‘মোদের গরব মোদের আশা
আ মরি বাংলা ভাষা...’
আমার ভাষা, মায়ের ভাষা, বাংলা ভাষা।
জন্মেই মাকে মা বলে ডাকি। মায়ের মুখের ভাষা থেকে বলতে শিখি। মনের কথা ভাষা দিয়ে ব্যক্ত করি। যে ভাষায় আমি সব থেকে ভালো বুঝতে পারি সে আমার মায়ের ভাষা। ভালোবাসি ভালোবাসি মাতৃভাষা ভালোবাসি। সকল ভাষার সেরা ভাষা মাতৃভাষা মাতৃভাষা। ভালোবাসি মাতৃভাষা প্রাণের ভাষা আমার ভাষা।
সকল জাতি, সকল সম্প্রদায় মায়ের ভাষাকে ভালোবাসে। মায়ের ভাষা দিয়ে সব ব্যথা- বেদনা, আশা-আকাক্সক্ষা, চাওয়া-পাওয়া, হাসি-কান্না হৃদয়জুড়ে সবটুকু বলা মায়ের ভাষায়। এর থেকে সুন্দর, এর থেকে মধুর আর কী হতে পারে? মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায় করতে রক্ত দিতে হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষকে।
মা বলে ডাকার অধিকার আমাদের মুখ থেকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। পারেনি কারণ এ ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য রক্ত ঝরাতে হয়েছে, বুকের রক্ত দিয়ে লিখে দিতে হয়েছে মায়ের ভাষায় মাকে মা বলে ডাকব। এ আমার প্রাণের অধিকার। এ আমার অস্তিত্বের অধিকার। আমার জাতিসত্তার অধিকার। ২১ ফেব্রুয়ারি এমনি একটি রক্তঝরা দিন। ১৯৫২ সালে এ দিনে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর আরও কত নাম না জানা ছাত্র-জনতা রক্ত দিয়ে লিখে গেল ভালোবাসি মাতৃভাষা। সে থেকে তো আমরা মাকে মা বলে পরানভরে ডাকতে পারলাম।
এ বিশাল পৃথিবীর এক কোণে বঙ্গোপসাগরের তীরে ছোট একটি ভূখ-ের মানুষ সেদিন কি সাহস দেখিয়েছে। মাতৃভাষাকে ভালোবেসে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে আত্মত্যাগ করেছে, সে কথা স্মরণ করে প্রতি বছর দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে বাংলার দেশপ্রেমিক সন্তানেরা বংশপরস্পরায়। শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না, শহীদ স্মৃতি অমর হোক। না, শহীদের রক্ত বৃথা যায়নি। এ আত্মত্যাগের শিক্ষা নিয়েই তো ভালোবেসেছি দেশকে। লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। পেয়েছি প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। আমার দেশ তোমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ।
শহীদের আত্মত্যাগের স্মৃতি আজ দেশের গ-ি পেরিয়ে গেছে, ছড়িয়ে গেছে বিশ্বময়। বিশ্বসভায় আজ মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবি স্বীকৃতির জন্য। আর এ স্বীকৃতি বাঙালিই প্রথম বুকের রক্ত দিয়ে লিখে দিল তার সাহসের কথা। বাঙালিই প্রথম দেখল এ অর্জনের পথ।
২১ ফেব্রুয়ারি আজ আর শুধু আমাদের একার নয়। সমগ্র বিশ্ব আজ এ দিনটি স্মরণ করবে। ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করবে, স্মরণ করবে এ দিবসের অমর শহীদদের। আবিষ্ট হবে এ দিবসের তাৎপর্য শুনে, শুধুমাত্র মায়ের ভাষাকে বাঁচাতে একটি জাতি কি অসীম ব্যাকুলতা নিয়ে গর্জে উঠেছিল এক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে। বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর যখন ২১ ফেব্রুয়ারি পালিত হবে সকলে অনুপ্রেরণা পাবে, অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখবে বাঙালি জাতি বীরের জাতি, ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে ঠিক যেমন রক্ত দিয়েছিল মেহনতী শ্রমিকদের শ্রমের মূল্য আদায় করতে ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরে। আমরা ১ মে শ্রমিক দিবসে আজও তাদের স্মরণ করি।
‘ওরা আমার মুখের কথা কাইড়া নিতে চায়...।’
১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটো দেশ স্বাধীন হয়। পাকিস্তান নামের দেশটির আবার দুটো খ-। একটি পশ্চিম পাকিস্তান আর একটি পূর্ব পাকিস্তান। দুই ভূখ-ের মাঝে দূরত্ব ১২০০ মাইল। প্রায় ১৮৫২ কিলোমিটার। পূর্ব পাকিস্তান নামের অংশটির অধিবাসী বাংলা ভাষাভাষী, মূল ভূখ-ের নাম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মানুষের মুখের ভাষা বাংলা ভাষা।
পাকিস্তান নামের দেশটির এ পূর্ব খ- অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান নামে প্রদত্ত বাংলার মানুষ তখন গোটা পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৫ ভাগ বাঙালি।
বাংলার মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। আবহাওয়া, জলবায়ু ভিন্ন। পোশাক-পরিচ্ছদ, আহার-বিহার জীবনাচরণ সবই আলাদা। শুধুমাত্র একটিই মিল তা হলো ধর্ম। এ অঞ্চলে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ। শুধুমাত্র ধর্মের নামে ১২০০ মাইল দূরের দুটো ভূখ- নিয়ে একটি দেশ সৃষ্টির প্রচেষ্টা। জন্মলগ্ন থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশটি বৈষম্যের শিকার হতো। ১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের জন্ম হয়। জন্মের পর ছয় মাস পার হবার আগেই শুরু হলো ষড়যন্ত্র। করাচীতে এক শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সে শিক্ষা সম্মেলনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। করাচীর শিক্ষা সম্মেলনের খবর ঢাকায় পৌঁছার সাথে সাথে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১৯৪৭ সালের ৫ ডিসেম্বর চিফ মিনিস্টার খাজা নাজিমুদ্দিনের বাড়ির সামনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিক্ষোভ করে। পুলিশ ও গুন্ডাবাহিনী দিয়ে সে বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করা হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর এটিই প্রথম বিক্ষোভ মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে। ছাত্ররা সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে জিন্নাহর ছবি সরিয়ে ফেলে। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের (বর্তমান বাংলাদেশ ছাত্রলীগ) জন্ম হয়। মাতৃভাষার মর্যাদার সংগ্রাম অব্যাহত রাখার জন্য ছাত্ররা আন্দোলন অব্যাহত রাখে।
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং তমদ্দুন মজলিস নামে অপর সংগঠন একত্রিত হয় মাতৃভাষার দাবিতে আন্দোলন শুরু করার জন্য সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলে।
১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এক ফতোয়া দিলেন যে, উর্দু হলো ইসলামের ভাষা আর হিন্দুদের ভাষা হলো বাংলা, কাজেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা একমাত্র উর্দুই হতে হবে। অথচ পাকিস্তানে আরও অনেক প্রদেশ রয়েছে, ভাষা রয়েছে। পাঞ্জাব দুই খ-ে বিভক্ত, পাকিস্তানে এক অংশ আর ভারতে আরেক অংশ। উভয় খ-তে পাঞ্জাবি ভাষা হিন্দু-মুসলমান সকলেই ব্যবহার করে। উর্দু কোন জাতির মাতৃভাষা নয়। পাঞ্জাবি, সিদ্ধি, পশতু, বেলুচসহ আরও অনেক মাতৃভাষা পাকিস্তানে রয়েছে। আর বাংলা সংখ্যাগরিষ্ঠের মাতৃভাষা। কিন্তু উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করে মাতৃভাষার ওপর চরম আঘাত হানার চেষ্টা বাঙালিরা কোনোমতেই মেনে নিতে পারেনি। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষাকেই যদি রাষ্ট্রভাষা করা হয় তাহলে সমগ্র পাকিস্তানে বাংলাই হতো রাষ্ট্রভাষা। অথচ যে ভাষায় মাকে মা বলে ডাকি, যে ভাষায় কথা বলি, সে ভাষা কেড়ে নেওয়ার এক নির্মম ষড়যন্ত্র শুরু হলো। এ ষড়যন্ত্র বাঙলিরা কোনদিনই মেনে নিতে পারে না। মেনে নেবে না। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালি বদ্ধপরিকর।
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন আইন পরিষদে ঘোষণা দেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেব মেনে নেবে। বাংলার মানুষ এ ঘোষণায় বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে। খাজা নাজিমুদ্দিনের বিরুদ্ধে মানুষের বিক্ষোভ সারা দেশে জড়িয়ে পড়ে। মুসলিম লীগ সরকারের এ হীন চক্রান্তের বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অগ্রণী ভূমিকা নেন। ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। ২ মার্চ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীদের এক বৈঠক হয়। এ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় ফজলুল হক মুসলিম হলে। এ বৈঠক সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন হয়। এ প্রস্তাব দিয়েছিলেন শেখ মুজিব।
সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ বাংলার জনগণকে মুসলিম লীগ সরকারের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সজাগ করার জন্য প্রচারাভিযান শুরু করে। বিভিন্ন অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গণসংযোগ করতে থাকে। ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। বাঙালির বিরুদ্ধে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে চক্রান্তকে রুখে দাঁড়াবার জন্য এ ধর্মঘট। ১১ মার্চের ধর্মঘটের দিনে ছাত্ররা সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ঐ বিক্ষোভে বঙ্গবন্ধুসহ অনেক ছাত্রকে গ্রেপ্তার করানো হয়। এ গ্রেপ্তার যেন আগুনে ঘৃতাহুতি। বাংলাদেশের সমস্ত ছাত্র যখন জানতে পারে ঢাকায় ছাত্রদের গ্রেপ্তার করানো হয়েছে, বিক্ষোভে তারা রাস্তায় নামে। প্রবল আন্দোলন গড়ে ওঠে। আন্দোলনের চাপে ১৫ মার্চ বন্দিদের মুসলিম লীগ সরকার মুক্তি দেয়।
জনাব নাজিমুদ্দিন তখন পূর্ব পাকিস্তানের চিফ মিনিস্টার। তিনি সমঝোতার উদ্যোগ নেন। ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলোচনা করেন ১৫ মার্চ। সংগ্রাম পরিষদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ঘোষণা দেন যে, পূর্ব পাকিস্তান আইন সভায় প্রস্তাব পাশ কর হয় যে বাংলা ভাষা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হবে। এ ঘোষণার পর সকল ছাত্রবন্দিকে মুক্তি দেওয়া হবে এবং পুলিশের হামলার তদন্ত করা হবে। এ সমঝোতার সকল বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ সকল বন্দি মুক্তি পান ১৫ মার্চ সন্ধ্যায়।
১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্রসভা হয় (আমতলা বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজের দক্ষিণে নতুন এক্সটেনশন বিল্ডিংয়ে) ১৬ মার্চের ভাষার দাবিতে যে সভা হয় সে সভায় সভাপতিত্ব করেন ছাত্র নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। সকালে এ সভা শেষ হয়। ঐদিন বিকেলে আইন সভার অধিবেশন বসে। তখন সংসদ ভবন ছিল বর্তমান জগন্নাথ হল যে স্থানে সেখানে। সেখানে ছাত্ররা জমায়েত হয় কিন্তু সেখানে আবার পুলিশ লাঠিচার্জ করে ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে। ছাত্ররা ক্ষেপে যায় জনাব নাজিমুদ্দীনের ওপর এবং প্রতিবাদ জানায় এ অত্যাচারের। তারা নাজিমুদ্দীনের তদন্ত প্রস্তাব নাকচ করে দেয় এবং পুলিশ নির্যাতনের বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে।
আমাদের সময়ে সকল আন্দোলনের পীঠস্থান যেমন ছিল বটতলা। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন-সংগ্রাম-মিটিংয়ের জায়গা ছিল আমতলা। বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বহির্বিভাগ যেখানে ঠিক সে স্থানে। সে আমতলায় ১৬ মার্চ সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ছাত্র সভার আয়োজন করা হয়। ছাত্রদের সাথে জনতাও এসে যোগদান করে। পুলিশ সেখানে প্রবল বাধা সৃষ্টি করে। বাধার মুখে শেখ মুজিবের সভাপতিত্বে জনসভা শুরু হলে পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ারগ্যাস মেরে সভায় হামলা চালায়। সে হামলার প্রতিবাদে ১৭ মার্চ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন করা হয়। আন্দোলনে নতুন গতি পায়।
১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে ঢাকায় এলেন।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর তার প্রথম সফর এ ভূখ-ে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে। তাকে বলা হতো ‘কায়েদে আযম’ অর্থাৎ পাকিস্তানের জাতির জনক। সেই পাকিস্তানের জাতির জনক পাকিস্তানের এ ভূখ-ে এলে তাকে বিক্ষোভের সম্মুখীন হতে হয়। জিন্নাহকে সংবর্ধনা দেবার জন্য তৎকালীন রেসকোর্স (বর্তামান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে এক সভা হয়। বিশাল জনসভা, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে জনগণ এসেছে কায়েদে আযম অর্থাৎ জাতির পিতাকে দেখতে, তার কথা শুনতে। কিন্তু সে জনসভায় তিনি ঘোষণা দিলেন ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ আর তখনই ছাত্ররা জনসভার মধ্যেই প্রতিবাদ করল। জনসভায় এ প্রতিবাদ শুনে তিনি একদম চুপ হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ বক্তৃতা বন্ধ করে রাখলেন। এ প্রসঙ্গে আর কোনো কথা বলেননি। এরপর তিনি সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যাত্রা শুরু করেন। অবশ্য পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে তাদের সেখান থেকে জোর করে সরিয়ে নিয়ে যায় এবং বন্দি করে রাখে যতক্ষণ সমাবর্তন শেষ না হয়। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ‘উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’, এ কথা ইংরেজি ভাষায় পুনর্ব্যক্ত করার সাথে সাথে সমাবর্তনের উপস্থিত ছাত্ররা নো নো বলে প্রতিবাদ জানায়। ভাষার অধিকার আদায়ের আন্দোলন অব্যাহত রইল। ১১ মার্চ এরপর থেকে ‘ভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হতে থাকল প্রতিবছর। তার এ ঘোষণায় সারা বাংলাদেশ বিক্ষোভে ফুঁসতে থাকে। বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন করল কয়েকজন ছাত্র।
১১ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুকে ফরিদপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুক্তি পান। মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন তীব্র করার জন্য ২৩ জুন গঠন করা হয় বাংলাদেশ আওয়ামী মুসলিম লীগ। আওয়ামী শব্দের অর্থ জনগণ। মুসলিম লীগকে সমাজের উঁচু শ্রেণীর দল হিসেবে চিহ্নিত করে। জনগণের সংগঠন হিসেবে জন্ম নিল আওয়ামী মুসলিম লীগ। পরবর্তীতে এ দলকে অসাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়ার জন্য ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নাম দেওয়া হয়। ভাষার দাবি এবং চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দাবি আদায়ের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান ধর্মঘট করার সময় বঙ্গবন্ধু ১৯ এপ্রিল আবার গ্রেপ্তার হন। জুলাই মাসের শেষে তিনি মুক্তি পান।
এদিকে পূর্ব পাকিস্তানে তখন অর্থনৈতিক সংকট এবং প্রচ- খাদ্য ঘাটতি ব্যাপকভাবে দেখা দেয়। দেশে দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজমান অথচ মুসলিম লীগ সরকারের সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। দেশের এ বিরাজমান খাদ্য ঘাটতির বিরুদ্ধে খাদ্যের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলন চলাকালীন সময়ে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। বঙ্গবন্ধু ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন। ফলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তিনি মুক্তি পান।
১১ অক্টোবর নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় নুরুল আমীনের পদত্যাগ দাবি করে প্রস্তাব করা হয়। আন্দোলনকে আরও বেগবান করার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়।
খাদ্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করে বলে খাদ্যের দাবিতে আর্মানীটোলা ময়দানে জনসভা ও ভুখা মিছিল বের করে আওয়ামী মুসলিম লীগ। এ মিছিল থেকে ১৪ অক্টোবর মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুসহ অন্য নেতারা গ্রেপ্তার হন। পরে শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর ঘাতকের হাতে নিহত হন। খাজা নাজিমুদ্দিন রাষ্ট্রপ্রধান হন। পর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। এ ঘোষণায় মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে জেলখানা থেকে বঙ্গবন্ধু যোগাযোগ করলেন। জেলে তখন বন্দি শেখ মুজিব। ঢাকা মেডিকেল কলেজে বন্দি অবস্থায় চিকিৎসার জন্য তাকে আনা হয় যখন এ ঘোষণা হয়। মেডিকেল কলেজে অন্য নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাৎ ও পরামর্শ করার সুযোগ পান। গভীর রাতে গোপনে মিটিং হয়। আন্দোলনকে জোরদার করার পরিকল্পনা নেওয়া হায়।
বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা ও বন্দি মুক্তির দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারি ‘দাবি দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। ৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু অনশন করার সিদ্ধান্ত নিলেন। মহিউদ্দিন আহমদ তার সঙ্গী হলেন।
যেহেতু ঢাকায় থাকলে, ছাত্রদের সঙ্গে এবং নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পরামর্শ করার সুযোগ পান তাই তাকে ঢাকা থেকে ফরিদপুর জেলে স্থানান্তর করা হয়। ঢাকা থেকে ফরিদপুর যেতে হলে স্টিমারে যেতে হতো, ষ্টীমার ছাড়ত নারায়ণগঞ্জ থেকে। নারায়ণগঞ্জ ষ্টীমার ঘাটে অনেক নেতা অপেক্ষা করে থাকেন তাঁর সাথে দেখা করার জন্য। সেখানেও তিনি ২১ ফেব্রুয়ারি কর্মসূচি সফল করার নির্দেশ দেন। সকলকে কাজ করার জন্য নেমে পড়তে বলেন।
১৪ ফেব্রুয়ারি তিনি অনশন শুরু করেন এবং ১৬ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসার জন্য আনা হয়। সেখানে বসেই তিনি সিদ্ধান্ত দিলেন ১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাথে যোগাযোগ রাখার দায়ে বঙ্গবন্ধুকে অনশনরত অবস্থায় ফরিদপুর জেলে প্রেরণ করা হলো।
২১ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৪টায় ছাত্রদের মিছিলের ওপর মুসলিম লীগ সরকার গুলি চালালে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার লুটিয়ে পড়ল কালো পিচঢালা পথে। তারা রক্তের অক্ষরে মায়ের ভাষায় মাকে মা বলে ডাকার দাবি জানিয়ে গেল। সে থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি প্রতিবছর ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে পালিত হয়।
আমি ও কামাল খুব ছোট। আব্বা প্রায় আড়াই বছর ধরে বন্দি, তারপরও খুব অসুস্থ অবস্থায় অনশন করছেন। দাদা এ খবর পেয়ে আমাদের নিয়ে ঢাকায় রওনা হলেন নৌকায় করে। বেশ বড় নৌকায় আমরা দুই ভাইবোন হেঁটে চলে বেড়াতে পারি। দুইখানা কামরা নৌকায়। টুঙ্গীপাড়া থেকে রওনা হয়ে পদ্মা, মেঘনা, আড়িয়ালখাঁ পাড়ি দিয়ে চারদিনে ঢাকা এসে পৌঁছেছি। তিন মাল্লার নৌকা তাই বেশ তাড়াতাড়ি এসেছি। আজিমপুর কলোনিতে আমার দাদার ছোট ভাই থাকতেন তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে, আমরা সেখানে উঠলাম। ২১ ফেব্রুয়ারির দিন আমি তখন ঢাকায় ছিলাম, তবে এত ছোট ছিলাম যে, সব স্মৃতি এখন মনে নেই। রাতে কার্ফু, সংগ্রাম পরিষদ ধর্মঘট ডেকেছে। আজিমপুর কলোনিতে এসে মুখে চোঙা লাগিয়ে কেউ যাতে অফিসে না যায় তার জন্য আহ্বান করত, আর সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ এসে ধাওয়া করত। ঘরের ভেতর এক রকম বন্দি থাকতে হয়েছে। পরের দিন আব্বার খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল তাঁকে ফরিদপুর জেলে নিয়ে গেছে। দাদা ষ্টিমারে মা, দাদী, কামাল ও আমাকে দেশের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। আর দাদা গেলেন ফরিদপুরে। আব্বাকে ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে মুক্তি দেওয়া হলো। অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় দাদা আব্বাকে বাড়ি নিয়ে এলেন। দীর্ঘদিন অনশনে থেকে শরীরের যে ক্ষতি হয়েছিল তা সারিয়ে তুলতে তিন মাস সময় লেগেছিল। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে ঢাকায় আসেন।
১৯৪৮ সাল থেকে যে আন্দোলন শুরু ১৯৫২ সালে এসে সে আন্দোলন সফলতা অর্জন করে। ভাষা আন্দোলনে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের অবদানই সব থেকে বেশি। প্রগতিশীল ছাত্রসমাজও এ আন্দোলনে যথেষ্ট অবদান রাকে। আজ যদি বাংলার মানুষের ভাষার আন্দোলন না হতো আমরা মাতৃভাষায় কথা বলতে পারতাম না।
১৯৫৪ সালে নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়। শেরে বাংলা এ,কে, ফজলুল হক, আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচন করে জয়ী হয়। ১৯৫৫ সালে নতুন কেন্দ্রীয় আইন সভা গঠিত হয়। সেখানে আওয়ামী লীগের ১২ সদস্য নতুন শাসনতন্ত্রে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উল্লেখ করার জন্য সংসদে সংগ্রাম শুরু করে এবং চাপ অব্যাহত রাখে। ফলে ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে উর্দু ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন জয়ী হলেও বার বার ষড়যন্ত্র হতে থাকে এবং স্থায়ী সরকার গঠন হতে পারে না, ভাঙ্গাগড়ার খেলা চলতেই থাকে। ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হন। শেখ মুজিব তখন মন্ত্রী হন।
আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেই ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং ঐদিন সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেই থেকে আজও ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও সরকারি ছুটির দিন হিসেবে বাংলার মানুষ পালন করে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকার শহীদ মিনার নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। প্রকল্প গ্রহণ করে বাজেটে টাকা ধার্য করে। শহীদ মিনার নির্মাণ কাজ শুরু করে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে বাংলার মানুষের কপালে কোনো সুখ স্থায়ী হয় না।
১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে মার্শাল ল’ জারি হয়। জনগণের নির্বাচিত সরকার উৎখাত হয় এবং নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করা হয়। শহীদ মিনারের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ২১ ফেব্রুয়ারি ছুটির দিন বাতিল করে দেওয়া হয। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। আবার দীর্ঘ আন্দোলন ৬ দফা, ১১ দফা, ১৯৭০ নির্বাচন, ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন, স্বাধীন জাতি হিসেবে মর্যাদা লাভ সবই রক্তের মধ্যদিয়ে অর্জন করতে হয়েছে। তারপরও কি ষড়যন্ত্র থেমে থেকেছে? ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ২১ ফেব্রুয়ারিকে সরকারি শহীদ দিবস পালন করে।
১৯৭৫ সালে ঘাতকের দল জাতির পিতাকে সপরিচারে হত্যা, সামরিক শাসন জারি, একটির পর একটি সামরিক ক্যু, রক্তপাত, ভোটের অধিকার হরণ, গণতন্ত্র নির্বাসন।
আবার সংগ্রাম, আন্দোলন, রক্তদান গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে বিজয় অর্জন করে জনগণের ভোটে আওয়ামী লীগের বিজয়। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
মহান ভাষা আন্দোলনে যে অবদান বাঙালি জাতি রেখেছিল তা আজ সমগ্র বিশ্ব শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছে। এ আমাদের গৌরবের অহঙ্কারের দিন। এদিন হৃদয়ে ঝরে রক্তক্ষরণের বেদনা আর গর্বে ভরা বিচিত্র অনুভূতি শুধু বাংলার সীমানায় আবদ্ধ নয় আজ বিশ্বব্যাপী ব্যাপৃত।
২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের মহৎ অর্জন। এ অর্জনের পেছনে রয়েছে কত আত্মত্যাগ। অনেক অত্যাচার নির্যাতন স্বীকার করে রক্তের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি ভাষার মর্যাদা। আর এ ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই পেয়েছি স্বাধীনতা।
কানাডায় প্রবাসী কয়েকজন বাঙালি এবং কিছু বিদেশি মিলে মাতৃভাষার প্রেমিক গোষ্ঠী নামে একটি সংগঠন করে। এ সংগঠন প্রথম জাতিসংঘের মহাসচিবের নিকট ‘আন্তর্জাকি মাতৃভাষা দিবস’ নামে একটি দিবস ঘোষণার প্রস্তাব পাঠায়। চিঠির উত্তরে মহাসচিব জানান, কোনো প্রতিষ্ঠান নয় জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত কোনো দেশের কাছ থেকে প্রস্তাব এলে তারা বিবেচনা করতে পারে।
কানাডা থেকে শিক্ষা মন্ত্রনালয়য়ে বিষয়টি জানানো হয়। ১৯৯৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আমাকে ফোনে শিক্ষামন্ত্রী বিষয়টি জানান এবং প্রস্তাব পাঠাতে পারি কিনা তা জানতে চান। আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাব পাঠাতে বলি। প্রস্তাবে ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে বাঙালির আত্মত্যাগের কথা উল্লেখ করা হয়। ১০ সেপ্টেম্বর ছিল প্রস্তাব পাঠাবার শেষ দিন। কাজেই অতি দ্রুত শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ প্রস্তাব ইউনেস্কোতে প্রেরণ করে।
১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হয় আমেরিকার শিকাগো শহরে শ্রমিক বিদ্রোহের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। শ্রমিকরা শ্রমের মূল্য আদায়ের জন্য জীবন দান করেছিল। সারাবিশ্ব সে দিবসটি পালন করে। শিক্ষামন্ত্রীকে এ বিষয়টি উল্লেখ করার কথাও বলি। ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সদস্যপদ প্রাপ্তির ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে নিউইয়র্ক যাই। জাতিসংঘ রজতজয়ন্তী উদযাপন করি। জাতিসংঘের মহাসচিব এবং অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধানদের সাথে সাক্ষাৎ হয় এবং মহাসচিবের দেওয়া মধ্যাহ্নভোজে শরিক হই।
জাতিংসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রধানদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ হয়। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বাঙালি জাতির অবদানের কথা বিশেষভাবে তুলে ধরি। মাতৃভাষাকে আমরা কত ভালোবাসি তা গর্বভরে উল্লেখ করি।
নিউইয়র্ক থেকে আমি প্যারিস যাই ইউনেস্কো কর্তৃক শান্তি পুরস্কার গ্রহনের জন্য। ২৪ সেপ্টেম্বর আমাকে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। ইউনেস্কোর প্রধানের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে আন্তর্জঅতিক মাতৃভাসা দিবসের বিষয়ে আলোচনা করি। ২১ ফেব্রুয়ারির কথাও উল্লেখ করি।
ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ সম্মেলনে সর্বসম্মতিভাবে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ও কর্মকর্তারা এবং প্যারিসের রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসের কর্মকর্তা যথেষ্ট পরিশ্রম করেন। ১৭ নভেম্বর এ প্রস্তাব গৃহীত হয়। পৃথিবীতে অসংখ্য জাতি। ছয় হাজারের বেশি মাতৃভাষা রয়েছে। সঠিক সংখ্যাটি এখনও জানা যায়নি। অনেক ভাষা হারিয়ে গেছে। জীবন-জীবিকার খোঁজে মানুষ তার সুবিধামতো অবস্থান নেয় বা নিতে বাধ্য হয়। ফলে সহজে যোগাযোগের মাধ্যমে খুঁজে নেয়। আর তাই হারিয়ে যায় মাতৃভাষা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা হওয়াতে আর মাতৃভাষা হারিয়ে যাবে না, অন্তত অস্তিত্ব খুঁজে বের করা যাবে। সংরক্ষণ করা হবে, গবেষণা করা হবে।
বাংলা ভাষা আমাদের মাত্রভাষা।
অনেক ক্ষেত্রে আমরা দেখি ছেলেমেয়েদের নিজের ভাষা না শিখিয়ে ইংরেজি ভাষা আমাদের জন্য খুবই প্রয়োজন, বিশেষ করে জীবন-জীবিকার জন্য এ দুটো ভাষার প্রয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি অন্য ভাষাও শিখতে পারি কিন্তু তা অবশ্যই মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে নয়।
ঢাকা শহরে গুলশান, বারিধারা, বনানীতে ইদানীং দেখা যায় ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল। বাংলা শিক্ষা একেবারেই দেওয়া হয় না। প্রতিটি স্কুলে মাতৃভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা অবশ্যই রাখতে হবে। এবিষয়ে ইতোমধ্যেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। আর একটি বিষয় আমাকে খুবই পীড়া দেয়। সেটি হলো ইংরেজি একসেন্টে বাংলা বলা।
অর্থশালী, সম্পদশালী পরিবারের ছেলেমেয়েদের মধ্যে এ প্রবণতা একটু বেশি দেখা যাচ্ছে। আর যদি হঠাৎ পয়সাওয়ালা হয় তা হলে তো কথাই নেই। মনে হয় বাংলা বলতে যেন খুবই কষ্ট হচ্ছে।
এ প্রবণতা কেন? নিজেদের দৈন্যতা ঢাকার জন্য? না কি যেখানে মৌলিকত্বের অভাব সেখানে শূন্যতা ঢাকার প্রচেষ্টা? অভিভাবক, শিক্ষাক, বিশেষ করে পিতা-মাতাকে এ বিষয়ে নজর দিতে হবে। বিদেশে বসবাসরত পরিবারগুলো ঘরে বসে বাচ্চাদের সাথে ইংরেজি বলেন। ফলে বাচ্চাদের মাতৃভাষা শেখার আর কোনো সুযোগই থাকে না। দিনের অধিকাংম সময় বাচ্চারা স্কুলে কাটায়। কাজেই যে দেশে থাকে বা যে ভাষায় শিক্ষা নেয় সে ভাষা সহজেই নেয়। ঘরে এসে যদি মাতৃভাষায় কথা না বলা হয় তাহলে তো মাতৃভাষা শিখবেই না।
বাচ্চাদের জীবনে মাতৃভাষা ব্যবহার করাই প্রয়োজন। বাচ্চারা ভাষা খুবই তাড়াতাড়ি রপ্ত করতে পারে। এমনকি একই সঙ্গে অনেকগুলো ভাষা তারা শিখে ফেলে। ওদের কিন্তু তেমন অসুবিধা হয় না।
আমরা বাঙালি, বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা। ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি। স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘদিন সংগ্রাম করেছি। রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আমাদের মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় প্রথম ভাষণ দিয়েছিলেন ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। বিশ্বসভায় বাংলা ভাষা মর্যাদা পেয়েছিল। বাংলা ভাষায় কাব্য রচনা করেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন। পৃথিবীতে যত ভাষাভাষী রয়েছে বাঙালি জনসংখ্যার দিক দিতে সপ্তম স্থান অধিকার করে আছে। কাজেই আমাদের ভাষা অত্যন্ত ঐতিহ্যবাহী। আমাদের ভাষার চর্চা বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশে আমরা মাতৃভাষা চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করব। এ গবেষণা কেন্দ্রে পৃথিবীর সকল মাতৃভাষা সংগ্রহ করা হবে। মাতৃভাষা উৎকর্ষ সাধনে গবেষণা করা হবে। বিভিন্ন ভাষা শিক্ষারও ব্যবস্থা রাখা হবে। বাংলাদেশের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। পৃথিবীর (১৮৮) একশত আটাশিটা দেশ এখন থেকে মাতৃভাষা দিবস পালন করবে। এ দিবস পালনকালে বাংলাদেশের ভাসা শহীদ রফিক, জব্বার, বরকত, শফিউর, সালামের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ আজ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। আমাদের সকলের দায়িত্ব বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নতি সাধনে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস গ্রহণ করা। বাংলাদেশ শিক্ষায়-দীক্ষায়, জ্ঞানগরিমায় উন্নত হবে। অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করে ক্ষুধামুক্ত, শোষণমুক্ত সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে উঠবে।
আমাদের আরও যত্মবান হতে হবে আমাদের ভাষাকে বিকশিত করার জন্য, চর্চা করার জন্য। মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করে যত সুন্দর সহজভাবে বিষয়টি আমরা বুঝতে পারি অন্য কোনো বিজাতীয় ভাষায় কি তা আমরা বুঝতে পারি? শিক্ষার মাধ্যম বাংলা হতে হবে এবং সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার চর্চা করতে হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আমাদের যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনে অন্য ভাষাও শিখতে হবে।
তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে ছোট হয়ে আসছে বিশ্ব; তাই মানুষে মানুষে যোগাযোগও বেড়েছে। জীবন-জীবিকার অন্বেষণে মানুষ ছুটে যাচ্ছে দেশে-বিএদশে। তাই মাতৃভাষার পাশাপাশি অন্য ভাষার প্রয়োজন আমরা স্বীকার করি, তার প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে কিন্তু তা মাতৃভাষাকে ভুলে নয়। রক্তে কেনা আমাদের মাতৃভাষা, এ ভাষার চর্চার জন্য আমাদের সকলকে যত্মবান হতে হবে। আন্তরিক হতে হবে। বিশ^স্বীকৃতি পাওয়ার পর আমাদের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। যে মর্যাদা আজ বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ পেয়েছে সে মর্যাদা সমুন্নত রাখার জন্য আমাদের সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস চালাতে হবে। [ঈষৎ সংক্ষেপিত]
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন