রাষ্ট্রভাষা করার প্রথম চিন্তা
প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম
অনেকে হয়তো মনে করেন, ভাষা আন্দোলন আপনা আপনি হয়েছে। দুনিয়ায় কোনো কিছুই আপনা আপনি হয় না। ভাষা আন্দোলনের উৎপত্তি হয়েছে একটি প্রতিষ্ঠানের প্রচেষ্ঠায় ও সংঘটনে। প্রতিষ্ঠানটির নাম তমদ্দুন মজলিস। তখন এটার পুরা নাম ছিল পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস। কারণ, তখনও পাকিস্তান থেকে আমাদের দেশ পৃথক হয় নাই। বিপ্লবী ইসলামী আদর্শের প্রতিষ্ঠা ছিল এই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। আমরা বৃটিশ সাম্রাজ্যের কবল থেকে প্রথম স্বাধীনতা পেয়েছিলাম ১৯৪৭ সনের আগস্ট মাসে, আর এর পর পরই মজলিসের প্রতিষ্ঠা করেছিলাম ১ সেপ্টেম্বর-এ ১৯ নং আজিমপুর রোডে। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্সের অধ্যাপক এবং থাকতাম আজিমপুরের ১৯ নম্বরের বাসাতেই। এখন দেখা যাচ্ছে, ইসলামী আদর্শকে প্রতিষ্ঠার জন্য চারদিকে কথা উঠছে। দাবি উঠছে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য। আমাদের রাষ্ট্রের মন্ত্রীগণ এবং রাষ্ট্রপতিও ইসলামকে সর্বত্র কায়েম করার কথা বলছেন বেশ জোরেশোরে। এমনিভাবে বৃটিশ আমলেও দাবি উঠেছিল সাম্যবাদী ও ভ্রাতৃত্বমূলক ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। প্রস্তাবিত সেই রাষ্ট্রের নাম দেয়া হয়েছিল পাকিস্তান। পাকিস্তান সংগ্রামে বাংলাদেশের মুসলমানেরা কারো থেকে পিছিয়ে ছিল না; বরং পাকিস্তানের জন্য যখন ভোটের প্রস্তাব উঠল তখন সব চাইতে বেশি ভোট দিয়েছিল বাংলাদেশের মুসলমানরা। এর ফলে লাভ হলো পাকিস্তান। পাকিস্তানের আমাদের এই অংশের নাম ছিল পূর্ববঙ্গ। তারপর তার নাম হলো পূর্ব পাকিস্তান। পাকিস্তান লাভ করতে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছিল, দিতে হয়েছিল অনেক জান, অনেক খুন। মুসলমান জনগণকে নেতারা মহান ইসলামের নাম এবং খেলাফতি শাসনের নাম করেই উদ্বুদ্ধ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। সমর্থ হয়েছিলেন তখনকার হিন্দু জমিদার, মহাজন ও অন্যান্য অত্যাচারীদের অমানুষিক শোষণ ও অত্যাচার থেকে মুক্ত করে শান্তিময় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আশা দিয়ে। এই বড় আশা ও রঙ্গিন স্বপ্ন দেখিয়েই জনগণকে মুসলিম লীগে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিল।
পাকিস্তান আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল মুসলিম লীগ। এটা ছিল সমস্ত ভারতের মুসলমানদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান। কিন্তু পাকিস্তান লাভের পর দেখা গেল, মুসলিম লীগের নেতারা সব ভুলে গিয়ে পদ ও হীনস্বার্থের লোভে আত্মপ্রতিষ্ঠায় মশগুল। পরিষ্কার আদর্শ ও ধারণার অভাবে দেশ তখন চালকবিহীন তরণীর মতো উদ্দেশ্যহীনভাবে ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলেছে। এই অন্ধকারময় লক্ষ্যহীন পরিবেশে আশার উজ্জ্বল আলো নিয়ে এগিয়ে এল তমদ্দুন মজলিস। বিপ্লবী ইসলামী আদর্শের প্রকৃত রূপ কী হবে, পাকিস্তানের তথা ইসলামী রাষ্ট্রের রূপ কী হবে, তার অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি কী হবে, আর কী হবে তার শিক্ষা ব্যবস্থাÑ এসবের কোনো পরিষ্কার ধারণাই ছিল না মুসলিম নেতৃত্বের। দু’শ বছর ধরে সাম্রাজ্যবাদী বিদেশি শাসনের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত ও তাদের আদর্শহীন শিক্ষা-দীক্ষায় পথভ্রষ্ট নেতৃত্বের সে ধারণা থাকার কথাও ছিল না। অচিরেই আমরা মজলিসের মাধ্যমে আত্মনিয়োগ করলাম গবেষণায় ও সংগঠনে। দেশের সব জেলায় সংগঠন ছড়িয়ে পড়লে দলে দলে বিপ্লবী ও আদর্শ-পাগল কর্মীরা মজলিসে যোগ দিল, যোগ দিলেন অনেক বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিক। মজলিসের মাধ্যমে প্রকাশিত হলো অনেক পুস্তিকা, অনেক বই, প্রকাশিত হলো সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’ ও মাসিক ‘দ্যুতি’র মতো দু’টি বিপ্লবী পত্রিকা। এর আগেই আমার চিন্তা হয়েছিল, স্বাধীন পাকিস্তানে আমাদের রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম কী হবে? তখন ছিল ইংরেজি ভাষার রাজত্ব। তাছাড়া উর্দুকে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিয়েছিল সরকারি নেতারা। এই বিদেশি দু’ভাষার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে আমাদের আদর্শ রূপায়ণ যে সম্ভব নয়, তা আমি ভালো করেই বুঝেছিলাম। কারণ, মাতৃভাষার মাধ্যমে ছাড়া কোনো আদর্শ সুষ্ঠুভাবে প্রচারিত ও প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়। আর এই কারণেই আমরা একটি ব্যাপক আন্দোলন সৃষ্টির কাজে আত্মনিয়োগ করি।
সূত্র: অগ্রপথিক, শহীদ দিবস সংখ্যা ১৯৮৬
রাষ্ট্রভাষার দাবি
অলি আহাদ
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই ভাষা আন্দোলনের গোড়াপত্তন ঘটে। ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ সরকারের মন্ত্রী সাহিত্যিক হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সাহিত্য সম্মেলনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃতিদানের প্রকাশ্য দাবি উত্থাপিত হয়।
বস্তুত করাচী থেকে ঢাকা পর্যন্ত উর্দু ভাষাভাষী ও বাংলা ভাষাভাষী মহলের উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা অথবা লিঙ্গুয়াফ্রাংকা বা সাধারণ ভাষারূপে গ্রহণের বাদ-প্রতিবাদই পরবর্তীকালে শিক্ষাঙ্গন ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন অতিক্রম করে রাজনৈতিক অঙ্গনে জটিল রাজনৈতিক সমস্যায় রূপান্তরিত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষাঙ্গন এবং সাহিত্যসেবী বিদগ্ধজনের দ্রুত সমর্থনপুষ্ট দাবি ‘বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের অফিস আদালত ও শিক্ষার মাধ্যম করিতে হইবে’ অচিরেই পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের সার্বজনীন দাবিতে পরিণত হল। ঢাকার বিভিন্ন সভা ও মিছিলের মূল আওয়াজ ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ ক্রমশ আন্দোলনকারীদের বোধোদয় হয় যে, পূর্ববঙ্গ পাকিস্তান রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য বিধায় আমাদের দাবি বাংলাকে প্রাদেশিক ভাষা করার দাবিতে পর্যবসিত হয়ে পড়বার আশংকা রয়েছে। অতএব, প্রাথমিক ভুল সংশোধন করে আমাদের দাবি ঠিক করা হলো: ‘বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।’ ঢাকার রাজপথে মিছিলের শ্লোগান ছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ‘উর্দু বাংলার বিরোধ নাই’ ‘উর্দু বাংলা ভাই ভাই’ ‘উর্দুর পাশে বাংলা চাই।’ এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, নির্দয় সরকারি হামলা রুখে দাঁড়াবার ঐতিহাসিক প্রয়োজনে বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবীদের গণ্ডি অতিক্রম করে সেদিন সর্বত্যাগী নির্ভীক তরুণ ছাত্র সমাজের উপরেই এ সক্রিয় আন্দোলনের মূল দায়িত্ব বর্তেছিল। সেই দাবি পূরণের স্বার্থেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ও পুরোভাগে ছাত্র সমাজের আবির্ভাব ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়-পূর্বকাল পর্যন্ত এই ধারাই অব্যাহত ছিল। আমাদের জাতীয় রাজনীতি, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ভাষা আন্দোলন বিশেষ করে ’৫২ সনের ২১ ফেব্রুয়ারির আত্মাহুতি গভীর প্রভাব ফেলছে। বলা যায়, সেই আত্মাহুতির পথ ধরেই এ জাতির স্বাধিকার চেতনা উজ্জীবিত হয়, যা পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রামে পর্যবসিত হয়।
সূত্র: অগ্রপথিক, শহীদ দিবস সংখ্যা ১৯৮৬।
শুরুতেই যুক্ত হই
সানাউল্লাহ নূরী
ভাষা আন্দোলনের সূচনাকাল থেকেই আমি এর সাথে জড়িত ছিলাম। আমি তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠা থেকেই এর কর্মী ছিলাম। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে তমদ্দুন মজলিসের সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে আমি দায়িত্ব পালন করতে থাকি। এছাড়া এর আগে থেকেই আমি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলাম।
তমদ্দুন মজলিস প্রতিষ্ঠার সময় অবশ্য আমি এর সাথে জড়িত ছিলাম না। আমি তখন জগন্নাথ কলেজে কমার্সের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। প্রিন্সিপাল সাহেবের বর্তমান বাড়িটি তখন আমাদের হোস্টেল ছিল। আমার রুমেই ‘ইনসান’ পত্রিকার অফিস ছিল। আমি তখন ‘ইনসান’ পত্রিকার যুগ্ম-সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। কলেজে ছাত্রনেতা হিসেবে আমার তখন বেশ নামডাক। একদিন আমি প্রিন্সিপালের অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় একজন হালকা-পাতলা যুবক সাইকেল থেকে নেমে আমাকে বললেন, সানাউল্লাহ্ নূরীকে কোথায় পাওয়া যাবে? আমি বললাম, আমার নামই নূরী। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কোথা থেকে এসেছেন? তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলায় আমি ভেবে নিলাম, উনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র। পরে জানতে পারলাম, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের লেকচারার আবুল কাসেম।
তিনি তমদ্দুন মজলিস গঠনের কথা বললেন এবং এর আদর্শ ও কর্মসূচি আমার কাছে খুলে বললেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবির কথা যখন তিনি বললেন, তখন তমদ্দুন মজলিসের প্রতি আমার যথেষ্ট ভক্তির সঞ্চার হয়েছে। তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে করতে কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে সিনেমা হল পর্যন্ত এলাম। কাসেম সাহেব নূরপুর ভিলায় তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে অনুষ্ঠিতব্য সভার কথা বলেন এবং আমাকে সেখানে উপস্থিত থাকতে অনুরোধ করলেন। অধ্যাপক আবুল কাসেমের সাথে আমার এই প্রথম পরিচয়। এই সূত্র ধরেই আমি তমদ্দুন মজলিসে জড়িয়ে পড়ি।
নূরপুর ভিলায় অনুষ্ঠিত সভায় আমি হাজির হয়েছিলাম। বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার দাবি নিয়েই বিশেষভাবে আলোচনা হয়েছিলো এবং কীভাবে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায় তা নিয়ে আলোচনা হয়েছিলো ব্যাপকভাবে। আমার যতদূর মনে পড়ে, এই আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন, কবি জসীম উদ্দীন, অধ্যাপক কাজী আক্রাম, শাহেদ আলী, অধ্যাপক আবুল কাসেম প্রমুখ। আলোচনার শেষ পর্যায়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলার সপক্ষে স্বাক্ষর অভিযান, সেমিনার, আলোচনা সভা, জনসভা ইত্যাদি অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল।
নূরপুর ভিলা থেকেই আমি মজলিসের কার্যে নিজেকে আবদ্ধ করি এবং এর বিভিন্ন কর্মতৎপরতায় অংশগ্রহণ করি। এ ছাড়া ইনসান পত্রিকার মাধ্যমেও আমি রাষ্ট্রভাষার দাবি তুলে ধরতে থাকি।
১৯৪৭ সালের নভেম্বরে ইনসান পত্রিকা প্রকাশ হয়। ৮-৯ মাস প্রকাশের পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। ইনসান সংগ্রামী ছাত্র-জনতার মুখপত্র হিসেবে ভাষা আন্দোলনের দাবিকে সোচ্চারকণ্ঠে তুলে ধরে। একবার ইনসানে ক্যাপশন দিয়েছিলাম ‘ডাণ্ডার জোরে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার অপচেষ্টা’। সে সংখ্যা কায়েদে আজমের রেসকোর্সের বিশাল জনসভার আশপাশে প্রচুর সংখ্যক কপি বিক্রি হয়েছিলো। ১৯৪৮ সনের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এদিন ঢাকা নগরী বিক্ষোভ আর মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা মন্ত্রীদের রাস্তায় আটক করে পদত্যাগে বাধ্য করে। এ দিনের আন্দোলনের ফলে ভাষা আন্দোলন সারাদেশে বিস্তৃতি লাভ করে। ১১ মার্চের পূর্বে প্রত্যন্ত অঞ্চল তো দূরের কথা ঢাকাতেও অনেক স্থানে রাষ্ট্রভাষার সপক্ষে প্রচার চালাতে গেলে নাজেহাল হতে হতো। অনেক সময়ই মিছিলে হামলা করা হতো। বিশেষ করে পুরনো ঢাকার চকবাজার, সিদ্দিক বাজার, কলতাবাজার প্রভৃতি এলাকায় রাষ্ট্রভাষার দাবি নিয়ে কথা বলা যেতো না। কলতাবাজার, রায়শাহবাজার দিয়ে ছাত্রদের নিরাপদে আসার উপায় ছিল না। ছাত্র দেখলেই তারা এসব আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে মারতো, ধরতো। তাই আমরা নবাবপুর রোড দিয়ে না এসে শাঁখারীপট্টির মধ্যদিয়ে নয়াবাজার, বংশাল হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আসতাম।
সূত্র: অগ্রপথিক, ভাষা দিবস সংখ্যা ১৯৯১।
ছাত্রীদের লড়াই
রওশন আরা বাচ্চু
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে সরকার আন্দোলন নস্যাৎ করার জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করে হরতাল, সভা ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করল। সে রাতেই মেয়েদের হোস্টেলে কানাঘুষায় খবর পৌঁছাল যে, ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করে সভা শেষে শান্তিপূর্ণভাবে শোভাযাত্রা করা হবে। এ নিয়ে ছাত্রীদের মধ্যে দেখা দিল বিতর্কের ঝড়। নানা দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে সকালেই এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী সংগ্রহের জন্য আমরা বেরিয়ে গেলাম। কিছুসংখ্যক ছাত্রী থেকে গেল হোস্টেলে। আমরা হেঁটে দূরদূরান্ত থেকে ছাত্রীদের সংগ্রহ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের আমতলায় এলাম।
ইতোমধ্যে ১৪৪ ধারা না ভাঙার অনুরোধ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রদের কাছে আসেন ভাইস চ্যান্সেলর সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন। উপস্থিত ছাত্ররা বিনয়ের সঙ্গে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
আমতলায় গাজীউল হকের সভাপতিত্বে দুপুর প্রায় ১২টার দিকে ছাত্রসভা শুরু হয়। তুমুল বিক্ষোভের মধ্যে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ নিয়ে তর্কবিতর্ক চলে। বিষয়টি তুঙ্গে পৌঁছালে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে মেনে নেওয়া হলো।
ছাত্রছাত্রীরা কার আগে কে যাবে, এ প্রতিযোগিতা শুরু হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে মিছিলে যোগ দেওয়ার জন্য ছাত্রীরা গেটের কাছে চলে গেল। গেটের পাশে তখন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুজাফফর আহমদ, ফিজিক্যাল ইনস্ট্রাক্টর মতিউর রহমানসহ আরও কয়েকজন অধ্যাপক ও অসংখ্য ছাত্রছাত্রী জমায়েত হয়েছেন। পুলিশের কয়েকজন লাঠি হাতে কর্ডন করে দাঁড়িয়ে আছে গেটে। বাকিরা রাইফেল হাতে পজিশন নিয়ে আছে। ড. শহীদুল্লাহর চেহারায় উদ্বেগ। তিনি বলে উঠলেন, ওরা পজিশন নিয়ে আছে।
ঠিক হলো, গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্য ছাত্রীরা প্রতিটি দলের অগ্রভাগে থাকবে। সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আবদুল মতিন কাগজ-কলম নিয়ে নামের তালিকা তৈরি করতে শুরু করলেন। প্রথমে দলগুলোর নাম লেখা গেলেও পরে তা আর সম্ভব হয়নি। সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গের মতো বিক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীরা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই› স্লোগান দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল; কেউ পুলিশ কর্ডনের লাঠির ওপর দিয়ে, কেউ-বা লাঠির নিচ দিয়ে। কিছু ছাত্র বেরোচ্ছিল দেয়াল টপকে, কিছু ছাত্র মধুদার ক্যানটিনের পাশ দিয়ে ফোকর গলে। আপসহীন ইস্পাতকঠিন শপথে উদ্বুদ্ধ সংগ্রামী ছাত্রছাত্রীদের আটকায় কে? সাফিয়া আপা, হালিমা ও আমি গেটের কাছে আসি এবং সব ছাত্রী যাতে মিছিলে যোগ দিতে পারে, সে সুযোগ সৃষ্টিতে সাহায্য করি। সাফিয়া আপা যান লাঠির ওপর দিয়ে, হালিমা লাঠির নিচ দিয়ে। দুটোর কোনোটাই আমার মনঃপূত হলো না। সে জন্য আমি ক্রমাগত ধাক্কা দিয়ে লাঠির কর্ডন সরিয়ে ফেলতে আপ্রাণ চেষ্টা করি এবং কর্ডন ভেদ করে তৃতীয় দলের সঙ্গে মিছিলে যোগ দিই।
প্রথম ও দ্বিতীয় দলের ছাত্রছাত্রীদের পুলিশ ট্রাকে তুলে নেয়। আপসহীন বিক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীর ধাক্কায় পুলিশ কর্ডন ভেঙে যায়। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় পুলিশের লাঠিচার্জ। আমি নিজেও তার হাত থেকে রেহাই পাইনি। চোখ জ্বালা করছিল। কাঁদানে গ্যাস ও লাঠিচার্জের মধ্যেই আমি ছুটে গেলাম অ্যাসেম্বলি হলের (জগন্নাথ হল) দিকে।
বেলা প্রায় সাড়ে তিনটায় মিছিল মেডিকেলের মোড়ে পৌঁছালে জেলা প্রশাসক কোরেশির নির্দেশে পুলিশ অবিরাম গুলি ছুড়তে থাকে। মেডিকেলের উল্টো দিকে এস এম হলের প্রভোস্ট এম এ গনির বাড়ি। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, গুলিগুলো আসছে কোন দিক থেকে। তাই দৌড়ে গিয়ে ভাঙা রিকশার অংশের মধ্যে আশ্রয় নিলাম। কিন্তু সে জায়গাটা নিরাপদ মনে হলো না। গুলির মধ্যেই কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে গনি সাহেবের বাড়ির ভেতরে গিয়ে আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ভাঙা রিকশার স্তূপের ওপর চড়ে কাঁটাতারের ওপর দিয়ে লাফ দিলাম। কাঁটাতারের মধ্যে আমার শাড়ি আটকে গেল। কাঁটাতার থেকে কেউ আমার শাড়ি ছাড়িয়ে দিয়েছিল। অবিরাম গুলির মধ্যে পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখার মতো সময় ছিল না।
সূত্র :‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ থেকে সংক্ষেপিত একুশের পটভূমি, একুশের স্মৃতি, সম্পাদক : মতিউর রহমান, প্রথমা প্রকাশন
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন