ইউক্রেন-রাশিয়া দ্ব›েদ্বর মধ্যে পশ্চিমা গণমাধ্যগুলো ইউক্রেনীয়দের অসহায়ত্বের খবর ফলাও করে প্রচার করছে। ইউক্রেনের প্রতি সংহতি এবং মানবতা প্রদর্শন করতে সমগ্র ইউরোপ, বিশেষ করে পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, চেক প্রজাতন্ত্র এবং স্লোভাকিয়া, যারা একসময় মস্কো-সমর্থিত ওর্য়াস চুক্তির অংশ ছিল, তারা ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের গ্রহণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
দেশগুলো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কড়া সমালোচনা করার সাথে সাথে ইউক্রেনকে সবরকম সাহায্যের অঙ্গীকার করেছে। তবে, সম্প্রতি ইউরোপীয়দের কথিত মানবিক আচরণের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ইউরোপীয় সভ্যতার প্রকট বর্ণবাদ ও মুসলিম বিদ্বেষের চিত্রটিও সামনে আসতে শুরু করেছে। ইউক্রেন সীমান্তে থাকা পোল্যান্ড সম্প্রতি অ-ইউক্রেনীয় এবং অশে^তাঙ্গ অভিবাসী এবং উদ্বাস্তুদের প্রতি অমানবিক আচরণের জন্য মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দ্বারা সমালোচিত হচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সাম্প্রতিক তথ্য থেকে জানা যায় যে, দেশটি মূলত মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকা থেকে আগত আশ্রয়প্রার্থীদের হিমশীতল তাপমাত্রার মাধ্যমে হত্যা করার জন্য বেলারুশ সীমান্তের জঙ্গলের দিকে তাড়িয়ে দিচ্ছে এবং জল কামান ব্যবহার করছে এবং এপর্যন্ত ১৯ জনের মৃত্যু ঘটিয়েছে।
অবশ্য, পোলিশ বর্ডার গার্ডের মুখপাত্র কাতারজিনা জেডানোভিচ জোর বলেছেন যে, এটি তাদের নয় বরং বেলারুশিয়ানদের দোষ। একইভাবে, গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মাধ্যমে ক্রেমলিনের উপর চাপ সৃষ্টির বৃহত্তর প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘তারা এই লোকদের পরিচালনা করে থাকে।’ তার এই দাবিতে অবাক হওয়া কিছু নেই। কারণ, পশ্চিমা দেশগুলো দাবি করে যে, রাশিয়ার মিত্র বেলারুশ গত বছর সুদান, ইরাক এবং সিরিয়ার মতো সঙ্ঘাত-প্রবণ দেশ থেকে হাজার হাজার শরণার্থী গ্রহন করে ইউরোপে একটি বিশাল শরণার্থী সঙ্কট তৈরি করেছে।
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি সাম্প্রতিক খবরে জানা যায় যে, সুদান থেকে আগত থেকে ২২ বছর বয়সী শরণার্থী আলবাগিরের সন্ধানে পোলিশ সীমান্ত হেলিকপ্টার ও টহল ড্রোন পাঠানো হয়েছিল। সর্বত্র হিমাঙ্কের নীচে থাকা তাপমাত্রা এবং তুষারপাতের মধ্যে সে এবং আফ্রিকান উদ্বাস্তুদের একটি ছোট দল তাদের পকেটে শেষ কয়েকটি খেজুর নিয়ে পোল্যান্ডে ঢোকার চেষ্টা করে। পালিয়ে যাওয়ার আগে সীমান্তরক্ষীরা তাদের নির্মমভাবে মারধর করে এবং জাতিগত গালিগালাজ করে। অথচ, একই সময়ে ওডেসার কাছে একটি ছোট শহরে ২১ বছর বয়সী ইউক্রেনীয় মাসলোভা সীমান্ত পার হওয়ার জন্য স্যুটকেস এবং মোবাইল ট্যাব নিয়ে তার পরিবারের আটজন প্রাপ্তবয়স্ক এবং পাঁচ শিশুকে নিয়ে একটি টয়োটা আরভি ৪-এ চড়ে চারটি গাড়ির কাফেলার সাথে মহা আরামে ও নিশ্চিন্তে রওনা দেন।
মাসলোভা এবং আলবাগির উভয়েই যুদ্ধের শিকার। কিন্তু তাদের প্রতি তীব্র আচরণগত বৈষম্য ইউরোপের শরণার্থী সঙ্কটে বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে তুলে ধরেছে। মাসলোভা যখন পোল্যান্ডে প্রতিদিন ফ্রিজ এবং টেবিল ভর্তি খাবার নিয়ে দিন অতিবাহিত করছেন, তখন মানবাধিকার কর্মীদের মাধ্যমে একই মাটিতে একটি বাড়িতে গোপনে আশ্রয় নেয়া আলবাগি পরবর্তী খাবার কবে মিলবে জানেন না, এমনকি অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করার কারণে তাকে তার উপাধি ব্যবহার না করতেও নিষেধ করা হয়েছে।
টেলিভিশনের পর্দায় ইউক্রেনীয়দের এই জামাই আদর দেখে প্রায় হতবাক হয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘কেন আমরা এই যত্ম এবং এই ভালবাসা দেখতে পাচ্ছি না?, ইউক্রেনীয়রা কি আমাদের চেয়ে ভালো?’ ব্রাসেলসে অভিবাসন বিশ্লেষক ক্যামিল লে কোজ বলেন, ‘এই প্রথম আমরা শরণার্থীদের বিভিন্ন দলের সাথে আচরণের মধ্যে এমন বৈপরীত্য দেখতে পাচ্ছি।’ তিনি আরও বলেন যে, ইউরোপীয়রা ইউক্রেনীয়দের স্বজাতি মনে করে।
ভ‚মধ্যসাগর থেকে ইংলিশ চ্যানেল পর্যন্ত ইউরোপীয় সরকারগুলো আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা মুসলিম অভিবাসীদের তাদের দেশে প্রবেশ করা কঠিন করে তুলেছে কখনও কখনও তাদের প্রতি অতিরিক্ত শক্তি ব্যবহার করে আসছে। বিশ্বের অন্যান্য অংশ, প্রধানত মধ্যপ্রাচ্যথেকে আসা যুদ্ধের শিকার শরণার্থীদের প্রতি ইউরোপীয়দের দ্বিমুখি মনোভাব তাদের নৈত্বিকতা এবং মানবিক মূল্যবোধের অভাবের প্রতিনিধিত্ব করে।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের ২০১৯ সালের একটি প্রতিবেদন বলছে যে, সেøাভাকিয়া, পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি, লিথুয়ানিয়া, গ্রীস এবং ইতালির সংখ্যাগরিষ্ঠরা মুসলিমদের প্রতি অত্যন্ত প্রতিক‚ল দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে। এবং ইউক্রেন সঙ্কট তাদের নির্লজ্জ বর্ণবাদ, মানবাধিকারের নামে ভন্ডামি, এবং সভ্যতার মোড়কে পরিচালিত শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ব এবং অ-শ্বেতাঙ্গ শরণার্থীদের প্রতি অমানবিকতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
অভিবাসনের হুমকির জাতিগতকরণ করে মুসলিম-বিরোধী বক্তব্য, উদ্বাস্তুদের অর্থনৈতিক অভিবাসী হিসেবে আখ্যায়িত এবং উপস্থাপন করে তাদেরকে সম্পদ চুরি করার অভিযোগে ইউরোপীয় শাসক দলগুলো বর্নবাদ ও মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিয়ে ভোট ব্যবসা করে আসছে। তারা জনসাধারণের অনুভ‚তিকে ব্যবহার করে ‘অবাঞ্ছিত বহিরাগত’, প্রধানত মুসলিমদের থেকে সাবধান থাকার বার্তা জারি করে ইতোমধ্যেই সন্দেহপ্রবণ জনগোষ্ঠীকে ভীত করে তুলেছে।
সিরিয়া, ইরাক এবং আফগানিস্তানের যুদ্ধ এবং নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের আগমনকে একধরনের ‘মুসলিম আক্রমণ’ হিসাবে অভিহিত করে তারা শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের দ্বারা পরিচালিত ঐতিহ্যবাহী ইহুদি ও খ্রিস্টান মূল্যবোধের রক্ষক হিসাবে নিজেদের উপস্থাপন করে থাকে। তাই ইউক্রেনের সঙ্ঘাত, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় চলমান যুদ্ধে মানবাধিকার নয়, বরং ভূ-রাজনীতি, বর্ণবাদ ও মুসলিম বিদ্বেষ এখন নির্ধারণ করে দেবে যে, একজন ব্যক্তি কোন যুদ্ধ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছেন। এর উপর নির্ভর করে তার অভ্যর্থনা হবে খুবই ভিন্ন ধরণের। সূত্র : দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস, ট্রিবিউন, ইন্টারনেট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন