকাত ও উশর ব্যবস্থার প্রবর্তন ও বাস্তবায়ন, ৬. বায়তুল মাল প্রতিষ্ঠা, ৭. সুদবিহীন ও শোষণমুক্ত অর্থব্যবস্থা, ৮. করযে হাসানা, ৯. মরাসী আইনের বাস্তবায়ন, ১০. ব্যবসায়িক অসাধুতা ও অসৎ কর্মকাÐের বিলোপসাধন, ১১. ইসলামি ভূমিস্বত্ব বাস্তবায়ন, ১২. শ্রশনীতি, ১৩. অপব্যয় ও বিলাসিতার পরিহার, ১৪. সকল মানুষের জীবিকার নিশ্চয়তা, ১৫. সুবিচার প্রতিষ্ঠা, ১৬. দারিদ্র বিমোচন, ১৭. সামাজিক কল্যাণ ও আর্থিক নিরাপত্তা, ১৮. ন্যায়সঙ্গত ক্ষেত্রে সীমিত মাত্রায় রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ইত্যাদি।
পরিশেষে বলবো, বিধাতার বিধান তার সৃষ্টির জন্য এতই উপযুক্ত ও বাস্তবসম্মত যে, কখনো কখনো বিজ্ঞানও তার যৌক্তিকতা খুঁজতে ব্যর্থ হয়। সর্ব শ্রেষ্ঠ ন্যায় বিচারক আল্লাহ তা‘আলা ও বিশ^মানবতার দূত মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সুদকে হারাম করেছেন তখন পরিভাষা পরিবর্তন করে তথাকথিত ইসলামি ব্যাংকগুলো হারামকে হালাম বলে। ইন্টারেস্ট, লাভ, ফিনান্সিয়াল চার্জ অথবা সুদকে মুনাফা বলে প্রতিমুহূর্তে তারা গ্রাহকদের প্রতারণা করেছে,করছে। যে নামেই ডাকা হোক তা হারাম। সুতরাং কম এবং বেশি পরিমাণের সাথে রিবা হওয়া না-হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই; বরং ঋণের অতিরিক্ত যাই কিছু হোক সেটি সুদের অন্তর্ভুক্ত। কারো কথায় অন্ধবিশ^াসী না হয়ে, আল্লাহ ও তাঁর রসুলের কথায় অন্ধবিশ^াসী হয়ে জান্নাতের পথে এগিয়ে যাবো।
তাই আধুনিক ইসলামি অর্থনীতি বলে গ্রাহকদের যে প্রতারণা আর অস্পষ্ট লাভের আশারবাণী শোনানো হয় তা সম্পূর্ণ অনিসলামিক শব্দের পরিবর্তন। আল্লাহ পাক আমাদের রক্ষা করেন। হে রাসূল আপনি বলে দিন, আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য প্রকাশ করো। আর যদি তারা বিমুখতা অবলম্বন করে তাহলে আল্লাহ কাফেরদের ভালোবাসেন না’ (সূরা ইমরান : ৩১-৩২)
লেখক, প্রাবন্ধিক, সমাজসেবক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন