রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

মহান একুশে সংখ্যা

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলার অপপ্রয়োগ

মোহাম্মদ অংকন | প্রকাশের সময় : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

বাংলা ভাষা হলো বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ভাষাগুলোর একটি। বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা বাড়ছে, ক্রমশ বাড়ছে বাংলা ভাষার ব্যবহারও। বাংলা ভাষা শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, প্রবাসী বাঙালি ও আন্তরাষ্ট্রীয় সর্ম্পক উন্নয়নের মাধ্যমে এটি এখন সবিস্তারে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। পৃথিবীর ক্ষুদ্র রাষ্ট্র সিয়েরা লিওন বাংলা ভাষাকে তাদের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। উপমহাদেশ থেকে বাংলা ভাষা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে তার একটা শক্ত অবস্থান শুরু থেকেই তৈরি করার প্রয়াসে আগাচ্ছে। জাতিসংঘের অধিবেশনে ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন বাঙালি হিসেবে প্রথম বাংলায় ভাষণ প্রদানের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিকীকরণের যে শুভ যাত্রা করে দেন, সেটার প্রভাব এখন সুবিস্তৃত এবং অন্যান্য ভাষার মতো বাংলা ভাষাও তার গৌরজ্জ্বল প্রসারে এগিয়ে।
পৃথিবীতে বাঙালিই একমাত্র জাতি যারা কিনা মাতৃভাষার জন্য রাজপথে মিছিলে নেমে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছে। বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) রাষ্ট্রভাষাকরণেই শুধু নয়, টিকিয়ে রাখতেও দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম করতে হয়েছে। সেই সময়ের ঘটনাক্রমে ২১ ফেব্রুয়ারি বর্তমানে মহান শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হয় এবং পরবর্তীতে এটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি এবং ২০১০ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ‘এখন থেকে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মার্তৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হবে’ প্রস্তাবনাটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হওয়ার মাধ্যমে বাংলা ভাষার মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয় যা বাঙালির বিরাট অর্জন। সেই বাংলা ভাষার মর্যাদা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তার মানদ- কতটা সুউচ্চ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমানে বাংলা ভাষা কি আগের মতো তার স্বকীয়তা ধরে রাখতে পারছে? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দিকে নজর দিলে বাংলা ভাষার যে অপ্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়, তা অবিশ্বাস্য ও অপ্রত্যাশিত।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তথ্য-প্রযুক্তি বিপ্লবের একটা বিরাট অংশ ও অবদান। সেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাকে যথেচ্ছ ব্যবহারের মাধ্যমে ধ্বংস করা হচ্ছে। এটাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন পরিক্রমায় বাংলা ভাষাকে খুবই তুচ্ছতাচ্ছিল্যভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আরও গভীরে গিয়ে বলতে গেলে, তথ্য-প্রযুক্তি ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। লেখ্যভাষায় এটিকে বিকৃতকরণ করা হচ্ছে যথেচ্ছভাবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে বাংলার যে বিকৃত রূপ চোখে পড়ছে, তা যে বাংলা ভাষার লেখ্যরূপের নির্ঘাত অপমৃত্যু, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা মনের ভাব প্রকাশ করতে গিয়ে ইংরেজি অক্ষরে বাংলা ভাষাকে উপস্থাপন করছে, যাকে আমরা ‘বাংলিশ’ বলছি। হয়তো প্রশ্ন হতে পারে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কীভাবে বাংলা লেখা হচ্ছে, তা মুখ্য বিষয় না, এতে প্রযুক্তির বিস্তারকেও দোষারোপ করার সুযোগ দেখছি না। কথা হচ্ছে, এটার প্রভাব দাপ্তরিক ও ব্যবহারিক ক্ষেত্রেও পড়তে শুরু করেছে। তা কি আমরা খেয়াল করছি?
আমরা মানুষ হিসেবে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি যেটা রোজ চর্চা করি, সেটা ভুল না কি সঠিক, তা যাচাই করি না। আমরা যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলা ভাষাকে ইংরেজি অক্ষরে লিখছি, কিংবা একটা বাক্যে দশটা শব্দের মধ্যে অধিকাংশ বিদেশি শব্দের প্রয়োগ করে লিখছি, তখনই এর প্রভাব ব্যবহারিক নানা কাজে পড়ছে। যে ব্যক্তি চাকরি করে, দেখা হচ্ছে, অফিসের কোনো কাজের ক্ষেত্রেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মতো করে ভাষার প্রয়োগ করছে। নিঃসন্দেহে এটি তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাকে অবাধ বিকৃত করার ফলাফল। কিন্তু এর প্রতিরোধে আমরা কিছুই করতে পারছি না। এসব অমার্জিত ভাষার প্রয়োগ ক্রমশ সবখানে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে। ভাষার মানহীনতাই যেন এখন ভাষার মানদ-। এভাবেই তো সঠিক, ওভাবেই তো আগেরজন লিখেছেন- এমন অপরীক্ষিত বাক্যের মাধ্যমে বাংলা ভাষা তার আসল রূপকে হারাতে বসেছে।
তথ্য-প্রযুক্তির বদৌলতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রসার হওয়া মানে আমাদের বাংলা ভাষাকে আরও সুচারুরূপে উপস্থাপনের এক মোক্ষম মাধ্যম ও সুযোগ। এসব মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে যখন সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হবে, তখন তা যেমন ইংরেজি বা অন্যান্য ভাষার সাথে প্রতিযোগিতা করে প্রতিষ্ঠিত হবে, তেমনই আধুনিকায়নও হবে, বহুল চর্চা হবে। প্রযুক্তির মানুষ হিসেবে আমি বিশ্বাস করি, বাংলা ভাষা আধুনিক প্রযুক্তিতে এতটাই উৎকর্ষ হবে যে, কম্পিউটারের বিভিন্ন প্রোগ্রামও একটা সময় বাংলা ভাষায় লেখা সম্ভব হবে। ইংরেজি ভাষায় যদি ‘প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ’ তৈরি করা সম্ভব হয়, বাংলায় করতে অসুবিধা কোথায়? আমরা কি বাংলা ভাষায় লিখে গাণিতিক সমাধান করছি না?
বাংলা ভাষায় আমরা যতটা সহজে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি, বাঙালি হিসেবে অন্যকোনো ভাষায় তা কোনোভাবেই প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আর সেই ভাষাকেই কিনা আমরা বিকৃতভাবে উপস্থাপন করছি। বাংলা ভুল বানান লেখার যে প্রণবতা সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে চোখে পড়ে, সে কথা বলতে গেলে কোনো সমাধান তো আসবেই না বরং বিতর্কের জন্ম নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কি শুধু শিক্ষিতরাই ব্যবহার করে যে তারা তাদের মনের ভাব প্রকাশে যা লিখবে তা বাংলা ব্যাকরণ মেনে লিখবে? প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক হলেও এটাও সত্য যে, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই এই মাধ্যমে সরব হওয়ায় একটা জগাখিচুড়ি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তাই কেউই আর ভেবে দেখছে না আমি যা লিখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছাড়ছি, তা পরীক্ষিত কিনা। সবাইকে শুদ্ধ ভাষা ব্যবহার করেই মনের ভাব প্রকাশ করতে হবে, সেজন্য জোর দিচ্ছি না; তবে সচেতন হতে বলছি। কেননা, যেকোনো কিছুরই নেতিবাচক বিষয়গুলো দ্রুত ছড়ায়। কেউ ধুমপান করা শুরু করবে, দেখা যাবে সে দ্রুত এটার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে। কেননা, এটি নেতিবাচক বিষয়। বাংলা ভাষাকে ‘বাংলিশ’ রূপে উপস্থাপনের প্রভাবটাও তেমনই নেতিবাচক বিষয়।
বাংলা ভাষাকে রক্ষাকারী হিসেবে লেখক-সমাজকে অগ্রগণ্য মনে করা হয়। কিন্তু বর্তমানে কিছু লেখক (মূলত অলেখক, বিভিন্ন উদ্ভট কর্মকা- বা বিতর্কিত বিষয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে বই লিখে বাজার ধরে রাখার চেষ্টায় উচ্চ শ্রেণির মানুষ সাজছে। তাদের ভাবনা, লেখক মানেই সমাজে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি) তাদের বইয়ের উদ্ভট সব ‘বাংলিশ’ নামকরণ করে পাঠককে (মূলত অপাঠক। ওরা বই পড়ে না। কথিত সেলেব্রেটির সাথে ছবি তুলতে, অটোগ্রাফ নিতে ভিড় করে; এটাই লক্ষ্য বটে, বই পড়া নয়) আকৃষ্ট করছে। তাদের সেসব বই খুললেই দেখা যাচ্ছে, বাংলা, ইংরেজি, হিন্দিসহ নানান ভাষায় মনগড়া কথা লেখা যা থেকে প্রভাবিত হচ্ছে অধিকাংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবকারী।
তথ্য-প্রযুক্তি ও সংবাদমাধ্যমের বদৌলতে বাংলা ভাষার ব্যবহার বহুগুণ বেড়েছে। কিন্তু বাড়েনি শুদ্ধাচার ও সঠিক প্রয়োগ। ভুল বানানের পাশাপাশি বাক্যে ভাষার মিশ্রণ ও ভিন্ন বর্ণে বাংলাকে উপস্থাপন করা যেন বাংলা ভাষার মহামারীকরণ ছাড়া কিছু নয়। রমজান মাস আসলে আমরা যেমন কিছু মানুষ ইবাদত-বন্দেগিতে মনোনিবেশ করি, আর বাকি এগারো মাস ইবাদাতের ধারে-কাছেও ভিড়ি না; ঠিক তেমনটাই ফেব্রুয়ারি মাস আসলে বাংলা ভাষা রক্ষার বিষয়ে আমরা সরব হই, বাকি এগারো মাস নিজেরাও ভুল প্রয়োগ করে চলি বলেই বাংলা ভাষা তার প্রকৃত অভিভাবক হারাচ্ছে। তাই সবখানে বাংলার আসল রূপ বিকৃত হয়ে ‘বাংলিশ’ হতে চলেছে যা কিনা খুব শীঘ্রই সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। মানুষ অশুদ্ধকেই কিছু দিন পর শুদ্ধ বলে দাবি করবে। কেননা, অশুদ্ধটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্য-কোটি মানুষ যখন বিকৃত বাংলা ভাষার পক্ষেই সাফাই গাইতে শুরু করবে, তখন কিছু সংখ্যক বাংলা ভাষাপ্রেমী কি আর সেই ¯্রােত রুখতে পারবে?
আমি মনে করি, বাংলা ভাষাসহ পৃথিবীর সকল ভাষা শুদ্ধ করার প্রক্রিয়াকেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। আমরা অবশ্যই যথাযোগ্য মর্যাদায় ভাষা শহীদদের স্মরণ করব। পাশাপাশি বিশ্বের যেকোনো ভাষাকে শুদ্ধভাবে লেখা ও বলার বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। তবেই তো ভাষা তার নিজস্বতা ধরে রাখাতে পারবে। বাংলা ভাষা তার অতীত গৌরব বজায় রাখুক, বাঙালি ভাষাভাষী বাংলা ব্যবহারে সচেতন হোক, এই কামনা করি।
লেখক: সাহিত্যিক ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কম্পিউটার বিভাগে কর্মরত, ঢাকা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন