জান্নাতুল ফেরদৌস
প্রকৃতি ও জীবনের বর্ণিল অনুষঙ্গের নাম প্রজাপতি। গত শুক্রবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে “আকাশে উড়লে প্রজাপতি, প্রকৃতি পায় নতুন গতি” এই স্লোগানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের জহির রায়হান অডিটরিয়ামের সামনে ও বোটানিক্যাল গার্ডেনে জাল দিয়ে ঘেরা ‘প্রজাপতি ঘরে’ ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছর প্রজাপতি মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। পরিবেশের জন্য প্রজাপতির উপকারিতা তুলে ধরা এবং তা সংরক্ষণে জনগণকে সচেতন করতেই এ মেলার আয়োজন বলে জানালেন আয়োজকরা।
প্রকৃতি ও প্রজাপতি সংরক্ষনণ-এর প্রতি গণসচেনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের কীটতত্ত্বশাখার শাখার পক্ষ থেকে এ মেলার আয়োজন করা হয়। প্রতিবছর ডিসেম্বরের প্রথম শুক্রবারে এ মেলার আয়োজন করা হবে।
এর এই প্রজাপতি মেলাকে ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনকে সাজানো হয় প্রজাপতির ছবি অঙ্কিত নানা রঙ্গের ব্যানার ও মিলনায়তনের সামনে স্থাপনকৃত মশারীর নেট দিয়ে তৈরি প্রজাপতির হাটে নানা রঙের প্রজাপতি দেখে মেলায় আগত দর্শনার্থীরা ভীষণ মুগ্ধ হন।
এসব কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তন ও ভোটানিক্যাল গার্ডেন প্রজাপতিপ্রেমীদের দখলে ছিল সারাদিন। তাদের আনাগোনায় মুখরিত হয়ে ওঠে ক্যাম্পাস। প্রজাপতি মেলার পাশাপাশি অতিথি পাখিও তাদের কিচিরমিচির শব্দ, খুনসুঁটিতে মুখরিত ও মুগ্ধ করে রেখেছে দর্শনার্থীদের। হালকা শীতের পরশে সারাটা দিন ক্যম্পাসে উৎসবমখুর পরিবেশ বিরাজ করেছে।
দূরদুরান্ত থেকে সকাল থেকেই হাজারো প্রজাপতিপ্রেমী, শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা ক্যাম্পাসে ছুটে আসেন। তাদের ভীড়ে ক্যাম্পাসে এক আনন্দঘন পরিবেশে পরিণত হয়।
ঢাকার মিরপুর থেকে সাবা ভোরেই তার মা-বাবাকে নিয়ে প্রজাপতি দেখতে ক্যাম্পাসে ছুটে এসেছিল। সাবা মিরপুরের প্রিপারেটরি গ্রামার স্কুলের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী। সে জানায়, মেলায় এসে নানা রঙের প্রজাপতি দেখে তার খুব ভালো লেগেছে। সে সকাল থেকেই প্রজাপতিকে ধরতে তাদের পিছু লেগেছে। কিন্তু প্রজাপতি ছুঁতে গেলেই কেন উড়ে যায় এটা তার জিজ্ঞাসা! বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. শরিফ উদ্দিনের ছোট্ট ছেলে অর্নব জানায়, মেলায় অনেক প্রজাপতি দেখে তার ভালো লেগেছে। সে কয়েকটি প্রজাপতি বাসায় নিয়ে যেতে চায়।
এছাড়ায় মেলায় দিনব্যাপী শিশুদের জন্য ছবি আঁকা প্রতিযোগিতা, প্রজাপতির আলোকচিত্র প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতা, প্রজাপতির হাট দর্শন, প্রজাপতির আদলে ঘুড়ি উড্ডয়ন, প্রজাপতি বিষয়ক বিতর্ক, ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। আগত দর্শকরা বেশ আনন্দের সাথে এসব অনুষ্ঠানে অংগ্রহণ ও উপভোগ করেছে।
শিশুরা তাদের বাবা-মার সাথে ঘুরে ঘুরে সারাদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভোটানিক্যাল গার্ডেনে কৃত্রিমভাবে বানানো প্রজাপতি হাট দেখে। এছাড়া মেলায় শিশুদের জন্য অধ্যাপক ড. মনোয়ার হোসেন ও কবি খালেদ হোসাইন কর্তৃক রচিত ‘ছন্দে ছড়ায় প্রজাপতি’ শীর্ষক বইটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়। বইতে ৪০টি প্রজাতির ছবিসহ তথ্য ও ৪০টি ছড়া রয়েছে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মেলার আহবায়ক অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন। অনুষ্ঠানে প্রাণিবিদ্যা বিষয়ক গবেষণায় সার্বিক অবদানের জন্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. হুমায়ূন কবিরকে আজীবন সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়।
এতে প্রধান অতিথির ভাষণে ভিসি বলেন, প্রকৃতি ও জীবনের বর্ণিল অনুষঙ্গের নাম প্রজাপতি। প্রজাপতি শুধু নিজেই সুন্দর নয়, সে মানুষের মনকে উদ্বেলিত করে, আনন্দ যোগায়। ভিসি আরও বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ প্রকৃতির অপরূপ দান।পরিবেশে রক্ষায় তিনি বলেন প্রকৃতির এ সৌন্দর্য রক্ষায় সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
প্রজাপতি গবেষকের কথা : বাংলাদেশে প্রজাপতি নিয়ে প্রথম গবেষণা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মাহমুদুল আমিন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. শফিক হায়দার চৌধুরী। ১৯৬৮ সালে তাদের যৌথ গবেষণার প্রতিবেদনে ২৭ প্রজাতির প্রজাপতি শনাক্তের কথা উল্øেখ আছে। এম ওয়াহেদ এবং জেএইচ চৌধুরী ১৯৮৩-’৮৫ সালে আরেক যৌথ গবেষণায় ৩৩ প্রজাতির প্রজাপতির সন্ধান পান। ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএস আলম এবং জিএম উল্লাহ ২১ প্রজাতির প্রজাপতি শনাক্ত করেন। ১৯৯৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মনোয়ার হোসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ইসমাইল হোসেন আরেক যৌথ গবেষণায় ৪৪ প্রজাতির প্রজাপতির সন্ধান পান। ২০০৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এমএ বাশার ১৬৭ প্রজাতির প্রজাপতির তালিকা প্রকাশ করেন। সর্বশেষ ২০০৯ এর জুন থেকে ২০১৪ এর মে পর্যন্ত গবেষণায় ৮ প্রজাতির সন্ধান পান ড. মনোয়ার হোসেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন, বিভিন্ন হল, বিভাগ ও অনুষদের বাগান, প্রশাসনিক ভবন, উদ্যানসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় গবেষণা চালিয়ে এসব নতুন প্রজাতির প্রজাপতি শনাক্ত করা হয়েছে। সব মিলে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় ৩০০ প্রজাতির প্রজাপতি শনাক্ত করা হয়েছে। তবে প্রাণিবিজ্ঞানীদের ধারণা, বাংলাদেশে কমপক্ষে ৫০০ প্রজাতির প্রজাপতি আছে । গবেষকগণ মনে করেন, পরিবেশ ও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় প্রজাপতির ভূমিকা তুলে ধরে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। দেশে বিদ্যমান বিচিত্র প্রজাতির প্রজাপতি ব্যবহার করে গবেষণা ও শিল্পগতভাবে আমাদের লাভবান হবার সুযোগ রয়েছে।
প্রজাপতির বাগান : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অধ্যাপক মনোয়ার হোসেনের আগ্রহে গড়ে উঠেছে প্রজাপতি বাগান। এছাড়াও বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কেও রয়েছে একটি প্রজাপতি বাগান। চট্টগ্রামের পতেঙ্গার বাটারফ্লাই পার্কেও রয়েছে প্রজাপতির সমাহার। অধ্যাপক ড. মনোয়ার হোসেনের প্রায় দুই দশকের সাধনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন একর জায়গার ওপর গড়ে উঠেছে প্রজাপতি বাগান। এখানে রয়েছে প্রজাপতির উপযোগী গাছ-গাছালি, ফুলের বাগান ও প্রজাপতির ঘর। প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ছাদে ও সামনের বাগানে তৈরি করা হয়েছে ‘প্রজাপতি ঘর’। এখানে কৃত্রিম প্রজনন ঘটিয়ে অবমুক্ত করা হচ্ছে প্রজাপতি।
প্রজাপতি রফতানি করে প্রতিবছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। কিন্তু সরকারের অমনোযোগিতা ও অর্থ সঙ্কটের কারণে আমরা তা করতে পারছি না বলে জানান অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন