একটা লম্বা টুল-পাতা চিলতে বারান্দা। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এই টুলই কারখানা। বটিকা- মধুপুরের বটিকা তৈরি হয় এখানেই। পাশ ঘেঁষে আরেকটা ঘর। এই এক টুকরা বারান্দা কবরের আকার। তল্লার বেড়ায় লাগানো এই টুল রাতে তার বিছানা।
আচমকা এক রাতে খুটুর-খুটুর শব্দ। প্রথম রাতে ভাবল- ঘুণপোকা। মানুষ যখন ঘুমিয়ে পড়ে, গাছ-বৃক্ষ সবকিছু বিশ্রাম নেয়, ঘুণপোকা তখন ধারল দাঁত বসিয়ে আক্রোশে কাঠ রেণু রেণু করে কাটে। ঘুমের ঘোরে ঘুণে কাটার শব্দ সে আগেও শুনেছে। শব্দটা নতুন নয় বলে সে আমলে নেয় না।
পরদিন ঘুমানোর আগেই যখন শব্দটা শুনল, তখন পরিষ্কার হল, ঘুণপোকার নয় এই শব্দ। তৃতীয় রাতে খুটুর-খুটুর শব্দ নেই। মনে হয়, এই রাতটা ঘুণপোকা জিড়াবে- জিড়িয়ে শক্তি সঞ্চয় করবে। কাঠে একবার ঘুণপোকা ধরলে, শেষ না করে ছাড়ে না। ঘুণপোকার সঙ্গে দাদির লড়াই দেখেছে ছোটবেলায়। দাদি যে চৌকিটাতে থাকতেন, সেটা চারপাশ থেকে ঘুণপোকায় কেটে ফোকলা করে ফেলেছিল। দাদি সেটার উপর দুটা তক্তা পেতে শুইতেন। প্রতি শুক্রবার ভোরে চৌকিটা বাইরে বের করিয়ে ঘুণপোকায় খাওয়া জায়গাগুলোতে তুঁত আর নিমপাতা বাটা মাখিয়ে রোদে রেখে দিতেন। ভর দুপুরে এক কড়াই গরম পানি ঢালতেন। তাতেও কোন কাজ হত না। দাদিও জানতেন কাজ হবে না। অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল, তাই শুক্রবারের ওই লড়াইটা করতেন। আবার ঘুণপোকার শব্দ শুনে ঘুমানোও ছিল দাদির অনেকদিনের অভ্যাস। বলতেন, রাইতে পোকার এই শব্দ না শুনলে ঘুমাইতে পারি নারে- পোকায় তো আমগর মত কতা কইতে পারে না, কাঠ কাইট্যা যে শব্দ করে হেইডাই তার কতা- এইভাবেই পোকায় জানায় যে, বাইচ্যা আছে।
দাদির কথা শোনে সে অবাক হত- তাহলে শুধু মানুষ নয়, ঘুনপোকার মত ক্ষুদ্র পোকাও তার মত করে কথা বলে-
ঘুম লেগে আসতেই নরম আঙুলের খোঁচা। চমকে লাফ দিয়ে উঠতে গিয়েও সে চুপ মেরে যায়। আলগোছে নিজের শরীর সরিয়ে আনে টুলের পাশ বরাবর আধ হাতের মত চিলতে জায়গাটায়। ওখানে ঢুকতে হয় কাত হয়ে। দরকার পড়ে না ঢোকার, এই যা রক্ষা।
কোণে টাঙানো কাপড়ের লম্বা থলে। সেই এক আষাঢ় মাসে এসে ঝুলিয়েছিল আর ছুঁয়ে দেখেনি। ওই থলেটাই পেছনের জগত- অতীতের সঞ্চয়। কেন যাবে সে বাড়িতে- কী আছে তার ওই গান্ধা গ্রামে। কিছু নেই, কেউ নেই- নেই-ই তো। থাকলে কি সে কস্মিনকালেও সাদুল্লার কথায় রাজি হয় আর চলে আসে ঢাকায়।
সাদুল্লা মরা গাছে নতুন পাতা ধরিয়েছে। মরা গাছ-ই তো- সে তো মরেই গিয়েছিল। সেই হাটবারে পোটলা-পাটলি ছমেদ ল্যাংড়ার দোকানে রেখে সাদুল্লা বাড়ি ঘুরে গাঙ পাড়ে না গেলে কী হত আজ। মনে হলেও দম বন্ধ হয়ে আসে, আকুলি-বিকুলি করে ওঠে পরাণ। পানির তলায় আটকা পড়ার অভিজ্ঞতা আছে তার। ছোটবেলায় ব্রহ্মপুত্রে সাঁতরাবার সময় পানির নিচে গামছা পেঁচিয়ে যায় পায়ে। দম বের হয়ে যাবে-যাবে অবস্থায় শরীরের ভেতর কী যে তীব্র আকুতি আর তড়পানি-
মধুপুরের বটিকা তৈরি করে নকিব। সাদুল্লা বলে এই ফরমুলা তার নিজের আবিষ্কৃত। এই আবিষ্কার শব্দটা নকিবকে অনেকদিন ভুগিয়েছে। শেষ পর্যন্ত যেদিন পুরোপুরি বুঝল এই আবিষ্কার শব্দটার মানে-মতলব, সেদিন নকিব আপন মনে হাসে, এর মধ্যে আবিষ্কারটা কোথায়?
একদিন বলেওছিল, সাদু ভাই যে কি কইন, এইডা আবার আপনের কিসের আবিষ্কার, কিসের ফরমুলা-
সাদুল্লা ধমকে ওঠেছিল, দূর বেক্কল, এইডা একটা ওষুদ- সব ওষুদের আবিষ্কার আছে, ফরমুলা আছে। এইডার নাই, হেই কথা শুনলে মানুষে কিনবো তর বড়ি?
নকিব অনেক ভেবে দেখেছে, আবিষ্কার একটা আছে- আর সেটা হল তার ক্যানভাসের কথাগুলো। সেগুলো সাদুল্লা বড় সুন্দর করে বানিয়ে তাকে শিখিয়েছে। নকিব মনে মনে বলেছে, দেশের মানুষরে মুরখু পাইয়া সাদুল্লা বুট কালাইরে সন্দেশ কইয়া চালাইতাছে।
সে পুরাটা বুঝলেও কিছু বলতে পারে না, কিছু করতে পারে না। সাদুল্লা তাকে দোজখ থেকে বাঁচিয়েছে। গ্রামটা তার কাছে দোজখই হয়ে গেছিল।
সাদুল্লা বাবুপুরা বস্তি ছেড়ে সিদ্দিক বাজারে বাসা ভাড়া করে উঠে যাচ্ছে আগামিকাল। নতুন বাসার জন্য মাল-সামান কিনেছে তাকে নিয়ে। বংশাল থেকে খাট-আলনা-মিটসেফ-আলমারী, ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশনের পেছনে শাহজালাল কেইন হাউস থেকে বেতের চেয়ার। সবকিছু সাজিয়ে-গুছিয়ে রেখে এসেছে নতুন বাসায়। বিকেলে বউকে নিয়ে সদরঘাট গেছে কেনাকাটা করবে।
যাবার সময় বলেছে, নয়া ভাড়াটিয়া হইয়া যামু- আশপাশের মানুষজন আসবো-দেখবো- কি কস বউ-বাচ্চার লাগি কিছু নয়া জামা-কাপড় কিনতে অয় না?
নকিব উৎফুল্ল কণ্ঠে বলেছে, তা আর বলতে। বাবুপুরা বস্তি তো না, সিদ্দিকবাজার- মিয়াভাই, সিদ্দিকবাজার কী আর যাহা-তাহা কতাÑ ইজ্জতের সওয়াল-
সকালে আসবাবপত্র কেনার সময়ও সাদুল্লা একই কথা বলেছে। বাসা ভাড়া নেয়ার সময়ও বলেছে একই রকম কথা। সে বাসা ভাড়া নিয়েছে, এসব কেনাকাটা করছে- সব যেন বাধ্য হয়েই। বাবুপুরা বস্তি ছেড়ে সিদ্দিকবাজার মানে মিসকিন থেকে ভদ্রলোকের কাতার। ভদ্রলোক হওয়ার তাড়নায় সাদুল্লা যথেষ্ট পুলকিত ও প্রীত। তার সাথে ছায়ার মত মিশে থেকে নকিব ততটা না হলেও বেশ খুশিই। হঠাৎ হঠাৎ অবশ্য এমনও মনে হয়, ক্রমোন্নতিটা যেন তারই হচ্ছে। বস্তি যে একটা বাজে ধরনের গালি, এটা বোঝার পর গত দু’বছর ধরেই সে এক রকম মানসিক পীড়ন অনুভব করেছে।
নকিব সাদুল্লার বড় মেয়েটাকে টুলে বসিয়ে সীসা চুষাচ্ছিল। মাটিতে গর্ত করে সীসা গলিয়ে মাঝখানে ছিদ্র রেখেছে। সেই ছিদ্রে কাইতন ঢুকিয়ে গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে, যাতে সীসাটা গিলে না ফেলে বা হারিয়ে না যায়।
ওদের গ্রামের সদরালি বাউল বলেছিলেন, দলের গানে পাঠ কর মিয়া, সীসা জিহ্বায় রাখবা- জিহ্বা পাতলা অইবো- গলার স্বর ভালা অইবো- ধার আসবো স্বরে।
সে কখনও না করলেও কথাটা মনে ছিল। ওকে বানিয়ে দিয়েছে। সীসা চুষানের পর মেয়েটাকে আ-আ-উ-উ-ই-ই ইত্যাদি বর্ণ-উচ্চারণের অনুশীলন করাচ্ছিল। নিচে বসায় মেয়েটার মুখের থুতু এসে লাগছিল ওর মুখে। নকিব আর এখন এসব গায়ে মাখে না। সারাদেশের হাটে হাটে ঘুরে, এখানে-সেখানে থাকতে-খেতে গিয়ে গা ঘিন ঘিন করার অভ্যাস অনেক আগেই বর্জন করতে হয়েছে।
পাঁচ-ছ’বছরের মেয়েটির চেহারায় কী যে এক মায়া জড়িয়ে আছে- নকিব ঠিক ঠিক বলতে না পারলেও বুঝতে পারে। মেয়েটার মুখের দিকে তাকালে সে কোথায় যেন তার মৃত মা’র মুখের অস্পষ্ট আদল খুঁজে পায়। মেয়েটা যখন গোঙায়- গোঙাতে গোঙাতে থেমে গিয়ে অসহায়-করুণ দৃষ্টিতে তাকায়, চোখ থেকে টুপ টুপ পানি ঝরে, তখন নকিবের ইচ্ছে করে সব কিছু ছারখার করে দিতে। তারপরও যদি মেয়েটার মুখে কথা ফুটাতে পারত। কথা বলতে গেলেই গোঙায় মেয়েটা- যেন জবাইয়ের পর কোরবানির পশু। নিবিড় করে কান পেতে শুনেও ওর কণ্ঠের গোঙানিকে শব্দ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে না। শুধু নকিব নয়, কেউই পারে না।
মেয়েটার মুখে কথা বলতে চাওয়ার যে আকুতি, জিহ্বায় ও মুখ-গহ্বরে যে তীব্র আকুলি-বিকুলি আর অসহায়ত্ব, তা নকিবকে পীড়িত করে, কষ্ট দেয়। মেয়েটির নাম সকিনা। সকিনা যাত্রাপালায় অভিনয় করেছে সে। অভিনয়কালে সকিনার করুণ বেদনা মর্মাহত করত তাকে। এই শিশু সকিনা আর ইতিহাসের সকিনা এক নয়। তবু মনে পড়ে যায়- কারণ বেদনার বোধ। মানুষের কষ্টে কোন স্থান-কাল-পাত্র ভেদ নেই। ইতিহাসের সকিনার বেদনা-কষ্ট, সাদুল্লার মেয়ে সকিনার বেদনা-কষ্ট, নকিবের নিজের বেদনা-কষ্ট সব একটা সময় একই সমতলে প্রবাহিত হতে থাকে।
সাদুল্লার দুই ছেলে জমজ- বছর তিনেক বয়স-গুঁই সাপের বাচ্চার মত লুটোপটি করে বস্তির গলিপথে। গুঁই সাপের বাচ্চা- কথাটা সাদুল্লার। অনেক বার শুনেছে, আরে-আরে গুঁই সাপের বাচ্চারা করতাছে কী। প্রথমদিন হেসে ফেলেছিল নকিব। পরে যখন বুঝল, ওষুধ বিক্রির সময় শিক্ষিত মানুষের মত ফরফর করে কথা বলে যে, সেই সাদুল্লার এটাই আদরের ভাষা, তখন থেকে আর বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। তবে বারবার মনে হয়েছে, মানুষ আল্লাহর দেয়া জবানের কত অপব্যবহার করছে প্রতিদিন। অথচ, অবুঝ এই শিশুর মুখে স্পষ্ট জবান নেই। সকিনার বয়সী শিশুরা কত সুন্দর আদুরে গলায় কথা বলে। আর ভাষাহীন এই মেয়েটি অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার ভেতর কত কথা, কত আনন্দ-বেদনার প্রপাত বয়ে যাচ্ছে- কেউ জানতে পারছে না।
নকিব আদর করে মেয়েটার থুতনি নেড়ে দেয়। মেয়েটা কী সুন্দর অধরোষ্ঠ ছড়িয়ে হাসে- নিঃশব্দ হাসি। নকিব বুঝে নিয়েছে, ওর হাসি দেখতে হয়, শোনা যায় না এবং দেখেই বুঝতে হয় মেয়েটির ভাব-ভাবনা। এখানেই মেয়েটা খাটো হয়ে আছে- বড় বেশি খাটো।
নকিব বলল, কও মা, অ-অ-অ- আ-আ-আ-কও মা, ই-ই-ই- কও মা, উ-উ-উ, কও মা-
মেয়েটা ঠোঁট নাড়াচ্ছে, অধর নাড়াচ্ছে সবই ঠিকঠাক, কিন্তু জিহ্বা যেন নড়তেই চাইছে না- শব্দ অস্পষ্ট- গোলমেলে। দূর থেকে হাটবাজারের আওয়াজ যেমন, ওর কণ্ঠ সেই রকম হৈই-চৈ মাখা।
মেয়েটাকে কথা বলাবার জন্য সালমাকেও সারাক্ষণ তার মত করে চেষ্টা করতে দেখছে। সে জানে সালমা এখন ঘরের ভেতর বসে বসে নিশ্চয়ই কোন একটা ফন্দি-ফিকির আঁটছে। যা-ই করুক আর যা-ই বলুক, নকিবের তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। সব কিছুকেই সালমার স্বাভাবিক আচরণ বলে মেনে নিয়েছে সে।
আউলা-ঝাউলা মানুষ দেখলে আমি কিন্তুক সইবার পারি না- আমার গোস্বা অয়- আপনে কইলাম সিজিল অইয়া যান ঘোষক সাব-
এ রকম কথা সালমার মত টগবগা একটা মেয়ে তাকে বোধহয় বলতেই পারে। বস্তিতে ঘর আর বারান্দায় তো বিশেষ কোন তফাৎ নেই। সালমা ঘরে আর সে বারান্দায়। দুজনের মাঝখানে দুই সুতা পরিমাণ তল্লার বেড়া মাত্র। প্রথম দিকে খুটুর-খুটুর আর এখন নরম আঙুলের খোঁচা। নকিব এ সবই বেমালুম হজম করে ফেলে। তবে, সাদুল্লার মেয়ে সকিনাকে নিয়ে তাদের মধ্যে একটা ঐক্য-সূত্র গ্রথিত হচ্ছে। সালমা প্রণান্তকর প্রচেষ্টা চালিয়েছে মেয়েটার মুখে ভাষা ফোটাতে। সালমা আসার পর নকিব তার চেষ্টায় জোরালো সমর্থন পেয়েছে।
সে টের পাচ্ছে, তাকে নিয়ে সালমার ভাবনা দ্রুত ডালপালা ছড়াতে শুরু করেছে। সুযোগ পেলেই ওকে লক্ষ্য করে বাক্যবাণ নিক্ষিপ্ত হয়। ব্রহ্মপুত্র পাড়ে চৈতার ঘাটে তালগাছ তলায় ঠিক এ রকম বাণের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। লালবানু ছাগল হাচার দিতে গিয়ে ছাগলের থুতনি নেড়ে বলেছে, ইস্কুল ছাড়লা, কিন্তুক না শিখলা হাল বাওয়া, না শিখলা কোন কাম- দলের গানে পাঠ কইরা পেট চালাইবা ক্যামনে? আমার কইলাম রাগ ধরতাছে- লেঙ্গুর মুচরাইয়া দিমু- ভালা অইয়া যা পরাণের ছাগল-
লেজে মোচড় দিতেই ঊর্ধ্বাশ্বাসে দৌড়ায় ছাগল, পেছনে চারকোনা লালখতের সবুজ জমিন শাড়ির ভেতর টসটসা লালবানু। তার নিটোল বুক, পুষ্ট নিতস্ব উঠানামা করতে করতে নকিবের দৃষ্টিতে একটি নিষিদ্ধ দৃশ্যের উন্মোচন ঘটায়। অনেকক্ষণ পর্যন্ত গোপন এক ভাললাগার ঘূর্ণাবর্তে দোল খেতে থাকে সে।
না, লালবানু নেই, মরে গেছে। তার কাছে লালবানু তো মৃতই- যাকে দেখতে পায় না, কথা বলতে পারে না- যে রকম হলে অস্তিত্ব বোঝায়, লালবানুর তেমন কোন তৎপরতার বাতাসও নকিবের গায়ে লাগে না। লালবানু বলে কেউ ছিল, এটাও আর মনে করতে চায় না। সালমার অস্তিত্ব এখন ধরাছোঁয়ার মধ্যে থেকে থেকে অনুভব করে। তার হৃদয়সিক্ত বাক্যবাণ শুধু নয়, শুধু চোখের দৃষ্টি নিক্ষেপ মাত্র নয়, আঙুলের ডগাও ভাষাময় হয়ে উঠেছে নকিবের অনুভবে।
সালমা চটের পর্দা সরিয়ে রমণীয় গলায় একটু মশকরা ঢেলে দিয়ে বলল, ঘোষক সাবেরে কি চা-চু দিমু এক কাপ?
নকিব বলল, এট্টু ভুল অইলো- ঘোষক না, ক্যানবাচার, যার কাম শুধু কতা কওয়া, হাচামিচা বানায়া বানায়া মানুষের চক্ষে ভেল্কি লাগায়া, মগজে গোলমাল পাকায়া পকেট কাটা। পকেটমারেরা না কইয়া মারে, আর আমরা কতা কইয়া, জানায়া-শুনায়া মারি, তফাৎ এইটুকুন।
সালমা হাসল, তাইলে তো মনে অয়, নিজের কামের দিকে মুহব্বত নাই। ভাই সাবে যে কইন, ঘোষক সাবের লাগিই নাকি তার ব্যবসা জমজমাট। নবাবপুরে অহন দোকান খুঁজবার লাগছে- ওষুদ কুম্পানিও বলে খাড়া করবো। তয় ঘোষক সাবের তো কুনু উন্নতি দেখতাছি না-
নকিব বলল, সাদু ভাইজানের উন্নতি অইতাছে, এইটা কম কতা কি? নিজের উন্নতির কতা ভাববাম- কেন, কার লাগি-
সালমার কণ্ঠে বিস্ময়, কয় কী ঘোষক সাবে! নিজের উন্নতি নিজের লাগি, জীবনে-সংসারে কত কিছু লাগে, হেই সবের লাগি। অত আলাভোলা বৈরাগি মানুষ আমি দেখবার পারি না। ভাইসাবে রাস্তা থাইকা দোকানে ওঠতাছে, টুলের জায়গায় মেশিন বসাইবার চাইতাছে, আর-
নকিব বলল, আমি তো সাদু ভাইজানের ভাড়া খাটি- গলারে ভাড়া খাটাই- কিসের জীবন, কিসের সংসার আমার-
সালমা কিছু বলতে যাবে, তখনই গোঙাতে শুরু করে সকিনা। ওর চোখে ঘন কালো মেঘের মত বেদনা নামে-চারদিক অন্ধকার হয়ে ওঠে। প্রকৃতির অন্ধকার এক সময় কেটে আলো ছড়ায়। এই ফুটফুটে মেয়েটির অন্ধকার কাটে না।
সকিনাকে কথা বলানো ওদের একটা স্বপ্ন হয়ে উঠেছে। আর ওকে কেন্দ্র করেই তাদের দু’জনের স্বপ্নও কী লকলকিয়ে হাত-পা মেলছে!
বাসায় উঠার পরের মাসেই সিদ্দিক বাজার রোডে দোকানে উঠে গেল সাদুল্লা। আদি লক্ষেèৗ হেকিমী দাওয়াখানা, প্রোপাইটর, হেকিম মোহাম্মদ সাদুল্লাহ গাজি, লক্ষৌফেরত তিব্বিয়া বিশেষজ্ঞ-বাহারী সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছে। মফস্বলে ঘুরে ঘুরে হাট-বাজারে ওষুধ বিক্রি নেই- মজমা জমানোর জন্য প্রয়োজন নেই নকিবের উদাত্ত কণ্ঠের আকর্ষণীয় বয়ান। সাদুল্লা তার ব্যবসার কৌশল আমূল বদলে ফেলেছে।
নকিবকে শুরুতেই বলেছে, হারা জীবন এক কায়দায় কাম অয় না। জামানা বদলাইতাছে, কায়দাও বদলাইলাম কি কস-
নকিব বলে, ভাইজান আপনার বুদ্ধির কুনু তুলনা অয় না-
সাদুল্লার বস্তিঘরের পরিবেশ, বউ-বাচ্চার দশা যাই থাক, নিজের পোশাক-আশাক, চলাফিরা ছিল বেশ সৌখিন- ভাগলপুরি লুঙ্গি, জাপানি পপলিনের ধোপ-ধোলাই ফুলশার্ট, গলায় মাফলার, পায়ে চকচকে কালো পাম্পসু, চোখে হালকা সুরমা, গায়ে আতরের ঘ্রাণ-একটা ভাল লাগা বাতাস সারাক্ষণ তার চারপাশে ঘুরপাক খেত। আর দাওয়াখানা চালু করার পর আদ্দির পাঞ্জাবী, আলিগড়ি পায়জামা, রামপুরি টুপি এবং সবচেয়ে বিস্ময়কর খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সুরমা একটু হালকা হয়েছে আর কড়া হয়েছে আতরের ঘ্রাণ। প্রথম ক’দিন দোকানে কাজ করেছে কাঠমিস্ত্রী।
সাদুল্লার সঙ্গে নকিব নয়াবাজার থেকে কাঠ, নবাবপুর থেকে বার্নিশের মাল-মশলা কিনে এনেছে। বার্নিশমিস্ত্রীও সঙ্গে ছিল। ঘরটাকে দুভাগে ভাগ করে বাইরেরটায় কাঁচঢাকা আলমারি, টেবিল-চেয়ার ইত্যাদি দিয়ে সাজিয়ে যখন সবকিছু গোছগাছ প্রায় শেষ, তখনও নকিব বুঝতে পারেনি সে কি করবে- কী হবে তার কাজ। সাদুল্লা এখন হেকিম সাদুল্লাহ। একদিন সকালে হেকিম সাদুল্লাহর সাথে দেখা করতে এল এক ভদ্রলোক।
সাদুল্লা তাকে ডেকে বলল, শোন, এদিকে আয়, এই যে ইনি লক্ষেèৗ হেকিমী দাওয়াখানার ম্যানিজার জনাব মতলব হোসেন গওহরপুরী-
নকিব সসম্মানে সালাম দেয়। কড়া ইস্ত্রিকরা মাখনজিনের সাদা প্যান্ট, তার উপর ফরফর উড়ছে আকাশী রঙ পপলিনের চাইনিজ শার্ট। পায়ে অক্সফোর্ড সু, হাতে ফেবারলুবা ঘড়ির কালো চামড়ার বেল্ট চকচক করছে। মুখে অসাধারণ গাম্ভীর্য আর চোখে তীব্র চাহনি। সম্মান না করে উপায় আছে!
দুদিনের মধ্যে পুরো দোকান আর পেছনের ঘরটাও আমূল বদলে ফেলে ম্যানেজার। নকিব ভেবেছিল, সাদুল্লা পেছনের ঘরটায় তাকে থাকতে বলবে। দেখা গেল সাদুল্লা তার ব্যাপারে একেবারে নির্লিপ্ত। সেই ঘরটাতে লম্বা টেবিলের উপর হামামদিস্তা-টিস্তাসহ নানা রকম যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হল। অন্য হেকিমী দাওয়াখানায় কাজ করে, এমন দুজনকেও বেশি মাহিনায় নিয়ে আসা হলো। ফিটফাট গম্ভীর ম্যানেজার যখন ইয়েস স্যার- ইয়েস স্যার আপলোক যো চ্যাহাতা হ্যায়- বলতে শুরু করল, নকিবের তখন বোধোদয় হল সাদুল্লাহ গাজি এখন আর এতদিনের সাদুমিয়া কিংবা তার সাদু ভাইজান নয়। সাদু ভাইজানের এতদিনকার পুরনো খোলস ছুঁড়ে ফেলে বেরিয়ে এসেছে লক্ষৌফেরত তিব্বিয়া বিশেষজ্ঞ হেকিম মোহাম্মদ সাদুল্লাহ গাজি। সাদু ভাইজানের মধ্যে ভাগলপুরি লুঙ্গি আর পপলিন শার্টের বাবুগিরি ছিল, কিন্তু তার মধ্যে লক্ষৌফেরত এতবড় হেকিম সাহেব ছিলেন এটা কখনো বুঝতে পারেনি নকিব। লোকটা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনায় তার কত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যই না ছিল!
এতদিন বাঙালি কায়দায় মধুপুরের বটিকা তৈরি করেছে, এখন তৈরি করবে লক্ষৌ কায়দায় বাহারি নানা নামের হালুয়াসহ হরকিসিমের ওষুধ। কারখানা-শো-রুমও চালাবে নতুন কায়দায়। ম্যানেজার আর সাদুল্লার কথাবার্তায় এটা বুঝেছে নকিব। সাদুল্লা উর্দু ভাষাটা চমৎকার বলতে পারে, নকিব পারে না। তার জন্য এটা এখন বড় সমস্যা, যদিও কোন যুতসই বা করার মত কোন কাজ সে খুঁজে পায় না। যারা ওষুধ তৈরি করে, তারাই টিনের কৌটায় ভরে স্টিকার লাগায়। নকিব শুধু সেগুলো সামনের শো-রুমে নিয়ে যায়। ম্যানেজার নিজে আলমারির তাকে সাজিয়ে রাখে। নকিব একবার ওষুধ সাজাতে গিয়েছিল, ম্যানেজার উর্দুতে কি সব বলতে বলতে হৈচৈ করে ওঠে। উর্দুভাষী ম্যানেজারের অর্ধেক কথাই সে বুঝতে পারে না। এখন এই সমস্যা নকিবের অস্তিত্বকেই আঘাত করতে শুরু করেছে। তার টিকে থাকা- না থাকা এখন উর্দু জানা না জানার সমতলে এসে ঠেকেছে।
সাদুল্লা একদিন সকালে বলল, দোকানে তো তর কুনু কাম নাই-
সাদুল্লা তাকে বাসার কাজে পাঠাবে, এটা এখন আর তার জন্য কোন অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। কিন্তু অন্যদিনের বলা আর আজকের বলার মধ্যে একটা পার্থক্য কানে বাজল।
অবাক নকিব বলল, তাইলে কি আমি বাসার কাম করতাম?
সাদুল্লা বলল, করবি কি তাইলে? এইখানে তো তর কুনু কাম নাই- তুই তো ম্যানিজারের লগে কথাই কইতে পারস না- কত কইলাম উর্দু ভাষাখান শিইখা ফালা- তুই একখান উজবুক, তরে ক্যামনে বুঝাইবাম, দেশখান পাকিস্তান- উর্দু ছাড়া কথা নাই- বৃন্দাবনে যেমন কানু ছাড়া গীত নাই-
বলতে বলতে অভ্যাসবশে শীষ বাজায়- ও পদ্মার ঢেউরে... আবাসউদ্দিনের এই গান মজমায় গাইতো নকিব। এই গান ছাপিয়ে ওঠছে যে সাদুল্লা, নকিব তাকে চিনতে পারছে না। গত পাঁচ বছরের অন্তরঙ্গ মেলামেশায় অজস্র স্মৃতির অলিগলি হাতড়েও সে এই সাদুল্লাকে যেমন পায় না, তেমনি সেই সাদু ভাইজানকেও নকিব এখন আর কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। নকিব অনেকক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকে। তার চোখে আদি লক্ষেèৗ হেকিমী দাওয়াখানা, সিদ্দিকবাজার, ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন, ঢাকা শহর- সব মাঘের রাত্রির ঘন কুয়াশার মত হয়ে ওঠে, যেখানে জনপদ আর বিরাণ মাঠের কোন ফারাক নেই। কোন দৃশ্য দেখা যায় না। কুয়াশার চাপ চাপ ছাইরঙের মাঝখানে সবই অস্পষ্ট- অস্তিত্ব আছে কি নেই বোঝা যায় না। এক সময় উঠে আলগোছে বেরিয়ে পড়ে নকিব।
সাদুল্লা কি তখন ছিল, ম্যানেজার ছিল? মনে হয় না। নিশ্চয়ই দুপুরের খানা খেতে গেছে বাসায়। নকিব হাঁটতে থাকে এলোমেলো-নির্দিষ্ট কোন গন্তব্য নেই। সামনে ধূসর শূন্যতা। বাবুপুরা বস্তির সামনে এসে দাঁড়ায়- একটা আগ্রহী ফর্সা মুখ-
কৌতুকোজ্জ্বল একজোড়া দীঘল চোখ তার ঘন নীলঠাসা আকাশে বিদ্যুৎ রেখার মত ঝলসে ওঠে-
-ঘোষক সাবেরে একখান কতা কইবার চাই, ভাইসাবে লাইন বদলাইছে, বদলাক কিন্তু অহনো গই-গেরামের গরিব মানুষের কম পয়সার ওষুধ দরকার। আর এই দেশের লতাপাতায়- গাছেমূলে অনেক রোগ-বালাইর শেফা দিছে খোদায়। রাতারাতি আঙুল ফুইলা কলাগাছ না হইবার চাইলে একটা-দুইটা ওষুধ বানাইয়া ঘোষক সাবের মিঠা কতায় হাটে হাটে ক্যানবাস করলে ভালাই চলবো। এই বাংলার মানুষে উর্দু বোঝে না, বাংলাভাষার মিঠাবোল তা’গর পরানে দিবানিশি বাঁশি বাজায়। মানুষরে না ঠকাইলে খোদায় সাহায্য করে- কি কতাখান মিছা কইলাম?
সালমা গত রাতে এই স্বপ্নের ইশারাই তার ভেতর পুঁতে দিয়েছে। সে কী সাদুল্লার এখানে নকিবের ভবিষ্যত বুঝতে পেরেছে? নকিব গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে, না কারোরই কাজ ফুরায় না, হাত-পা আর মাথা ঠিক থাকলে কাজ আছে খোদার দুনিয়ায়। স্বপ্নটা নকিবের মাথায় লকলকিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। সে নিজের ছায়া, সালমার ছায়া- চলমান কর্মমুখরতা দেখতে দেখতে সালমার মায়াভরা দীঘল চোখে তৃপ্তি ও প্রশান্তির একটা ছোট্ট পুকুর দেখল।
এই স্বপ্ন আর গোপন ভাললাগায় আপ্লুত হয়ে নকিব আদি লক্ষেèৗ হেকিমী দাওয়াখানা থেকে বেরিয়ে হাঁটতে থাকল। রেলওয়ে হাসপাতালের সামনে দিয়ে নিমতলি মোড়ে এসে দাঁড়াল। সে কী এখন যাবে সাদুল্লার বাসায় সালমার কাছে! নকিবের ভেতরটা অনেকদিন পর কলকল করে ওঠে। স্বপ্নকে ছুঁয়েছেনে দেখার জন্য ধৈর্য ধারণ করতে হয়।
সে চানখাঁর পুলের দিকে এগোয়। ওখানে ওদের পাশের গ্রামের মোতালেব মিয়ার চা-দোকান। ভাল লোক, তাকেও ভাল জানে। সে-ও নকিবকে আয়-উন্নতির কথা বলে। গিয়ে দেখল, তার দোকান বন্ধ। মেডিক্যালের দিকে যাওয়ার রাস্তায় পুলিশের ব্যারিকেড। গতকাল সন্ধ্যায় অনেকক্ষণ যাবত কী সব আলোচনা করছিল সাদুল্লা আর ম্যানেজার মতলব হোসেন। উর্দুতে সে আলোচনার আগামাথা কিছু বুঝেনি। ছাত্রদের কোন একটা আন্দোলনের ব্যাপার, এটুকু বুঝেছে।
পুলিশের ব্যারিকেটের মধ্যেও দুয়েকজন করে লোক যাচ্ছে ওইদিকে। নকিবও এগোয় তাদের সাথে।
পুলিশ লাঠি দিয়ে ওকে ঠেকিয়ে দিল, আভিলোগ যা স্যাকতা নেহি- হানড্রেড ফোরটি ফোর জারি হ্যায়-
নকিব অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। পুলিশটি বাঙালি, শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে বাংলার বলে, কিহে হা করে দেখছো কী, একশ’ চুয়াল্লিশ ধারা- এক সাথে যেতে পারবে না-
নকিব জানে না একশ’ চুয়াল্লিশ ধারা কি-
গতকালই সে শুনেছে, রাষ্ট্রভাষা নিয়ে আন্দোলন করছে ছাত্ররা- মুখের ভাষা- মায়ের ভাষার জন্য লড়াই চলছে: রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই-
কাল দুপুরে যখন সবাই খেতে গেছে, তখন ওষুধ বানায় যারা, তাদের মধ্যে কম বয়েসী বাঙালি ছেলেটির কথায় সদুল্লা আর ম্যানেজারের কথাবার্তার মানে-মতলব নকিব স্পষ্ট বুঝতে পারে।
ওই ছেলেটি তাকে বলেছে, নকিব তুমি এই যে, কথা কইতাছো মায়ের ভাষায়- বাংলা ভাষায়, এখন তোমারে যদি এই ভাষায় কথা কইতে না দেওয়া হয়- যদি কওয়া হয় যে, কথা কইতে হইবো উর্দু ভাষায়-
নকিব বলেছিল, দূর মিয়া আপনে কি যে কন, এইডা একখান কতা হইলো- মুখের ভাষা নিয়া আপনে ঠাট্টা-মশকরা করতাছেন। এইডা অইলে তো এই দেশের বেবাক মানুষ বোবা অইয়া যাইবো, কেউ কতা কইবার পারবো না-এইডা তো সূর্য পশ্চিমে উঠুনের লাহান কতা-
ছেলেটি বলেছিল, আরে না মশকরা না, এই জন্যই আন্দোলন চলতাছে- ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন করতাছে-
নকিব মনে মনে ভেবেছে, কী তাজ্জব কথা! সাদুল্লা তাকে বলে উর্দু শিখতে। অথচ বাংলা না বললে সাদুল্লার কি আজকের এই উন্নতি হত? নকিবেরই বা কী হবে ভবিষ্যতে-
পুলিশের ব্যারিকেডের সামনে দাঁড়িয়ে সে স্পষ্ট দেখল, সাদুল্লার মেয়ে সকিনার আকুলি-বিকুলি- কথা বলতে না পারায় যন্ত্রণা। যখন কথা বলতে চায়, মেয়েটার মুখের দুপাশ দিয়ে লোল ঝরে, মৃত মানুষের যেমনটা হয়- ছোটবেলায় ফাঁসিতে মরা তাদের গ্রামের জীবন পালকে দেখেছে ঠিক এই রকম লোল- শুকনো কড়কড়ে বালির মত। সকিনার কথা বলতে চাওয়ার আকুতি দেখে নকিবের রাগ হয়-ক্ষোভ জমা হয়। কার বিরুদ্ধে এ রাগ-ক্ষোভ, সে না জানলেও ভেতরে ভেতরে ক্ষোভ তীব্র হচ্ছে-বিস্ফোরণের পূর্ব মুহূর্তে যেমনটা হয়।
এক বাঙালি পুলিশ মেডিক্যালের দিকটা দেখে নিয়ে আরেক পুলিশকে চাপাস্বরে বলল, ছাত্ররা একশ’ চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙতে শুরু করেছে- পরিস্থিতি ভাল মনে হচ্ছে না-
নকিবের চোখে তখন এক সকিনার আকুলি-বিকুলিমাখা মুখের উপর অসংখ্য সকিনার মুখ- লাখো সকিনার মুখ নীরব চিৎকারে আকাশ-বাতাস ফাটিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে- নকিবের কানে তালা লেগে গেল। তার ভেতরের ক্ষোভ আর ক্রোধ তীব্র হয়ে উঠছে। মুহূর্তে সকিনা- ক্ষোভ- মায়ের ভাষা নকিবের চৈতন্যে একই সমতলে স্থিত হয়। লালখতের শাড়িতে জড়ানো লালবানু আর ঢাকাই শাড়িপরা সালমার যত পার্থক্যই থাকুক, তাদের মিঠেকড়া কথার মাধুর্য একইভাবে হৃদয় মথিত করে। হৃদয়ের কথা মেলে ধরার এই ভাষার অতীত রক্ষা করা এবং বর্তমান ও ভবিষ্যত নিরাপদ করার দায়িত্ব দেশের প্রতিটি মানুষের। অস্থির নকিব প্রাণপণে দৌড়াল-
বটতলার সমাবেশ অ্যাসেম্বলি হাউসের দিকে এগোচ্ছে- মিছিল বড় হচ্ছে- গোটা শহর মিছিলের শহর হবে- গোটা দেশ মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের- মিছিলের দেশ হবে- রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই- ধ্বনি আকাশ ছেয়ে ফেলবে-
জমিনে-আকাশে-বাতাসে সব শূন্যতা ভরে উঠছে- ফেটে পড়ছে- নকিব তার ভেতর একটি তরল আকাক্সক্ষামাত্র- অবলীলায় ডিঙিয়ে যায় সে পুলিশের ব্যারিকেড। দ্রুত- আরও দ্রুত দৌড়ায় আকাশে উত্তোলিত মুষ্ঠিবদ্ধ হাজারো হাতের দিকে- মিছিলের দিকে- নকিব নিজের মত বুঝে নিয়েছে, পুলিশ ব্যাটনচার্জ- গুলি যাই করুক, মিছিল ছাড়া মায়ের ভাষায় কথা বলার আর কোন নিরাপদ জায়গা নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন