বর্তমান জড়বাদী সভ্যতা মানুষকে দেহের শান্তি ও বিলাসিতা প্রদান করলেও মনের প্রশান্তি ও স্থিরতা কেড়ে নিয়েছে। ব্যাপক মানসিক উৎকন্ঠা ও অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণের জন্য অনেকেই মেডিটেশন, ধ্যান, যোগ-ইয়োগা ইত্যাদির আশ্রয় গ্রহণ করছেন। এগুলির ফলাফল অত্যন্ত সীমিত। সর্বোপরি এগুলি সকলের জন্য পালনযোগ্য বা সহজ নয়। পক্ষান্তরে ইসলামের ইবাদত, প্রার্থনা ও আল্লাহর যিকির মানসিক সুস্থতা, প্রশান্তি ও স্থিরতার জন্য অত্যন্ত সহজ, স্বাভাবিক, প্রাকৃতিক ও সর্বজনলভ্য পদ্ধতি। ধ্যান, মেডিটেশন, কোয়ান্টাম ইত্যাদিতে মানুষ জোর করে মনকে কিছু ‘মিথ্যা’ কল্পনা সত্য বলে মানতে বাধ্য করতে চেষ্টা করে। পক্ষান্তরে আল্লাহর যিকির, দু’আ ও ইবাদতে কোনো কষ্টকল্পনা ছাড়াই স্বাভাবিকভাবে আল্লাহর প্রতি প্রেমের অনুভুতি, আত্মসমর্পন ও নির্ভরতার মমতাময় অনুভুতির মাধ্যমে মানুষ মনের প্রশান্তি ও স্থিরতা লাভ করে এবং তার উৎকন্ঠা দূরীভূত হয়। সকলেই প্রতিদিন নিয়মিত ইবাদত ছাড়াও অন্তত কিছু সময় আল্লাহর যিকির করবেন। সম্ভব হলে প্রতিদিন ঘুমাতে যাওয়ার আগে ওযু করে দু’চার রাকাত সালাত আদায় করে কয়েক মিনিট সুন্নাত পদ্ধতিতে আল্লাহর যিকর, দরুদ ও দু’আ করে ঘুমাতে যাবেন। ইনশা আল্লাহ উৎকন্ঠা ও দুশ্চিন্তা দূরীভূত হবে এবং অন্তরে অসীম শক্তি ও শান্তি আসবে। আল্লাহ বলেন: “জেনে রাখ! আল্লাহর যিকিরে অন্তর সমূহ প্রশান্ত হয়।” (সূরা ১৩-রা’দ : ২৮ আয়াত)।
এছাড়া ইসলামে নির্মল বিনোদন, খেলাধুলা, হাঁসি-তামাশা ও কৌতুকের জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালবাসায় ক্রন্দন এবং নির্মল বিনোদন ও হাসি-কৌতুক মানুষের ভারসাম্যপূর্ণ মানসিকতার জন্য খুবই প্রয়োজন।
অসুস্থতার আরেকটি কারণ স্বাস্থ্য বিষয়ক অসতর্কতা। বিভিন্ন হাদীসে মুমিনদেরকে স্বাস্থ্য বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেমন খাদ্য ও পানীয় ঢেকে রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষত রাত্রিকালে খাদ্য বা পানীয় অনাবৃত করে রাখতে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। খাদ্য বা পানীয়ের মধ্যে শ্বাস প্রশ্বাস ফেলতে বা ফুঁক দিতে নিষেধ করা হয়েছে। কঠিন রৌদ্রতাপ থেকে সাধ্যমত আত্মরক্ষা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ময়লা হাত পানিতে প্রবেশ করাতে নিষেধ করা হয়েছে। কুকুরের ঝুটা পাত্র মাটি ও পানি দিয়ে ৭/৮ বার ধৌত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ডান হাতকে খাওয়া দাওয়া ও বাম হাতকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য ব্যবহার করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ সকল বিষয়ে বিস্তারিত জানা মুমিনের প্রয়োজন। মন ও দৈহিক সুস্বাস্থ্যের জন্য অন্যতম প্রয়োজনীয় বিষয় বিবাহ, ও স্ত্রী-সন্তানসহ পারিবারিক জীবন। ইসলামে বিষয়টিকে অত্যন্ত বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
সম্মানিত পাঠক, সকল সতর্কতার পরেও অসুস্থতা আসতে পারে। সেক্ষেত্রে মুমিনের অনেক কিছু করণীয় রয়েছে। সর্বপ্রথম করনীয় হলো সকল অস্থিরতা ও হতাশা থেকে অন্তরকে মুক্ত রাখা। মুমিন সকল প্রকার সতর্কতা অবলম্বন করবেন, কারণ এরূপ করাই আল্লাহর সিদ্ধান্ত সর্বান্তকরণে যথাসম্ভব আনন্দিত চিত্তে মেনে নেওয়া।
মুমিন বিশ^াস করেন যে, সকল বিপদ, কষ্ট মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে গোনাহ মাফের জন্য বা মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য আসে। রাসূলুল্লাহ (স) বলেন: “ যে কোন প্রকারের ক্লান্তি, অবসাদ, অসুস্থতা, দুশ্চিন্তা, মনোবেদনা, কষ্ট-উৎকন্ঠা যাই মুসলিমকে স্পর্শ করুক না কেন, এমনকি যদি একটি কাঁটাও তাকে আঘাত করে, তবে তার বিনিময়ে আল্লাহ তার গোনাহ থেকে কিছু ক্ষমা করবেন। (বুখারী, আস-সহীহ ৫/২১৩৭)।
কখনোই মনে করা যাবে না যে, যদি আমি এরূপ করতাম তাহলে হয়ত এরূপ হতো, অথবা এরূপ না করলে হয়ত এরূপ হতো না। এ ধরনের আফসোস মুমিনের জন্য নিষিদ্ধ। বিপদ এসে যাওয়ার পর মুমিন আর অতীতকে নিয়ে আফসোস করবেন না। বরং আল্লাহর সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। বিভিন্ন হাদীসে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ২। তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৩৮৩। তিনি বলেন, হাদীসটি হাসান সহীহ।
পাঠক, অসুস্থতার ক্ষেত্রে আমাদের দ্বিতীয় দায়িত্ব চিকিৎসার চেষ্টা করা। রাসূল্লাহ (স) বলেন: ‘হে আল্লাহর বান্দাগণ, তোমরা ঔষধ ব্যবহার কর। আল্লাহ যত রোগ সৃষ্টি করেছেন সকল রোগেরই ঔষধ সৃষ্টি করেছেন, একটি মাত্র ব্যধি ছাড়া.... তা হলো বার্ধক্য। (তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৩৮৩, তিনি বলেন, হাদীসটি হাসান সহীহ)।
সম্মানিত পাঠক, চিকিৎসার পাশাপাশি খাওয়া-দাওয়ার বিষয়ে সতর্ক হতে নির্দেশ দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ (স)। অসুস্থ মানুষের জন্য ক্ষতিকর খাদ্য গ্রহণে আপত্তি করেছেন তিনি। এ সকল হাদীস থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, ব্যবহার বা বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে রোগীর জন্য উপকারী বলে প্রমাণিত খাদ্য গ্রহণ করা এবং ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত খাদ্য বর্জন করা ইসলামের নির্দেশনা।
সম্মানিত পাঠক, ছোঁয়াচে রোগ বা রোগের সংক্রমণ নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে হাদীসে নিষেধ করা হয়েছে। আমরা বাস্তবেও দেখতে পাই যে, রোগীর কাছে, সাথে বা চারিপার্শে থেকেও অনেক মানুষ সুস্থ রয়েছেন। আবার অনেক সতর্কতার পরেও মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন বিভিন্ন রোগে। বস্তুত শুধু রোগজীবানুর সংক্রমনেই যদি রোগ হতো তাহলে আমরা সকলেই অসুস্থ হয়ে যেতাম; কারণ প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রকারের রোগজীবানু আমাদের দেহে প্রবেশ করছে। রোগজীবানুর পাশাপাশি মানুষের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, রোগ জীবানুর কর্মক্ষমতা ইত্যাদি অনেক কিছুর সমন্বয়ে মানুষের দেহে রোগের প্রকাশ ঘটে। আবু হুরায়রা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (স) বলেন, “সংক্রমনের অস্তিত্ব নেই। তখন এক বেদুঈন বলল, হে আল্লাহর রাসূল আমার উটগুলি হরিনীর ন্যায় সুস্থ থাকে। এরপর একটি চর্মরোগে আক্রান্ত উট এগুলির মধ্যে প্রবেশ করার পরে অন্যান্য উটও আক্রান্ত হয়ে যায়। তখন রাসূলুল্লাহ (স) বলেন: তাহলে প্রথম উটটিকে কে সংক্রমিত করল? (বুখারী, আস-সহীহ ৫/২১৬১, ২১৭৭; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৭৪২)।
পাশাপাশি সংক্রমণের বিষয়ে সতর্ক হতেও রাসূলুল্লাহ (স) নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন : “ অসুস্থকে সুস্থের মধ্যে নেওয়া হবে না (রুগ্ন উট সুস্থ উটের কাছে নেবে না।) (বুখারী, আস-সহীহ ৫/২১৭৭; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৭৪২-১৭৪৩)। “যদি তোমরা শুনতে পাও যে, কোনো জনপদে প্লেগ বা অনুরূপ মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটেছে তবে তোমরা তথায় গমন করবে না। আর যদি তোমরা যে জনপদে অবস্থান করছ তথায় তার প্রাদুর্ভাব ঘটে তবে তোমরা সেখান থেকে বের হবে না।” (বুখারী, আস-সহীহ ৫/২১৬৩; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৭৩৮, ১৭৩৯)।
এভাবে রাসূলুল্লাহ (স) প্রায় দেড় হাজার বৎসর পূর্বে সংক্রমন প্রতিরোধে বিচ্ছিন্নকরণ (য়ঁধৎধহঃরহব) ব্যবস্থার নির্দেশনা প্রদান করেছেন। মুমিন বিশ^াস করেন যে, সকল বিষয়ের ন্যায় রোগের ক্ষেত্রেও আল্লাহর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এজন্য সংক্রমনের ভয়ে অস্থির বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়ার কোনো কারণ নেই। পাশাপাশি যে সকল রোগের বিস্তারে সংক্রমন একটি উপায় বলে নিশ্চিত জানা যায় সে সকল রোগের বিস্তার রোধের ও সংক্রমন নিয়ন্ত্রণের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সম্মানিত পাঠক, অসুস্থ ব্যক্তির সঠিক বিশ্রাম ও কষ্টদায়ক দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেওয়া ইসলামের নির্দেশ। অসুস্থতার কারণে নামায বসে, শুয়ে বা ইশারায় পড়তে, রোযা কাযা করতে এবং ওযূ ও গোসলের বদলে তায়াম্মুম করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যদি কেউ অসুস্থতা বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও পানি ব্যবহার করে বা সিয়াম পালন করে তবে তার সাওয়াব তো হবেই না, বরং তিনি পাপী হবেন। আল্লাহ যে সুযোগ দিয়েছেন তা গ্রহণ না করে অতি-তাকওয়া প্রদর্শন ইসলামে নিন্দা করা হয়েছে।
অসুস্থ মানুষের প্রতি সমাজের অন্য মানুষদের দায়িত্ব হলো তাদের সেবা করা, দেখতে যাওয়া, চিকিৎসা গ্রহণে উৎসাহ প্রদান, মানসিক আস্থা তৈরি করা ও দু’আ করা। কাউকে অসুস্থ জানার পরেও তাকে দেখতে না গেলে কিয়ামতের দিন আল্লাহ জবাবদিহী করবেন বলে হাদীসে বলা হয়েছে। অসুস্থ মানুষকে দেখতে যাওয়ার সাওয়াব বিষয়ে অনেক হাদীস রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (স) বলেন : “ যদি কেউ কোনো অসুস্থ মানুষকে দেখতে যায় তবে সে ফিরে না আসা পর্যন্ত অবিরত জান্নাতের বাগানে ফল চয়ন করতে থাকে।” ২। মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৯৮৯।
“যদি কেউ কোনো রোগীকে দেখতে যায় তবে রহমতের মধ্যে সাঁতার কাটতে থাকে। আর যখন সে রোগীর পাশে বসে তখন সে রহমতের মধ্যে ডুব দেয়।” ৩। যিয়া মাকদিসী, আল-মুখতারাহ ৭/২৬৭-২৬৮; আলবানী, সহীহুত তারগীব ৩/১৯৭। হাদীসটি সহীহ। “যদি কোন মুসলিম সকালে কোনো রোগীকে দেখতে যায় তবে সন্ধ্যা পর্যন্ত ৭০ হাজার ফিরিশতা তার জন্য দোয়া করতে থাকে। আর যদি কেউ বিকালে কোনো রোগীকে দেখতে যায় তবে পরদিন সকাল পর্যন্ত ৭০ হাজার ফিরিশতা তার জন্য দোয়া করতে থাকে। আর সে জান্নাতে একটি বাগান লাভ করে।” ৪। তিরমিযী, আস-সুনান ৩/৩০০; আলবানী, সহীহুত তারগীব ৩/১৭৯। হাদীসটি সহীহ।
কোন অসুস্থ মানুষকে দেখতে গেলে তার জন্য দোয়া করা সুন্নাত। এ সময়ের জন্য বিভিন্ন দোয়া হাদীসে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এ সকল দু’আ শিখে তা আমল করা আমাদের প্রয়োজন। মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাওফীক প্রদান করুন। আমীন!!
লেখক : খতীব, বাইতুল কুদ্দুস জামে মসজিদ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন