ঢাকার অদূরে গাজীপুর সড়কের বেহাল অবস্থার কারণে যানবাহনের প্রচন্ড জট লেগে থাকছে। ভোগান্তিতে পড়ছেন এই রুটের যাত্রী ও পথচারীরা। উন্নয়ন প্রকল্পে ধীরগতি ও বেহাল সড়কের কারণে যাত্রীদের একদিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে গাড়িতে আটকা। অন্যদিকে ধুলার রাজত্ব। এর নেই কোন সময়সীমা। সকালে অফিসে যাওয়ার সময় যেমন যানজট, গভীর রাতেও তেমনই। এমনকি নিস্তার নেই ফজরের আজানের সময়ও।
চব্বিশ ঘণ্টাই যানজট আর ধুলাবালির কঠিন ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে এয়ারপোর্ট যাতায়াতকারী যাত্রীদের। এই পরিস্থিতি সাময়িক নয়। গত ৮ বছর ধরে এমনই সীমাহীন ভোগান্তিতে রয়েছেন এ রুটের যাত্রীরা। বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প এলাকায় এমন দুর্দশার চিত্র চোখে পড়ছে ৮ বছর ধরে। চার বছরের সময়সীমা পেরিয়ে আট বছর চলছে। তারপরও কাজ শেষ হওয়ার লক্ষণ নেই।
গত বছরের শুরুতে বিআরটি কর্তৃপক্ষ বলেছিলেন, বছরের শেষ ভাগ অর্থাৎ ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই বিআরটি প্রকল্পের কাজ শেষ করা যাবে। ডিসেম্বর যাবার পর এখন মার্চ মাসের শুরুতে আবার বলা হচ্ছে, একই কথা অর্থাৎ আগামী ডিসেম্বরেই শেষ করা যাবে। গত চার বছর ধরেই এভাবে ডিসেম্বরে কাজ শেষ করার আশ্বাস দেয়া হচ্ছে। বার বার আশ্বাসে মানুষের ক্ষোভ চরমে পৌঁছেছে।
অথচ ঢাকার নিকটবর্তী গাজীপুর দেশের অন্যতম শিল্পকেন্দ্র। সাড়ে ৪ হাজারের বেশি কারখানা গড়ে উঠেছে এখানে। কিন্তু একটি বড় সড়ক অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলমান থাকায় এই শিল্পকেন্দ্রই এখন বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাস্তার কাজের জন্য শিল্পের সম্পূর্ণ সরবরাহ চক্র তো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেই, সেই সড়কে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন এই পথে নিয়মিত যাতায়াতকারী যাত্রীরাও।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঢাকা ও গাজীপুর এলাকার যানজট কমাতে ২০১২ সালে একনেক সভায় অনুমোদন পায়- গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট-বিআরটি-গাজীপুর-এয়ারপোর্ট। রাজধানীর সঙ্গে সরাসরি আশপাশের এলাকা ও বৃহত্তর ময়মনসিংহসহ উত্তরাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতকে স্বাচ্ছন্দ্য, নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করতে বাস র্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্প (বিআরটি-৩) হাতে নেয়। প্রকল্পটি ২০১৬ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা শেষ হয়নি। নির্মাণাধীন বিআরটি-৩ নির্ধারিত সময়ের চেয়ে পাঁচ বছর পিছিয়ে যাওয়ায় মহাসড়কের এই যানজটকে এখন অন্তহীন বলেই মনে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্পটি শুরু করা হয়েছিল দুর্বল সম্ভাব্যতা যাচাইকরণ গবেষণার উপর ভিত্তি করে। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ত্রুটি সংশোধন করতে বারবার নকশায় পরিবর্তন আনতে হচ্ছে। এর ফলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে এ প্রকল্পের খরচ প্রাক্কলন করা হয়েছিল ২ হাজার ৩৯.৮৪ কোটি টাকা। সেই খরচ এখন দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে ৮ হাজার ২৬৮ কোটি টাকায় ঠেকেছে।
গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কের পাশে পোশাক শিল্প ছাড়াও বেক্সিমকো এবং প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের মতো অনেক শিল্পগোষ্ঠীও গাজীপুরে শিল্প পার্ক স্থাপন করেছে। সরকারও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য শহরটিতে শ্রীপুর ইকোনমিক জোন এবং বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি স্থাপন করছে। গাজীপুরে তিনটি মোবাইল ফোন কোম্পানি ওপো, শাওমি ও টেকনো— অ্যাসেম্বলিং প্ল্যান্ট রয়েছে। ২০.৫ কিলোমিটার বাস র্যাপিড ট্রানজিট গত আট বছর ধরে নির্মাণাধীন। এর ফলে ঢাকা-গাজীপুর মহাসড়ক অনেকটাই সংকীর্ণ হয়ে গেছে। ঢাকা-গাজীপুর হাইওয়ের অনেক অংশই ভাঙাচোরা। বেশিরভাগ সময়ই এ মহাসড়কে যানজট লেগে থাকে। ফলে বিদেশি ক্রেতা ও কোম্পানির নির্বাহীরা কারখানা পরিদর্শনে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। দেশের অন্যতম প্রধান পোশাক কারখানা স্টাইলিশ গার্মেন্টস লিমিটেডের চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন চৌধুরী। কিছুদিন আগে এক সকালে তার গাজীপুরের কারখানায় একজন মার্কিন ক্রেতার সঙ্গে বৈঠক ছিল। কিন্তু ঢাকা-গাজীপুর মহাসড়কের যানজটের কারণে ওই ক্রেতা সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন। ফলে রাজধানীর গুলশান এলাকায় একটি পাঁচ তারকা হোটেল বুক করে বৈঠক করতে হয় সালাউদ্দিনকে। সালাউদ্দিন বলেন, উনি আমার কারখানায় গেলে আমরা তাকে সবকিছু ঘুরিয়ে দেখাতে পারতাম।
উত্তরা এলাকা থেকে প্রতিদিন গাজীপুরে যান ফোন সংযোজনকারী প্ল্যান্টের অনেক চীনা কর্মকর্তারা। তারা জানান, প্রতিদিন কর্মস্থলে যেতে এবং বাসায় ফিরতেই দিনের অনেকটা সময় খরচ হয়ে যায় তাদের। জরাজীর্ণ রাস্তার কারণে কারখানা থেকে কাঁচামাল এবং উৎপন্ন পণ্য পরিবহন বিঘ্নিত হচ্ছে। এর ফলে বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন খরচ, পণ্য উৎপাদনে সময়ও লাগছে বেশি। কখনও কখনও পোশাক কারখানার মালিকদেরও রাস্তায় বিলম্ব হওয়ার কারণে চালানের সময়সীমা মিস করে বসার উপক্রম হয়। অনেক কারখানা সময়ের ঘাটতি পোষানোর জন্য সারা রাত কাজ করে। মহাসড়কে যানজটের কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হয় কারখানার শ্রমিকদেরও। নির্মাণকাজের গতি বাড়ানোর জন্য ব্যবসায়ীরা বাস র্যাপিড ট্রানজিট বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোকে রাতের বেলা কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন।
বহুজাতিক কোম্পানি নেসলে বাংলাদেশের কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক নকিব খান বলেন, তীব্র যানজট এবং ধূলিময় পরিবেশের জন্য গাজীপুরে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান চালানো নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি জানান, তাদের কারখানা গাজীপুরে হলেও তাদের অধিকাংশ কর্মচারী প্রতিদিন ঢাকা থেকে সেখানে যান। নকিব খান আরও বলেন, অফিসে পৌঁছাতে প্রতিদিন আমার প্রায় চার ঘণ্টা সময় লাগে। এই দীর্ঘ যাত্রা একটা গুরুতর মানসিক চাপ।
প্রকল্প এলাকায় সকাল থেকে সন্ধ্যা, রাত থেকে ভোর। সব সময়েই চোখে পড়ে ধুলাবালির রাজত্ব। যানবাহনের সার্বক্ষণিক চলাচলে ধুলাবালি থেকে মুক্তি মিলে না। গাজীপুর থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যে কোন সময় সেখানে গেলেই দেখা যায় ধুলার দাপটে সবাই দিশেহারা। আব্দুল্লাহপুর থেকে হাউস বিল্ডিং পর্যন্ত ধুলা আচ্ছন্ন অসহনীয় পরিবেশের শিকার হতে হয় সবাইকে।
হামিদা বেগম নামের একজন চাকরিজীবী বলেন, প্রতিদিন যাওয়া আসা মিলিয়ে ৪-৫ ঘণ্টা লেগে যায়। এত ধুলা বালি যে শুধু গায়ের ড্রেস না, অনেক সমস্যা হয়- যেমন শ্বাসকষ্ট। সামান্য বৃষ্টি হলেই মনে হয় নদী পার হচ্ছি। যানজটের যে অবস্থা হয় তা অবর্ণনীয়।
দীর্ঘ আট বছর ধরে এই অবস্থা চলার কারণে গত কয়েক মাস আগে ওই এলাকার পরিবহন ব্যবসায়ীরা ধর্মঘটের ডাক দেন। গাজীপুরের সালনা থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ধীরগতির উন্নয়ন কর্মকান্ডের কারণে জনদুর্ভোগ নিরসনে দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণের দাবিতে ময়মনসিংহ বিভাগে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট ডাকে পরিবহন মোটর মালিক সমিতি। পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, ধীরগতির উন্নয়ন কর্মকান্ডের কারণে গাজীপুরের সালনা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে পরিবহন চলাচলে এক রকম অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। ময়মনসিংহ থেকে গাজীপুরে মাত্র এক ঘণ্টায় পৌঁছানো গেলেও মহাখালী পর্যন্ত যেতে সময় লেগে যাচ্ছে ৩-৪ ঘণ্টা। এ অবস্থা নিরসনের দাবিতেই তারা এ ধর্মঘট ডাকেন। পরে সমস্যা সমাধানের আশ্বাসে তা প্রত্যাহার করে নেন তারা।
এভাবে আর কত আশ্বাসে বিশ্বাস রাখতে হবে সেটারও নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না প্রকল্প পরিচালক। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, কেন বার বার প্রকল্পের সময়সীমা অতিক্রম করে গেলেও কাজ শেষ হয় না। অথচ এটি সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার প্রকল্প হলেও মানুষের ভোগান্তির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সমন্বয়হীনতা, বার বার নক্সা বদল, নতুন নতুন অবকাঠামো যোগ আর ঠিকাদারের গাফিলতির দরুণ প্রকল্পের এহেন পরিণতি। চার বছর মেয়াদী এই প্রকল্প ৮ বছরেও শেষ করা সম্ভব হয়নি। সবশেষ বাড়ানো মেয়াদ অনুযায়ী এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২২ সালে।
যানজটের বিষয়ে গাজীপুর মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (ট্রাফিক) মো. ফয়জুল ইসলাম বলেন, বিআরটির নির্মাণকাজের জন্য রাস্তার অনেকটা তাদের ব্যবহার করতে হচ্ছে। আমরা প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সাথে যোগাযোগ রেখে কাজ করছি।
ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, যানযট শুধু টঙ্গী ৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে হচ্ছে। গাজীপুর চৌরাস্তার মোড়ে হতো, কিন্ত সেখানে এখন স্বাভাবিক। টঙ্গী এলাকার কাজ শুরু হয়ে গেছে। এ অংশের কাজ এপ্রিলের মধ্যে শেষ হলে আমরা এখানে ছয় লেনের সড়ক পাবো। এছাড়া বিআরটির নির্মাণকাজের জন্য বিভিন্ন সময় রাস্তার এক লেন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। সব কাজ ডিসেম্বরের মধ্যে পুরোপুরি শেষ হবে তখন এয়ারপোর্ট-গাজীপুর রোডে চলাচলে ভোগান্তি পোহাতে হবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন