রাশিয়ার ভাড়াটে সেনাদল ওয়াগনারের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন দাবি করেছেন, ইউক্রেনের বাখমুত নগরী এখন প্রায় পুরোপুরি ঘিরে ফেলা হয়েছে। ইউক্রেনের সেনাদের জন্য কেবল একটি পথই খোলা আছে।
রয়টার্স সাংবাদিকরা বাখমুতের পূর্বাঞ্চলে ইউক্রেনীয় সেনাদেরকে প্রতিরক্ষা শক্তিশালী করার চেষ্টায় পরিখা খনন করতে দেখেছেন। কয়েক মাস ধরে নগরীর ভেতরে অবস্থান করা ইউক্রেনীয় একটি ড্রোন ইউনিটের কমান্ডার বলেছেন, তাকে শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বাখমুত দখলে নিতে পারলে অর্ধবছরের মধ্যে এটিই হবে রাশিয়ার জন্য প্রথম বড় জয়। এতে দোনেৎস্ক অঞ্চলের বাকী শহুরে কেন্দ্রগুলো রাশিয়ার কবজায় চলে যাওয়ার পথ খুলে যাবে।
অপরদিকে, ইউক্রেন বাখমুতকে নিজেদের প্রতিরক্ষার প্রধান দুর্গ হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে। এ নগরীর পতন হলে ইউক্রেনের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ার আশঙ্কা আছে। ফলে যে কোনো উপায়ে বাখমুতের দখল ধরে রাখতে চায় কিয়েভ।
রাশিয়ার ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান প্রিগোজিন লড়াইয়ের পোশাক পরে একটি ভবনের ছাদে দাঁড়িয়ে রেকর্ড করা একটি ভিডিও বার্তা প্রকাশ করেছেন। ভিডিওতে তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে ইউক্রেনীয় সেনাদের জীবন বাঁচানোর জন্য তাদেরকে বাখমুত থেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রিগোজিন বলেন, ‘ওয়াগনার গ্রুপের বেসরকারি বাহিনী কার্যত বাখমুত ঘিরে ফেলেছে। কেবল একটি পথ খোলা রয়েছে। সাঁড়াশী চেপে বসছে’। ভিডিও বার্তায় তিন বন্দি ইউক্রেনীয়কেও দেখানো হয়েছে। তাদের একজন বয়স্ক এবং দুজন তরুণ। ভিডিওটি বাখমুতের ৭ কিলোমিটার উত্তরের একটি গ্রামে ধারণ করা বলে চিহ্নিত করেছে রয়টার্স।
বাখমুতের লড়াইয়ে দু’পক্ষই একে অপরের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি সাধনের দাবি করেছে। তবে কিয়েভ বলছে, তাদের সেনারা এখনও নগরীর নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছে। যদিও গত সপ্তাহে তারা সেখানকার পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে বলে স্বীকার করেছে।
ইউক্রেনের ন্যাশনাল গার্ডের উপ-কমান্ডার ভলোদিমির নাজারেঙ্কো বলেছেন, ‘পরিস্থিতি ভয়াবহ। অবিরাম লড়াই চলছে। রুশরা নিজেদের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করছে না, তারা আক্রমণ করে নগরী দখল করতে চাইছে। বাখমুতে ইউক্রেনীয় সেনাদের লক্ষ্য- যত বেশি সম্ভব শত্রুপক্ষের ক্ষয়ক্ষতি করা। ‘আমাদের যতটা বেশি সম্ভব গোলাবারুদ প্রয়োজন। আমাদের কাছে থাকা গোলাবারুদ দিয়ে যত সেনা বিনাশ করা সম্ভব তার চেয়ে বেশি সেনা রয়েছে রাশিয়ার’।
ইউক্রেনীয় সৈন্যরা ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা মেরামত করার জন্য কাজ করছিল এবং আরো সৈন্য সামনের সারিতে এগোচ্ছিল এই লক্ষণে যে, ইউক্রেন এখনও শহর ছেড়ে যেতে প্রস্তুত নয়। পশ্চিমে, ইউক্রেনীয়রা প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানের জন্য নতুন পরিখা খনন করছিল।
রাশিয়ার আরআইএ রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে যা দেখায়, এটি কী বলেছে যে ওয়াগনার যোদ্ধারা একটি ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প স্থাপনার মধ্য দিয়ে চলছে। একজন যোদ্ধাকে বলতে শোনা যায় যে, ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী রাশিয়ার ঘেরাও ঠেকাতে বখতের কাছে বসতিগুলোর অবকাঠামো ধ্বংস করছে।
ইউক্রেনের স্থল বাহিনীর কমান্ডার ওলেক্সান্ডার সার্স্কি, ফ্রন্টলাইন বাহিনীর প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়ানোর উপায় সম্পর্কে স্থানীয় কমান্ডারদের সাথে ব্রিফিংয়ের জন্য শুক্রবার বাখতামুত পরিদর্শন করেন।
বখতে ইউক্রেনীয় সেনা ইউনিটের কমান্ডার ডেনিস ইয়ারোসøাভস্কি এসপ্রেসো টিভিকে বলেছেন যে, সকাল থেকে পরিস্থিতিকে ‘উভয় পক্ষের একটি কসাইখানা’ বলে কিছু ইউনিটের কিছু অংশকে আরো নিরাপদ অবস্থানে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বাখতামুতে রাশিয়ান বিজয়, যার প্রাক-যুদ্ধ জনসংখ্যা ৭০ হাজার গত বছর কয়েক হাজার সুরক্ষাবাদীকে তলব করার পরে এটি ব্যয়বহুল শীতে এটিকে প্রথম বড় জয় দিয়েছে। রাশিয়া বলেছে যে, এটি মস্কোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য, ডনবাস শিল্প অঞ্চলের দখল সম্পূর্ণ করার জন্য একটি পদক্ষেপ হবে। যুদ্ধের আগে বখতামুত তার লবণ এবং জিপসাম খনির জন্য পরিচিত ছিল। ইউক্রেন বলেছে যে, শহরটির কৌশলগত মূল্য খুব কম এবং রাশিয়া বাখতামুত দখলের চেষ্টায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করেছে।
এদিকে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার অভিযানের পরে ইউক্রেনকে প্রায় ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা প্রদান করে। হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেনের জন্য তার ‘গভীর’ সমর্থনের জন্য সফররত জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ স্কোলজকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। স্কোলজ বলেন, একটি বার্তা পাঠানো গুরুত্বপূর্ণ যে, ইউক্রেনের জন্য সমর্থন ‘যতদিন লাগে এবং যতক্ষণ প্রয়োজন’ অব্যাহত থাকবে।
তাদের বৈঠকের পর, হোয়াইট হাউস বলেছে যে, এ জুটি ইউক্রেনে তার আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে দায়বদ্ধ রাখার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে।
জার্মানি জানুয়ারিতে লেপার্ড ট্যাঙ্কের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এবং তারা একটি নতুন ইউক্রেনীয় সাঁজোয়া বাহিনীর মূল ভিত্তি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। স্কোলজ ইউক্রেনকে অস্ত্রায়ন করার বিষয়ে একটি সতর্ক জনসাধারণের অবস্থান নেয়ার জন্য কিছু পশ্চিমা মিত্রদের সমালোচিত হয়েছে, যদিও তিনি এমন একটি দেশ থেকে নীতির একটি বড় পরিবর্তনের তদারকি করেছেন যে যুদ্ধের আগে পুরো রাশিয়া ছিল।
বার্লিনে কিয়েভের রাষ্ট্রদূত ওলেক্সি এমকায়েভ বলেছেন, জার্মানি এখন ইউক্রেনকে অস্ত্রসমৃদ্ধ করার জন্য একটি বৃহত্তর নেতৃত্বের ভূমিকা নিচ্ছে।
ইউক্রেনের পশ্চিমা অস্ত্র ধ্বংস করে দেয়া হবে -রুশ রাষ্ট্রদূত : ওয়াশিংটন থেকে কিয়েভকে সামরিক সহায়তার আরো একটি প্যাকেজ সম্পর্কে মন্তব্য করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাশিয়ান রাষ্ট্রদূত আনাতোলি আন্তোনভ বলেছেন, ইউক্রেনকে সরবরাহ করা অস্ত্র নির্মূল করে ফেলা হবে, আর রাশিয়াকে কৌশলগতভাবে পরাজিত করার প্রচেষ্টা নিরর্থক। যুক্তরাষ্ট্রের রাশিয়ান দূতাবাস গত শুক্রবার আন্তোনভের ভাষ্য প্রকাশ করেছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদেরকে কৌশলগতভাবে পরাজিত করার ওয়াশিংটনের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় ডুবে গেছে’। ‘রাশিয়ান ফেডারেশন আত্মবিশ্বাসের সাথে তার লক্ষ্যগুলো পূরণের দিকে এগিয়ে চলেছে। আমাদের সৈন্যরা মার্কিন নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত পশ্চিমের দ্বারা ইউক্রেনে লালন-পালনকারী নাৎসিদের দমন করে একটি অভূতপূর্ব হুমকি থেকে পিতৃভূমিকে রক্ষা করছে’।
আন্তোনভ আরো বলেন, ‘আমেরিকান সহায়তা কেবল কিয়েভ সরকারের যন্ত্রণা দীর্ঘায়িত করতে কাজ করবে। এটি যে হুমকির কারণ হয়েছে তা আমাদের সীমানা থেকে প্রয়োজনীয় দূরত্বে পেছনে ঠেলে দেওয়া হবে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের হাতে যেসব বিদেশি অস্ত্র পড়েছে সেগুলো পালিয়ে ও ধ্বংস হয়ে যাবে’।
রাশিয়ার ভিতরে ঢুকে গুলি চালিয়েছে ইউক্রেনের সেনারা : রাশিয়ার অভ্যন্তরে ঢুকে ইউক্রেন সেনারা বেসামরিক লোকদের ওপর গুলি চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছে মস্কো। তাদের দাবি, ইউক্রেন সীমান্তবর্তী তাদের এলাকায় নিয়মিত গুলি ছুড়ছেন ইউক্রেনীয় সেনারা। গত বৃহস্পতিবারও রাশিয়ার ব্রায়ানস্ক অঞ্চলে ঢুকে গুলি ছুড়েছে ইউক্রেন সেনারা। ব্রায়ানস্ক অঞ্চলের গভর্নর আলেকজান্ডার বোগোমাজ বলেন, ইউক্রেন সেনারা আমাদের একটি গ্রামে ঢুকে গাড়িতে গুলি চালিয়ে দুজনকে হত্যা করেছে। এছাড়া এ ঘটনায় ১০ বছর বয়সী একটি ছেলে আহত হয়েছেন।
এ বিষয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন বলেন, আবারও হামলা চালালো সন্ত্রাসীরা। তারা সীমান্তে অনুপ্রবেশ করে সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালিয়েছে।
তবে রাশিয়ার অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির উপদেষ্টা মাইখাইলো পোডোলিয়াক বলেছেন, সীমান্তে হামলা চালানোর বিষয়টি রাশিয়ার ইচ্ছাকৃত উসকানি। অন্য দেশের ওপর হামলা চালানো ন্যায়সঙ্গত বোঝাতে রাশিয়া তার জনগণকে ভয় দেখাতে চায়। সূত্র : রয়টার্স, বিবিসি ও তাস।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন