পান থেকে চুন খসা মাত্রই সমাজের অনেকে মন্তব্য করেন, সমাজটা খারাপ হয়ে গেছে। কেউ আরেকটু এগিয়ে বলেন, প্রজন্মটাই খারাপ। এমন কথার চূড়ান্ত মন্তব্য হলো যুগটাই খারাপ। যারা এভাবে সমাজ, প্রজন্ম ও যুগের সমালোচনায় লিপ্ত তারাও যে দুধে ধোয়া তুলসি পাতা এমন নয়। মানুষ অভ্যাসবশত অন্যের সমালোচনা করতে পছন্দ করেন, কিন্তু নিজের ন্যূনতম কোনো দোষ-ত্রুটির দিকে ভ্রƒক্ষেপ করেন না। ইসলামি শরিয়তে সমালোচনা, পেছনে কথা বলা যেমন নিষিদ্ধ; তেমনি সমাজ, প্রজন্ম ও যুগকে গালি দেওয়া হারাম। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা বলে, আমাদের পার্থিব জীবনই তো শেষ; আমরা মরি ও বাঁচি মহাকালই আমাদের ধ্বংস করে। তাদের কাছে এ ব্যাপারে কোনো জ্ঞান নেই। তারা কেবল অনুমান করে কথা বলে।’ সুরা জাসিয়া : ২৪
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) কে আমি বলতে শুনেছি, আল্লাহতায়ালা বলেন, আদম সন্তান সময় ও কালকে গালিগালাজ করে, অথচ আমিই সময়। আমিই রাত-দিনকে পরিবর্তন করি।’ সহিহ্ মুসলিম : ২২৪৬
হাদিসের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, জামানা কোনো কিছু করতে পারে না। সবকিছুর পরিবর্তন করেন মহান আল্লাহ, এটা সৃষ্টির ধারাবাহিক বিধান। সময় কিংবা যুগের নিজস্ব কোনো কর্মক্ষমতা নেই। ফলে এই দুটিকে গালি দেওয়া প্রকারান্তরে এর পরিবর্তনকারী আল্লাহতায়ালাকে গালি দেওয়া। যা অত্যন্ত গর্হিত ও কবিরা গোনাহের।
লোকসমাজে কান পাতলেই বলতে শোনা যায়, সময় বড়ই খারাপ, মানুষের মন থেকে বিশ্বাস ও ধর্মানুরাগ বিদায় নিয়েছে, ভদ্রতা ও শালীনতার মৃত্যু হয়েছে, মানুষ আল্লাহ ও পরকাল বিমুখ। এসব অভিযোগ অসত্য নয়। জীবন ও সমাজের যেদিকে তাকাই নৈতিক স্খলনের ঝড় দেখতে পাই। মানবসমাজের এই অবনতির অনেক কারণ রয়েছে। এর অন্যতম হলো অনৈতিকতার ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে না পারা। অন্যায় জেনেও ত্রুটি ও ক্ষতগুলো নিজের জন্য বৈধ বানিয়ে ফেলা। অনেকে বলেন, কাজটি তো বৈধ নয়, তবে যুগের অবস্থা কিংবা সার্বিক পরিস্থিতির জন্য করতে হয়। অন্যায়টি করতে যেয়ে নিজের ক্ষেত্রে কোনো না কোনো বাহানা খোঁজা, আর অন্যের সময় সমালোচনা করা। অথচ অন্যের দোষ না ধরে নিজে কাজটি না করলে সমাজ বেশি উপকৃত হতো, নিজেও পাপ থেকে বেঁচে থাকতে পারত। আসলে মানুষের দৃষ্টি শুধু অন্যের দোষ দেখে, অন্যের দোষ খুঁজে অন্যের সমালোচনা করে। এসব দোষ নিজের মধ্যে থেকে দূর করার প্রকৃত উদ্যোগ কম মানুষের মধ্যেই দেখা যায়।
বর্তমান সমাজে অনৈতিকতার আগুন লেগেছে, যা আমরা সবাই বুঝি এবং আলোচনা-সমালোচনা করি। তথাপি নিজেরা সেই অনৈতিক কাজগুলো করি এবং বারবার করতে থাকি। আবার দোষ দেই সমাজের,প্রজন্মের কিংবা যুগের। কিন্তু নিজে পরিবর্তনের চেষ্টা করি না। অথচ কোনো সমাজে অনৈতিকতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে আল্লাহর নির্দেশ হলো, ‘হে মুমিনরা! তোমাদের দায়িত্ব তোমাদের ওপর। তোমরা যদি সৎপথে পরিচালিত হও তবে যে পথভ্রষ্ট হয়েছে সে তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ সুরা মায়েদা : ১০৫
এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়, অন্যের পাপাচার কোনো পাপ কাজের অনুমোদন দিতে পারে না এবং অন্যের অন্যায় কাজের আলোচনা মানুষের কোনো উপকারে আসে না। মুমিনের দায়িত্ব হলো, নিজেকে রক্ষা করা এবং সমাজ ও রাষ্ট্রকে অন্যায় থেকে বিরত রাখার যদি সুযোগ না থাকে অন্তত নিজে তা পরিহার করা। নিজের সবটুকু সামর্থ্য দিয়ে নিজেকে সংশোধন করা। যে পাপ তাৎক্ষণিক পরিহার করা যায়, তা সঙ্গে সঙ্গে পরিহার করা এবং যা ছেড়ে দিতে সময়ের প্রয়োজন হয়, তা ছাড়ার চেষ্টা শুরু করা। নবী কারিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যখন দেখবে মানুষ কৃপণতা করছে, প্রবৃত্তির পেছনে ছুটছে, পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, প্রত্যেকে নিজের মতামতে মুগ্ধ, এমন পরিস্থিতিতে নিজের সংশোধনে বিশেষ মনোযোগ দাও। সাধারণ মানুষের পথ পরিহার করো।’ আবু দাউদ : ৪৩৪১
আলোচ্য হাদিসের ব্যাখ্যা হলো, এমন পরিস্থিতিতে মানুষের সমালোচনা করা কোনো সমাধান নয়; বরং সমাধান হলো প্রত্যেকে নিজেকে সংশোধন করার চেষ্টা করা এবং ছড়িয়ে পড়া পাপাচার থেকে নিজেকে রক্ষার সর্বাত্মক চেষ্টা করা। অন্য হাদিসে নবী কারিম (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বলল, মানুষ ধ্বংস হয়ে গেছে সে বেশি ধ্বংসপ্রাপ্ত।’ সহিহ্ মুসলিম : ৪৭৫৫
আসলে আমরা যারা অন্যের সমালোচনায় লিপ্ত, দিন শেষে দেখা যায় তারাই অধিক খারাপ। সামাজিক জীবনে একটি প্রদীপ থেকে অন্য প্রদীপ প্রজ্বলিত হয় এবং এক ব্যক্তির সুপথে চলার কারণে অন্যরা অনুপ্রাণিত হয়। আর যেহেতু মানুষ নিয়েই সমাজ ব্যবস্থা তাই আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজেদের সংশোধনের চিন্তা প্রবল হলে ধীরে ধীরে সমাজ বদলে যাবে।
লেখক: কলামিষ্ট ও প্রাবন্ধিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন