শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

মুসলিহে উম্মাহ’র দরদী রাহবার ছিলেন হযরত মাওলান ইদরীস সন্দ্বীপী রহ.

মুহাম্মদ জিয়াউল হক | প্রকাশের সময় : ৩ মার্চ, ২০২২, ১২:১৭ এএম

মাওলান ইদরীস সন্দ্বীপি রহ. ১৯৩১ সালে বর্তমান চট্রগ্রাম জেলাধীন বঙ্গোপসাগর বেষ্টিত সন্দ্বীপ থানার এক নিবিড় পল্লী সন্তোষপুরে জন্মগ্রহণ করেন। সাত ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। তার পিতার নাম মুহাম্মাদ আব্দুল গনী। মাতার নাম সায়্যিদাতুন নিসা। সন্দ্বীপের অপরূপ নৈসর্গিক মায়াময় পরিবেশে শৈশবের সোনাঝরা দিনগুলো তিনি অতিক্রম করেন। মুক্ত আবহাওয়ায় বেড়ে উঠেন। বাল্যকাল থেকেই তাঁর চিন্তা-চেতনা ছিল সুদূরপ্রসারী। পাড়ার ছেলেরা মাঠে খেলাধুলা করতো। তিনি এককোণে বসে ভাবুক মননে মাটিতে কী যেন আঁকিবুঁকি করতেন! পিতা-মাতার স্নেহছায়ায় থেকে সত্য ও সততা, ন্যায় ও ইনসাফের আদর্শিক পাঠগুলো সহজেই আত্মস্থ করে নেন। শৈশবকাল থেকেই তাঁর মনে সুপ্ত ছিল ‘ইলমে’ইলাহী’র তীব্র বাসনা।

শিক্ষা: হযরত সন্দ্বীপি রহ. এর শিক্ষার হাতেখড়ি হয় সন্দ্বীপের মুন্সিরহাট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এর পাশাপাশি তিনি তাঁর বাল্যকালের উস্তাদ মাওলানা নূরুল ইসলাম সাহেবের কাছে কায়েদা থেকে কুরআনুল কারীম পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করেন। এছাড়াও এ সময় তিনি মিফতাহুল জান্নাত, রুকনুদ্দীন, কারিমা, পান্দেনামা, গুলিস্তাঁ, সিকান্দারনামা ইত্যাদি কিতাবের পাঠ গ্রহণ করেন। শৈশবের শেখা উপদেশমূলক কিতাব কারীমা ও গুলি¯ঁঁঁঁঁঁঁÍার প্রভাব তাঁর পুরো জীবন ধারায় প্রতিফলিত হয়েছিল। সমসাময়িক আলেমগণের মতে হযরতের জীবন ছিল কারীমা ও গুলিস্তাঁর প্রতিচ্ছবি। প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের জন্য তিনি ভর্তি হন পাশর্^বর্তী গ্রাম মাইটভাঙ্গায় অবস্থিত করিমবাড়ী মাদরাসায়। সেখানে আরবি ব্যাকরণ নাহু-সরফের অভিজ্ঞ উস্তাদ মাওলানা সাইয়িদ আহমাদ সাহেবের কাছে শিক্ষা অর্জন করেন। পরবর্তীতে বশিরিয়া সিনিয়র ইসলামিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন এবং কৃতিত্বের সাথে পড়াশোনা করেন। সেখানে পড়াশোনা করা অবস্থায় তার শ্রদ্ধেয় পিতা-মাতা উভয়ে ইন্তিকাল করেন। আমল-আখলাক ও সুন্নাতী লেবাসের কারণে উস্তাদগণ তাকে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য দেওবন্দ যাওয়ার পরামর্শ দেন। অনেক প্রতিকূলতার মাঝেও অবশেষে তিনি পাড়ি জমান বিশ^বিখ্যাত ইসলামী বিদ্যাপীঠ ভারতের দারুল উলূম দেওবন্দ। সেখানে তিনি দীর্ঘ চার বছর উচ্চশিক্ষা অর্জন করেন।

খেলাফত প্রাপ্তি: দারুল উলূম দেওবন্দে দাওরায়ে হাদিস সমাপনান্তে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের বীরসেনানী, আওলাদে রাসূল সাইয়িদ হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. তাকে বললেন, যাও! দেশে, গিয়ে দীনের খেদমত করো, চাই তা ‘কায়েদায়ে বোগদাদী’ পড়ানোর মাধ্যমেই হোক না কেন। তিনি বললেন, হযরত! আপনার হাতে ‘বাইয়াত’ হতে চাই। মাদানী রহ. বাইয়াত করে নিলেন। শুরু হল সুলূকের পথে কঠিন মেহনত। শাইখের সাথে গড়ে উঠল অন্তরের গভীর সম্পর্ক। আধ্যাত্মিক জগতের এই রাহবার হযরত মাওলানা সাইয়িদ হুসাইন আহমাদ মাদানী রহ. এর সংস্পর্শে থেকে তিনি টানা দেড় বছরর সুলূক ও আধ্যাত্মিকতার পথে মেহনত করেন। দুই বছর পর মাদানী রহ. এর খেলাফত প্রাপ্ত হয়ে দীর্ঘ ছয় বছর পর স্বদেশে প্রত্যাবর্র্র্তন করেন। দেশে ফেরার পর তিনি শরিয়তের হুকুম-আহকামের প্রতি মানুষেকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। সমাজ থেকে বিদআত ও কুসংস্কার দূরীকরণে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যান।

শিক্ষকতা: হযরত মাওলানা ইদরীস রহ. এর কর্মজীবন ছিল বর্ণাঢ্য ও দীপ্তিময়। ভারতের ঐতিহ্যবাহি দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে সন্দ্বীপ আসার পর প্রথমে সন্দ্বীপ কাঠগড় ইসলামিয়া সিনিয়র মাদরাসার প্রিন্সিপাল নিযুক্ত হন। কয়েক বছর পর প্রতিষ্ঠান থেকে অব্যহতি নিয়ে কিছুকাল দারুল উলূম দক্ষিণ সন্দ্বীপের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপনার সময়ে তিনি ছাত্রদের আমল-আখলাকের প্রতি খুব গুরুত্ব দিতেন। তিনি বাংলাদেশের পথহারা-পথভোলা জনগেুাষ্ঠির চারিত্রিক সংশোধন ও উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে ‘তাহরিকে ইসলাহুল উম্মাহ’ নামে দাওয়াত ও তাজকিয়ার মেহনত চালু করেছেন। বর্তমানে তার সুযোগ্য উত্তরসূরী, বড় সাহেবযাদা হযরত মাওলানা ফয়জুল্লাহ সন্দ্বীপি দা. বা. এই মেহনত সারাদেশে ব্যাপক পরিসরে চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন স্থানে নিয়মিত মাসিক ইসলাহী জোড় করছেন। প্রতি বছর মাদানীনগর মাদরাসায় বার্ষিক ‘ইসলাহী জোড়’ হয়। আগামী ১৪, ১৫ জানুয়ারী ২০২২ বার্ষিক ‘ইসলাহী জোড়’ অনুষ্ঠিত হবে।
মাদরাসা প্রতিষ্ঠা: দারুল উলূম দক্ষিণ সন্দ্বীপে শিক্ষক থাকা অবস্থায় তিনি নিজ গ্রাম সন্তোষপুরে মাদরাসা প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে ‘ইলহাম’ প্রাপ্ত হন। তাই সেখান থেকে অব্যহতি নিয়ে নিজ গ্রামে কিছু জমি ক্রয় করেন এবং সেখানে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই তাঁর হাতে প্রতিষ্ঠিত প্রথম মাদরাসা। দূর-দূরান্ত থেকে ছাত্ররা ‘দ্বীনি ইলম’ অন্বেষণের জন্য মৌমাছির মতো ছুটে আসতে থাকে। এই মাদরাসার প্রাথমিক অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে হযরতের প্রথম যুগের ছাত্র মাওলা আব্দুল গনী সাহেব বলেন, ‘শুরুতে অতি কষ্টে চলতো মাদরাসাটি। আখের পাতা দিয়ে ঘরের বেড়া দেয়া হয়েছিল। হযরত একাই প্রায় সাড়ে তিনশত ছাত্রের ‘শরহেজামী’ পর্যন্ত ক্লাস নিতেন।’ অর্থনৈতিক দৈন্যদশা, শিক্ষক সংকট ও নানা প্রতিকূলতার মধ্যদিয়ে অধ্যাপনার দায়িত্বসহ আনুষাঙ্গিক সবকাজ তিনি একাই আঞ্জাম দিতেন।

দ¦ীন প্রচারেÑ দ্বীপ থেকে শহরে: প্রায় ত্রিশ বছর সন্দ্বীপে দীনি তা’লিম ও তরবিয়ত প্রদানের মাধ্যমে হাজারো আলেম তৈরি করেন। আল্লাহ তা’্আলা হযরতের অন্তরে ঢাকা ও তার পাশর্^বর্তী এলাকাগুলোতে দ্বীনি শিক্ষা প্রদানের প্রচণ্ড আগ্রহ সৃষ্টি করে দেন। ফলে তিনি প্রথমে নরসিংদী জেলার ইসলামপুরে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। সাত বছর পর্যন্ত প্রতি রমযানে হযরত সেখানেই ই’তিকাফ করতেন। ইসলামপুর মাদরাসা যখন মোটামুটি জমে উঠে তখন তিনি দীনদার শুভানুধ্যায়ীদের সহায়তায় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটা মাদরাসা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তারপর বহু কাক্সিক্ষত দারুল উলূম মাদানীনগর মাদরাসার ভিত্তি স্থাপিত হয় ৩১ ডিসেম্বর ১৯৮৪ সালে। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন বিশ^খ্যাত বুযুগর্, শাইখুল ইসলাম হযরত হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. এর বড় সাহেবযাদা ‘ফিদায়ে মিল্লাত’ হযরত মাওলানা আস’আদ মাদানী রহ. মাত্র ষোলজন ছাত্র নিয়ে শুরু হওয়া জামি‘আর পথচলা; আজ সেখানে শিক্ষার্জন করছে প্রায় আড়াই হাজার শিক্ষার্থী।

নৌপথে বাইতুল্লাহ যিয়ারত: ১৯৬৭ সালে চট্রগ্রাম থেকে নৌপথে পাকিস্তানে তাবলিগের মারকাজ রায়বেন্ডে গমন করেন। তাবলিগের শীর্ষ মুরব্বী মাওলানা ইনআমুল হাসান রহ.সহ হজব্রত পালনে সৌদিআরবে দুই মাস অবস্থান করেন। এই সময় তিনি ‘মুআল্লিমুল হুজ্জাজ’ এর দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৭৮ সালে কাকরাইলের হযরত মাওলানা লুৎফুর রহমান রহ. ও শীর্ষ মুরুব্বীদের জামাতের সাথে দ্বিতীয়বার হজ আদায় করেন। তিনি প্রায় ১২ বার হজ ও উমরা পালনের সৌভাগ্য অর্জন করেন।

বিদেশ সফর: হযরত সন্দ¦ীপি রহ. ১৯৯১ সালে লন্ডন ও আমেরিকা সফর করেন। প্রথমে লন্ডনে গমন করেন। এই সময় তিনি লন্ডনে অবস্থানরত মুসলমানদের উদ্দেশে মসজিদে ও ইসলামি সেমিনারে বক্তব্য প্রদান করেন। লন্ডনের সফর শেষে হযরত আমেরিকার উদ্দেশে যাত্রা করেন। সেখানকার মানুষদের স্বতস্ফূর্ত সহযোগীতায় নিউইয়র্কে একটি মাদরাসাও প্রতিষ্ঠা করেন। আমেরিকায় বসবাসরত মুসলমানের মাঝে আত্মশুদ্ধিমূলক আলোচনা রাখেন। ১৯৯৫ সালে আবারও আমেরিকা, কানাডা, আরব আমিরাত ও সৌদিআরব ভ্রমণ করেন।

ইন্তেকাল: কালজয়ী এই মহান মনীষী ২৬ নভেম্বর, ২০০২ সাল। রমযান মাসে সকাল ৯টায় পরম করুণাময়ের ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে পাড়ি জমান। এক স্ত্রী, চার কন্যা, সাত পুত্র ও অসংখ্য ভক্তবৃন্দ রেখে গেছেন। হযরতের মৃত্যুর সংবাদ মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। জানাযায় অংশগ্রহণ করতে, হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষক, দেশবরেণ্য উলামায়ে কেরাম ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে। পথ-ঘাট লোকেলোকারণ্য হয়ে যায়। তিলধারনের ঠাঁই ছিল না। জানাযার ইমামতি করেন বড় সাহেবযাদা হযরত মাওলানা হাফেয ফয়জুল্লাহ সন্দ্বীপি। উপস্থিত ছিলেন বাইতুল মোকাররমের খতিব মাওলানা উবাইদুল হক সাহেব। মাদানীনগর মাদরাসা মাঠের পশ্চিম পাশে, মসজিদের কোল ঘেষে সবুজ উদ্যানে দাফন করা হয়। তিনি আজ আমাদের মাঝে নই, রয়েগেছে তাঁর সমুজ্জল কীর্তিগুলো। আল্লাহ তাঁর কবরকে নূর দ্বারা পূর্ণ করে দিন।

লেখক : প্রিন্সিপাল. মদিনা মাদরাসা বাজার, রায়পুরা, নরসিংদী।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন