রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ গত এক বছরে খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহ শৃঙ্খলাকে ব্যাহত করেছে এবং দরিদ্র দেশগুলিতে দারিদ্র্য মোকাবেলা ও ঋণ পুনর্গঠন করার পরিকল্পনা হুমকির মুখে ফেলেছে, এমনকি ভগ্নপ্রায় অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। এবং বছর শেষে এ যুদ্ধ বিশ্বের প্রধান অর্থনীতিগুলির মধ্যে বিভাজনকে আরো গভীর করে তুলেছে। শনিবার এসব বিভাজন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, যখন ভারতের বেঙ্গালুরুতে দুই দিনের জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে পশ্চিমা নীতিনির্ধারকরা রাশিয়ার ওপর আরো কঠোর ও বিস্তৃত নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিয়েছে। রাশিয়ার সাথে ভারতের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক এই বছর জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজক হিসাবে দেশটিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উল্লেখ করেন যে, বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি হুমকির মুখোমুখি, তবে তিনি রাশিয়াকে উল্লেখ করেননি, পরিবর্তে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান ভূ -রাজনৈতিক উত্তেজনার দিকে ইঙ্গিত করেন। একদিকে, মস্কো ভারতে শক্তি এবং সামরিক সরঞ্জামের একটি প্রধান সরবরাহকারী এবং অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতের বৃহত্তম ব্যবসায়ী অংশীদার। তাই ভারত এ সঙ্ঘাতকে একটি ‘যুদ্ধ’ হিসাবে অভিহিত করা থেকে বিরত থেকেছে এবং পরিবর্তে অন্যান্য বিষয়ে মনোনিবেশ করেছে। জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে পশ্চিমা দেশগুলি মস্কোর উপর নতুন নিষেধাজ্ঞার ঢল আরোপ করেছে এবং ইউক্রেনের জন্য আরও অর্থনৈতিক সমর্থন উন্মোচন করেছে, যেখানে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলি যারা সস্তা রাশিয়ান তেলের সুবিধাগুলি অর্জন করছে, রাশিয়ার সমালোচনা থেকে বিরত থেকেছে। বিভিন্ন মতামত শনিবার সম্মেলনটি ঐতিহ্যবাহী সম্মিলিত বিবৃতি পরিবেশন করতে ব্যর্থ হয়। বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত অর্থনীতির দেশগুলিকে বাধ্য করে তাদের অনিচ্ছুক সহযোগীদের বোঝানোর চেষ্টা করার জন্য যে, ইউক্রেনকে রক্ষার জন্য ব্যয় করা গুরুত্বপূর্ণ। উত্তেজনার সুস্পষ্ট চিহ্ন সম্বলিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে, জি-২০ গোষ্ঠী প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের জায়গা নয়, তবে সদস্যরা স্বীকার করেছেন যে, প্রতিরক্ষার বিষয়গুলি বিশ্ব অর্থনীতির জন্য উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক পরিণতি ঘটাতে পারে।
জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের প্রকাশিত সারসংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বেশিরভাগ সদস্য ইউক্রেনের যুদ্ধের জোরালো নিন্দা করেছেন, তবে সার্বিক পরিস্থিতি ও নিষেধাজ্ঞাগুলোর বিষয়ে তাদের ভিন্ন মতামত এবং মূল্যায়ন ছিল। বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাশিয়া ও চীন ইউক্রেন যুদ্ধের উল্লেখ রয়েছে, এমন অংশগুলিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেছে। সম্মেলনটি বৈশ্বিক অর্থনীতির এমন এক গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তে ব্যাপক বিভাজনের সাথে সমাপ্ত হয়েছে, যখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ গত মাসে তার বৈশ্বিক অর্থনীতি সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে বলেছে যে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পৃথিবীর আকাশে অনিশ্চয়তার মেঘ ঘনিয়ে এনেছে। সংস্থাটি আরও উল্লেখ করেছে যে, বিশ্বে ক্রমবর্ধমান বিভাজন ভবিষ্যতে প্রবৃদ্ধির উপর আঘাত হানবে। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য নীতি অধ্যাপক ইশ^র প্রসাদ বলেন, ‘নিশ্চতভাবে জি-২০ এ বিভাজন তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার আক্রমণাত্মক ব্যবহার অন্যান্য দেশগুলির মধ্যে উদ্বেগ উত্থাপন করেছে যে, এমনকি যদিও তারা রাশিয়ার পদক্ষেপ সমর্থন করেনি, কিন্তু তারা যেকোনও সময় ওয়াশিংটনের আক্রোশের মুখোমুখি হতে পারে।’
ইউরোপীয় অনেক দেশ বিশ্বাস করে যে, যেভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিদ্যুৎ চালিত যানের জন্য মার্কিন ভর্তুকিগুলির তুলনায় ইউরোপীয় ভর্তুকির পার্থক্য প্রকাশ করে চলেছে, তাতে তাদের অর্থনীতির ক্ষতি হবে। এটি ২০২১ সালের একটি বৈশ্বিক কর চুক্তির প্রয়োগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলেছে। রাশিয়ার বিপরীতে দাড়ানোর জন্য ইউক্রেনকে মাত্রাছাড়া সমর্থন অনেক দেশের জটিল ঘরোয়া রাজনীতিতে পরিবর্তন ঘটতে পারে এবং যুক্তরাষ্ট্রও এর ব্যতিক্রম নয়। দেশটির প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড জে ট্রাম্প সহ ক্রমবর্ধমান সংখ্যক রিপাবলিকান সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলিতে যুক্তি দিয়ে আসছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র কিইভকে অবিরাম সমর্থন করতে পারে না। তারা দাবি করেছেন যে, গত বছর ইউক্রেনকে ১ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি সহায়তা দেয়ার পর এখন ১৯ লাখ কোটি ডলারের রেকর্ড মাত্রার অপরিশোধিত ঋণ এবং দুর্বল অর্থনীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত নিজের সমস্যার দিকে আরও বেশি মনোযোগ দেয়া।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন