শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

বিকৃত সংস্কৃতি র‌্যাগ ডে’র ভয়াবহতা ও আমাদের করণীয়

মাওলানা মুহাম্মদ আনিসুর রহমান রিজভি | প্রকাশের সময় : ১০ মার্চ, ২০২২, ১২:০৩ এএম

পূর্ব প্রকাশিতের পর

অন্যায় ও সীমালঙ্গনের কাজে বাধা প্রদান করা ঈমানী দায়িত্ব:
অন্যায় আচরণ, জুলুম, নির্যাতন, খারাপ ও সীমালঙ্গনের কাজে বাধা প্রদান করা একজন মুমীনের ঈমানী দায়িত্ব। একজন মুসলমান তাঁর সামনে সংঘটিত অন্যায় কাজ দেখলে সাথে সাথে ঐ কাজ থেকে অন্যায়কারীকে বাধা প্রদান করবে এবং নির্যাতিত ব্যক্তিকে নিরাপত্তা প্রদানের চেষ্টা করবে।

যেমন: হাদিস শরিফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, অনুবাদ: হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবীজি সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তোমাদের মধ্যে কেউ যদি খারাপ কাজ করতে দেখে, সে যেন তাকে হাত দ্বারা তা প্রতিহত করে, আর যদি হাত দ্বারা প্রতিহত করতে সক্ষম না হয়, তাহলে সে যেন তাকে বুঝায়। আর বোঝাতেও যদি সক্ষম না হয়, তাহলে সে যেন অন্তরে তার প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করে। আর ঘৃনা করাটা দুর্বল ঈমানদারদের পরিচয়। (মুসলিম শরীফ: হাদিস নাম্বার: ৪৯)

আলোচ্য হাদীসটি থেকে একথা প্রমাণিত হয়েছে, কখনো অন্যায় ও অশ্লীল কাজকে সাপোর্ট করা যাবে না বরং সে কাজকে হাত দ্বারা প্রতিহত করতে না পারলে, মুখ দিয়ে প্রতিহত করতে হবে অর্থাৎ ঐ ব্যক্তিকে বোঝাতে হবে। আর যদি বুঝাতেও সক্ষম না হয়, তাহলে অন্তরে ঐ ব্যক্তিকে ঘৃণা করতে হবে।

অন্যায় কাজকে সমর্থন করাও অন্যায়:
অন্যায় কাজকে সমর্থন করাও অন্যায়। অনুপস্থিত ব্যক্তি অন্যায় কাজকে সমর্থন করলে সেও অন্যায়কারী হিসেবে সাবস্ত হবে এবং অন্যায়কে সমর্থন করার কারণে গুনাহগার হিসেবে বিবেচিত হবে। যেমন হাদিস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, আনুবাদ: আল ওরস ইবনে আমিরাহ আল-কিনদী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত, নবীজি সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, কোনো স্থানে যখন অন্যায় সংঘটিত হয়, তখন সেখানে উপস্থিত ব্যক্তি তাতে অসন্তুষ্ট হলে, সে অনুপস্থিতিদের মতোই গণ্য হবে অর্থাৎ তার গুনাহ হবে না। আর যে ব্যক্তি অন্যায় কাজের স্থান থেকে অনুপস্থিত হয়েও তাতে সন্তুষ্ট হয়, সে অন্যায়ে উপস্থিতদের অর্ন্তভুক্ত হবে। (সুনানু আবু দাউদ, হাদিস নাম্বার ৪৩৪৫)

বিদায় অনুষ্ঠান বনাম র‌্যাগ ডে নামক অপসংস্কৃতি:
র‌্যাগ ডে বলতে সর্বপ্রথম আমাদের দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে কিছু বেপরোয়া ও বিপথগামী তরুণ-তরুণী কর্তৃক তাদের মাস্টার্স সমাপনী পরীক্ষার পর দিন টি-শার্ট বিতরণ, নাচ-গান, ঢোল-তবলা, উদ্যমতা, বেহায়াপনা, উলঙ্গপনা ও রং মাখামাখি ইত্যাদি কার্যবলিকে বুঝাত। রং মাখামাখি এটা এতই জঘন্যতম ছিল যে, সামনে যাকে পেত শিক্ষক, ছাত্র এবং পথচারীর সকলকে তারা রং মেখে দিত যার কারণে সাধারণ মানুষ বিব্রতাবস্থায় পড়ে যেত। এসব গ্রিক কালচার আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে দিন দিন বেড়েই চলছে। এটার জন্য অনেক অর্থ, শ্রম, সময় নষ্ট করছে বিপথগামী তরুণ-তরুণীরা। এখানে তারা সুস্পষ্ট গুনাহের কাজে লিপ্ত। অনেকেই আবার এই সময়টাকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে গার্লফ্রেন্ডের সাথে ডেটে যাওয়ার অপেক্ষা করত। আবার অনেক এমন তরুণ-তরুণী রয়েছে যারা, এটাকে সমর্থন করে না এবং পালন ও করেনা। তাদেরকে কৃতজ্ঞতার সাথে ধন্যবাদ জানাই।

র‌্যাগ ডে নামের এই বেহায়াপনাই ইভটিজিং ও ব্যভিচারের অন্যতম কারণ:
এই র‌্যাগ ডে’কে কেন্দ্র করে বর্তমানে আমাদের দেশে অনেক মেয়ে ইভটিজিং এর শিকার হচ্ছে। বিশেষ করে মেয়েরা এক্ষেত্রে চরমভাবে অপমানিত ও অপদস্ত। এ ক্ষেত্রে নারীদের ক্ষতিই বেশি হয়ে থাকে। তরুণরা অপরাধ করলেও তাদের কোন বিপদে পড়তে হয় না, যেমনিভাবে একজন তরুণীকে নির্যাতিত ও অপদস্থ হতে হয়। তরুণীদের মধ্যে আবার অনেকেই স্বেচ্ছায় তাদেরকে পর-পুরুষের কাছে বিলিয়ে দেয়। আবার অনেক প্রেমিক যুগলও রয়েছে যারা এসব দিবসকে কেন্দ্র করে আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রাখে সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য। পশ্চিমা সংস্কৃতির এই নগ্ন আগ্রাসন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ গুলোকে কলুষিত করেছে। অপরিপূর্ণ ড্রেস, উদ্যাম নৃত্য, অশুভনীয় স্লোগান, শিক্ষক, পথচারী সহ যাকে সামনে পাবে তাকে রং মারা, বিশ্রী অঙ্গভঙ্গী প্রাকাশ করাই ছিলো র‌্যাগ ডে’র মূল কার্যক্রম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগ ডে নামক এই অপসংস্কৃতিটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করায় কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই।

বিশ্রী ও অশ্লীল ভাষায় মন্তব্য:
র‌্যাগ ডে’কে কেন্দ্র করে সচরাচর ছাত্র-ছাত্রী সকলের জন্য টি-শার্ট এর ব্যবস্থা করা হয়। আর তাঁরা এসব টি-শার্ট পরিধান করে থাকেন। টি-শার্টে একজন অপরজন সম্পর্কে নানা মন্তব্য লিখে থাকেন। এইসব মন্তব্যের ভাষা খুবই বিশ্রী ও অশ্লীল যা খুবই নিন্দিত ও বর্ণনাতীত। এমন সব শব্দ তারা সেখানে লিখে থাকেন, যা একজন সুস্থ মস্তিস্কের অধিকারী সম্পন্ন মানুষ উচ্চারণও করতে পারে না। এইসব কথা থেকে যৌন আবেগ ও অনুভূতি প্রকাশ পায়। যা একজন তরুণ-তরুণীকে যেনা ব্যভিচার দিকে ধাবিত করে।

শব্দ দূষণ ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাজে ব্যাহত সৃষ্টি:
গান-বাজনা, নাচানাচি, উলঙ্গপনা ও উদ্যম নাচানাচির মাধ্যমে তারা আশেপাশে পরিবেশকে নষ্ট করে থাকে। এ র‌্যাগ ডে টা নারী-পুরুষের অবৈধ মিলন মেলায় পরিণত হয়। সেখানে তারা একে অন্যের প্রতি যৌন অনুভূতি জাগে এমন বিশ্রী গান দিয়ে নাচানাচি ও রং মাখামাখিতে মেতে ওঠে, যা চরমভাবে ঘৃণিত ও অত্যন্ত গর্হিত। তরুণরা তরুণীদের গায়ে হাত থেকে, এমনকি একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ছবি তোলা ইত্যাদি জগন্যতম কাজ করে। তারা এমন শব্দ দূষণ করে, যা অন্যান্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের কাজে চরম ব্যাহত সৃষ্টি হয়, এমনকি সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা দিতেও তাদেরকে হিমশিম খেতে হয়। সেই সময় মানবিক দৃষ্টিকোণটাও তাদের নাচানাচি, ঢোল-তবলার মধ্যে থাকে না। এই সময় তাদেরকে কেউ বাধা দিলে, তার উপর সবাই ঝাপিয়ে পড়ে এবং তাকে হেনস্তা করে ছাড়ে ।

র‌্যাগ ডে বন্ধে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য:
এই র‌্যাগ ডে’কে বন্ধ করা বর্তমান সময়ের অন্যতম একটি দাবি। এখনই যদি এই র‌্যাগ ডে নামক অপসংস্কৃতিকে বন্ধ করা না যায়, তাহলে ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের নীতি-নৈতিকতা বলতে কিছু থাকবে না। র‌্যাগ ডে বন্ধে নিমোক্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরী।

র‌্যাগ ডে নামক অপসংস্কৃতি বন্ধ করার সময়ের দাবি:
বর্তমান যুব সমাজের জন্য এক মারাত্মক জঘন্যতম কুসংস্কার ও সীমালঙ্ঘনের কাজ হলো র‌্যাগ ডে নামক এই অপসংস্কৃতি। এই অপসংস্কৃতি থেকে যুব সমাজকে দূরে রাখতে না পারলে অতিসত্বর আমাদের যুব সমাজ অশ্লীল, গর্হিত, নির্লজ্জ, বেহায়াপনামূলক ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই এ অপসংস্কৃতি থেকে আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে এখনই যদি সচেতন ও সাবধান করতে হবে। সময়মতো সচেতন ও সাবধান করতে না পারলে সেটা আমাদের জন্য চরম অশনি সংকেত যা পুরো জাতিকে কৈফিয়ত দিতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নীতি-নৈতিকতা বলতে কিছুই থাকবে না।

অভিভাবকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য:
অভিভাবকের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো তাদের সন্তানদেরকে নৈতিক শিক্ষা ও চরিত্র গঠনে ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে গুরুদায়িত্ব পালন করা। তারা সমাজে বিভিন্ন অমানবিক, অন্যায় আচরণ, অপরাধমূলক এবং বেহায়াপনা ও নির্লজ্জতার কাজ থেকে তাদেরকে বারণ করা এবং তাদেরকে ইসলাম ও নীতি-নৈতিকতার বিষয়ে মৌলিক শিক্ষা দেয়া এবং এসব গর্হিত কাজের কুফল সম্পর্কে তাদেরকে ভালোভাবে জানিয়ে দেয়। তাদের সন্তান স্কুলে যাওয়ার নাম দিয়ে কোথায় যায়, কী করে, কার সাথে মিশে, সবকিছুর সুষ্ঠু তদারকি এবং খেয়াল রাখা। পড়াশোনার বিষয়ে সার্বিক খবরা-খবর নেয়া। প্রয়োজনে শিক্ষক মহোদয়ের সহযোগিতা কামনা করা।

শিক্ষক মহোদয়ের মহান দায়িত্ব ও কর্তব্য:
শিক্ষক মহোদয়গণ পাঠদানের পাশাপাশি ছাত্রদেরকে নৈতিকতার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করবেন। যাতে কোন ছাত্র-ছাত্রী ক্যাম্পাসের ভিতরে বাহিরে কোন রকম অন্যায়, অশ্লীল, বেহায়াপনা, গর্হিত কাজ ও অপরাধমূলক কাজে জড়াতে না পারে। সেদিকে লক্ষ্য রেখে তাদেরকে শিক্ষাদান ও প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করবেন। ছাত্র-ছাত্রীরা ক্যাম্পাসে এসে কি করছে, কার সাথে মিশছে, ছেলে ও মেয়ে একসাথে কোথাও যাচ্ছে কিনা ইত্যাদি বিষয়ে গভীরভাবে দৃষ্টি দিবেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে র‌্যাগ ডে নামক এই অপসংস্কৃতি যাতে অদূর ভবিষ্যতে কেউ করার সাহস না পায়, সে ব্যাপারে শিক্ষক মহোদয়গণকে জোরালো ভূমিকা ও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

প্রতিষ্ঠান প্রধানের দায়িত্ব ও কর্তব্য:
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানের দায়িত্ব হলো তিনি শিক্ষার্থীদের যথাসম্ভব সকল সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে শ্রেণি পাঠদান চালু রাখবেন। শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধার কথা বিবেচনা করবেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করবেন। প্রয়োজনে অভিভাবক ও শিক্ষকদের সাথে মতবিনিময় করবেন। পড়াশোনার মানোন্নয়নের জন্য সর্বদা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। প্রয়োজনে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের নিয়ে পরামর্শ সভার আয়োজন করবেন। তাদের আচরণ ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করবেন। প্রয়োজনে কয়েকজন শিক্ষককে দায়িত্ব বন্টন করে দিবেন। শিক্ষা সমাপনীতে র‌্যাগ ডে’র অনুমতি কখনো প্রদান করবেন না। এবং তাদেরকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন। (চলবে)

লেখক: সহকারি মাওলানা, চরণদ্বীপ রজভীয়া ইসলামিয়া ফাযিল (ডিগ্রি) মাদরাসা বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন