করোনাকালীন অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা ও স্থবিরতা কাটিয়ে নতুন করে সবকিছু চালু হলেও তার নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে যে প্রচেষ্টা তা পুরোপুরি গতি পাচ্ছে না। দেশের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং অর্থনৈতিক গতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধি কিছুটা হলেও ধীর হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্ব গতি মানুষের জীবনকে অনেকটা দুর্বিষহ করে তুলেছে। খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষার মত মৌলিক চাহিদা পূরণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। করোনার আগে থেকেই আবাসিক গ্যাস সংযোগসহ নানাবিধ কারণে আবাসন শিল্পে মন্দা দেখা দিয়েছে। এ খাতের উদ্যোক্তাদের হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ, লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। করোনাত্তোর সময়ে সরকারি-বেসরকারি অবকাঠামো উন্নয়নে যে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসার কথা তা এখনো কাক্সিক্ষত মাত্রায় গতি পায়নি। নির্মাণ সামগ্রীর অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধির কারণে সৃষ্ট সংকট আবাসন খাতকে ক্ষতির মুখে ঠেলে দিয়েছে। আবাসন শিল্প সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকেও এ খাতের উন্নয়নে বিভিন্ন দাবী-দাওয়া তুলে ধরা হয়েছে। এসব দাবীর সুরাহা করা যায়নি। উল্টো নির্মাণ সামগ্রীর অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি এ খাত সংশ্লিষ্টদের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে জানা যায়, রডের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প স্থবির হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত গত একমাসে প্রতি টন রডের দাম ১০ থেকে ১৪ হাজার টাকা বেড়ে চলতি সপ্তাহে ৯০ হাজার টাকায় উঠেছে। এর সাথে পাল্লা দিয়ে সিমেন্ট এবং ইট-পাথর-বালির দামও বেড়ে চলেছে।
চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে নির্মাণ শিল্পের রড ও সিমেন্ট শিল্পের আগাম কর প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই এ আবাসন ও অবকাঠামো খাতের নির্মাণব্যয় কমে আসার কথা। অনেক আগে থেকেই নির্মাণ সামগ্রী সংশ্লিষ্ট উৎপাদকরা সিন্ডিকেট করে দরবৃদ্ধির কারসাজি করলেও এখন অজুহাত হিসেবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে দামবৃদ্ধির কথা বলছে। মুনাফালোভী এই সিন্ডিকেটের কারণে আবাসন শিল্পের বিকাশের জন্য অশনি সংকেত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি ওপেকের উৎপাদন বৃদ্ধি ও মূল্য কমিয়ে আনার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে। করোনাকালে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্য রেকর্ড পরিমান হ্রাস পাওয়ার মধ্যেও মূল্য সমন্বয়ের নামে আমাদের দেশে একাধিকবার জ্বালানির মূল্য বাড়ানো হয়েছে। জ্বালানির মূল্য বাড়লে উৎপাদিত সব পণ্যের উপর তার প্রভাব পড়ে। করোনার কারণে অনেক মানুষ কর্মসংস্থান হারিয়েছে। দেশে কোটি কোটি মানুষের আয় কমে গেছে। এহেন বাস্তবতায় কর্মসংস্থানের জন্য আবাসন খাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ খাতের সঙ্গে বেকওয়ার্ড লিঙ্কেজ হিসেবে অনকেগুলো খাত জড়িত। এসব খাতে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান জড়িয়ে আছে। এ প্রেক্ষিতে, নির্মাণ সামগ্রীর দামবৃদ্ধি খাতটিকে স্থবির করে দিয়েছে। এর সাথে যুক্ত অন্য খাতগুলোও বন্ধ হওয়ার উপক্রম। অসংখ্য মানুষ বেকার হয়ে যেতে পারে। দেশের সার্বিক অর্থনীতির জন্য তা নতুন সমস্যা হয়ে দেখা দেবে। সাধারণ মানুষের আবাসন সংকট, আবাসন খাতে হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ, লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান এবং সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা সঠিক সময়ে ও সঠিকভাবে বাস্তবায়নের প্রতি লক্ষ্য রেখে এ খাতের দিকে সরকারকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়নে দুর্নীতি, স্বচ্ছতার অভাব নতুন কিছু নয়। এসব কারণে বরাবরই উন্নয়ন ব্যয় বাড়ে। রড-সিমেন্ট, পাথর-বালির মূল্যবৃদ্ধির কারণে প্রায় সব ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়বে। অনেক ক্ষেত্রে ব্যয় সংকুলান করতে না পারার কারণে প্রকল্পের কাজ স্থবির হয়ে পড়বে। উন্নয়ন প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদাররাও এ আশঙ্কা করছেন। আবাসন শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্প শুরুর আগেই তাদের ফ্ল্যাট বিক্রি করতে হয়। এখন নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধিতে আগের দামে তা দেয়া সম্ভব না-ও হতে পারে। এতে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়েরই খরচ বৃদ্ধি পাবে। ফ্ল্যাট বিক্রি কমে যাওয়ার পাশাপাশি এর সাথে সংশ্লিষ্ট খাতগুলোও স্থবির হয়ে পড়বে। ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা মনে করছেন, নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে উৎপাদকদের কারসাজি রয়েছে। এ ধরনের কারসাজি বন্ধে সরকারের তাদারকি প্রয়োজন। নির্মাণ সামগ্রীর দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে। এ সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে নির্মাণ সামগ্রীর দাম একটি যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। আবাসন খাতকে চালমান রাখতে জরুরিভিত্তিতে এ পদক্ষেপ নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন