শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

পান্দেনামার রচয়িতা হযরত খাজা ফরিদউদ্দীন আত্তার রহ.

মুহাম্মদ জিয়াউল হক | প্রকাশের সময় : ১০ মার্চ, ২০২২, ১২:০৩ এএম

পৃথীবিতে যুগে যুগে প্রদীপ্ত সূর্যের আলোকচ্ছটা নিয়ে আবির্ভাব ঘটে বহু মহামনীষীদের। যাদের চিন্তা-চেতনা- ইসলামি ‘তাহযিব-তামাদ্দুন’, সভ্যতা, সংস্কৃতি বিকাশে বিশ্বজুড়ে নবজাগরণ তৈরি করেছে। মানুষ পেয়েছে কলুষিত অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক করার পাথেয়। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন, পারস্যের কবি হযরত খাজা ফরিদউদ্দীন আত্তার রহ.। তাঁর রচিত ‘পান্দেনামা’ নামক কাব্যপুস্তকটি যুগ যুগ ধরে মাদরাসার পাঠ্যতালিকার অন্তর্ভূক্ত হয়ে আছে। এখন অবশ্য ফার্সি ভাষার চর্চা দিন দিন কমে যাচ্ছে। যদ্দরুন এ কিতাবটিও এখন কমসংখ্যক প্রতিষ্ঠানের সিলেবাসভুক্ত। থাকলেও এর কিয়দংশ পড়ানো হয়। কিতাবটির প্রতিটি কাব্যের পঙ্তিতে রয়েছে মূতিতূল্য উপদেশমালা। আল্লাহপ্রেমিক বান্দাদের জন্য ‘আত্মার খোরাক’। অধ্যায়গুলোর বিন্যাস খুবই চমৎকার। তাতে রয়েছে আবেগময়ী ‘দিলকাশ’ একটি ‘প্রার্থনা’ অধ্যায়। যার প্রথম দুটি পঙ্তি এমন-“বাদশাহা যুরমে মা-রা দর গুজার মাগুনাহগার রে-মেতু আ মরজেগার” অর্থ: হে বাদশাহ! আমাদের অপরাধগুলো ক্ষমা কর, আমরা পাপী, তুমি মার্জনাকারী। এ কিতাবটিতে তাঁর ‘মাওলার ইশক’ বা আল্লাহপ্রেমে গভীর ধ্যান-মগ্নতার বিষয়টি প্রতিভাত হয়েছে। যার ব্যপারে জগতবিখ্যাত গন্থ ‘মসনবী’র রচয়িতা আল্লামা জালালউদ্দিন রুমী রহ. লেখেন:- (অনুবাদ) “প্রেমের সপ্তশহর ঘুরেছেন আত্তার, আর আমরা এখনো পড়ে আছি এক ক্ষুদ্র গলিপথে।” আধ্যাত্মিক জগতের পুরোধা আল্লামা রুমী রহ. মতো ব্যক্তি উপলব্ধি করতে পেরে ছিলেন, আত্তার রহ. আধ্যাত্মিক সাধনায় আত্মশুদ্ধির পথে কত দূর অগ্রসর হয়ে ছিলেন। তাঁর মূল নাম ছিল আবু হামিদ। পিতা আবু বকর ইবরহীম। লেখালেখির ক্ষেত্রে ফরিদউদ্দীন নাম ব্যবহার করতেন। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন আতর ব্যবসায়ী সেই থেকে আত্তার নামে বেশি প্রসিদ্ধি লাভ করেন। ৫৪০ হিজরি মুতাবিক ১১৪৫ খ্রিস্টাব্দে ইরানের খোরাসান প্রদেশস্থ প্রসিদ্ধ শহর নিশাপুরের ‘কিদকিন’ পল্লিতে এক সমভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। ওই সময় সেলযুকদের হুকুমত চলত। আত্তার শব্দের অর্থ: সুগন্ধি বিক্রেতা বা ওষুধ বিক্রেতা। এখানে উদ্দেশ্য হলো ‘অভিজ্ঞ হাকীম’। তাঁর পিতা পেশায় ছিলেন, আতরবিক্রেতা। শৈশবে তিনি স্বীয় পিতার আতরের ব্যবসায় সহযোগিতা করতেন। এই সময়ে চিকিৎসাশাস্ত্রসহ প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। প্রয়োজনীয় শিক্ষা শেষে তিনি আতরের ব্যবসায় মনোনিবেশ করেন। পাশাপাশি চিকিৎসা সেবাও ব্যাপকভাবে আঞ্জাম দিতেম। দূরদূরান্ত থেকে রোগিরা ছুটে আসতেন। কথিত আছে, প্রতিদিন প্রায় ৫০০ রোগী তার কাছ থেকে চিকিৎসা নিতেন। রোগীদের তিনি তার নিজের তৈরি ওষুধ দিতেন। তাছাড়া তিনি ফার্সিভাষার একজন আল্লাহভীরু মুসলিম কবি, সাহিত্যিক ও সুফি-সাধক ছিলেন। তাঁর কবিতা সমকালীন বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করেছিলো। আধ্যাত্মিক জ্ঞানেও ছিলো তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য। তাঁর জ্ঞানের প্রভাব, বৈশিষ্ট্য আজও পারস্যের কবি, সাহিত্যিক ও সুফি-সাধকদের মাঝে পরিলক্ষিত হয়। ফরিদউদ্দীন আত্তার রহ. অন্তত ৩০টি বই লিখে গেছেন। বিখ্যাত বইগুলোর মধ্যে ‘পান্দেনামা’ ‘তাজকিরাতুল আউলিয়া’ ‘মানতিকে তাইয়ার’ বা ‘পাখির সমাবেশ’ উল্লেখযোগ্য। দিক্ষাগ্রহণ: আত্তার রহ. অল্পবয়স থেকেই তাঁর পিতার মুর্শিদ প্রসিদ্ধ বুজুর্গ হযরত কুতুবুদ্দীন হায়দার রহ. থেকে ফয়েয হাসিল করেন। আত্মশুদ্ধির মেহনত করে অনেক গভীরে পৌঁছে যান। তিনি তাঁর যৌবনের বড় একটা অংশ ‘ইলম’ অন্বেষণ ও আধ্যাত্মি সাধনা এবং স্বীয় শায়েখের সাহচর্যে অতিবাহিত করেন। মোল্লা আব্দুর রহমান জামী রহ. ‘নফআতুল আনাস’ গ্রন্থে (পৃ: ৩৭৪) আত্তার রহ. এর একটি ঘটনা উল্লেখ করেন, একদিন খাজা ফরিদউদ্দিন আত্তার তার দোকানে বসে আছে। এমন সময় একজন দরবেশরুপি ভিক্ষুক এসে তাঁর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকবার বলছেন, ‘শাই আল্লাহ’! ‘শাই আল্লাহ’! অর্থাৎ আল্লাহর ওয়াস্তে কিছু দান কর। আত্তার সাহেব তখন দোকানের কাজে খুবই ব্যস্ত। এই জন্য ভিক্ষুকের কথার প্রতি বিন্দুমাত্র কোনো ভ্রুক্ষেপ করেননি। সহসা ভিখারি বলে উঠল, হে শায়খ! আশ্চর্য লোক আপনি! আমার দিকে একবার ফিরেও তাকালেন না। আল্লাহ জানেন, কিভাবে আপনার মৃত্যু হবে। আত্তার রহ. উত্তর দিলেন। তুমি যেভাবে মরবে! -‘সত্যিই কী আমার মত মরবে।’ এই বলে দরবেশরুপি ভিখারির হাতে থাকা কাঠের পিয়ালাটি মাথার নিচে রেখে উচ্চস্বরে ‘আল্লাহ’ বলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। মাটিতে পড়ে আছে ভিখারির নিথর দেহ। আত্তার রহ. চোখের সামনে এই আকস্মিক মৃত্যু দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ়, এই দৃশ্যটি তাঁকে খুবই প্রভাবিত করল। জীবনের মোড় পাল্টে গেলো। দুনিয়াবী সব ব্যস্ততা রেখে একমাত্র আল্লাহর পথে বের হয়ে গেলেন। এই ঘটার পর থেকে আত্তার রহ. এর অন্তরে আল্লাহর ‘ইশকে’র আগুন দাও দাও করে জ¦লে উঠে। আত্তার রহ. এর কিতাবাদি থেকে জানা যায় তিনি পার্থিব জগতের পিছে পড়েন নি। আল্লাহর মা‘রেফাতের উচ্চস্তর হাসিলের জন্য দীর্ঘ সাধনা করেছেন। যুবক বয়সেই হজব্রত পালনের সৌভাগ্য অর্জন করনে। তিনি আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে দীর্ঘদিন ভারতীয় উপমহাদেশসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশ সফর করেন। তাঁর এ সফর ছিলো জ্ঞান অন্বেষণের জন্য। গবেষণার মাধ্যমে যে জ্ঞান অর্জন করেছেন, তা কাব্যিক আকারে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। কালজয়ী এই মহান মনীষী ১২২০ খ্রিস্টাব্দে তাতারদের হাতে নির্মমভাবে শহিদ হন।এই ক্ষণজন্মা মহান মনীষীর কবর ইরানের নিশাপুরে অবস্থিত। কবরটির চারপাশ দেয়াল বেষ্টিত। সবুজ উদ্যান। অন্তর প্রশান্তিদায়ক পরিবেশ। আল্লামা তকী উসমানী সাহেব ইরানের নিশাপুরের সফরনামায় লিখেছেন- ‘যেখানে খাজা আত্তার রহ. শায়িত, সেখানে যে সুখ ও স্বস্তি অনুভব করেছি তা পৃথিবীর খুব কম জায়গাতেই অনুভূত হয়েছে।

লেখক : ভাইস প্রিন্সিপাল. মদিনা মাদরাসা, শ্রীরামপুর, রায়পুরা, নরসিংদী।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন