শনিবার রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট-জেনারেল ইগর কোনাশেনকভ জানিয়েছেন, ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান চলাকালে রাশিয়ার বাহিনী গত দিনে ইউক্রেনের তিনটি যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করেছে ও তাদের হামলায় ইউক্রেনের ৪৫০ সেনা নিহত হয়েছে।
‘রাশিয়ান এরোস্পেস ফোর্সের ফাইটার এয়ারক্রাফ্ট ইউক্রেনিয়ান এয়ার ফোর্সের সু-২৪, সু-২৫ এবং মিগ-২৯ প্লেনগুলোকে ডোনেৎস্ক পিপলস রিপাবলিকের রোজভকা এবং দিমিত্রোভের বসতিগুলির কাছাকাছি এলাকায় গুলি করে নামিয়েছে, মুখপাত্র বলেছেন। রুশ বিমান প্রতিরক্ষা বাহিনী গত ২৪ ঘন্টায় আটটি ইউক্রেনীয় মানববিহীন আকাশযান, দুটি হিমারস রকেট এবং তিনটি তোচকাণ্ডইউ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করেছে, জেনারেল যোগ করেছেন।
রাশিয়ান বাহিনী কুপিয়ানস্ক এলাকায় ইউক্রেনের জনশক্তি এবং সরঞ্জামের ক্ষতি করেছে, গত দিনে প্রায় ৬০জন শত্রু সৈন্যকে নির্মূল করেছে, কোনাশেনকভ রিপোর্ট করেছেন, ‘সেখানে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৬০ জন কর্মী, তিনটি পিকআপ ট্রাক, একটি মার্কিন তৈরি এম৭৭৭ আর্টিলারি সিস্টেম এবং একটি পোলিশ-নির্মিত ক্র্যাব অটোমেটিক আর্টিলারি বন্দুক।’ তিনি বলেন, রুশ বাহিনী গত দিনে লুগানস্ক পিপলস রিপাবলিকের ক্রাসনি লিমান এলাকায় প্রায় ১৮০ ইউক্রেনীয় সেনাকে নির্মূল করেছে। ‘গত ২৪ ঘন্টায় প্রায় ক্রাসনি লিমানে ১৮০ ইউক্রেনীয় সেনা, ছয়টি সাঁজোয়া যুদ্ধ যান, একটি গ্র্যাড মাল্টিপল রকেট লঞ্চার, একটি ডি-২০ হাউইটজার এবং একটি কাউন্টার-ব্যাটারি রাডার ধ্বংস করা হয়েছে,’ কোনাশেনকভ রিপোর্ট করেছেন।
এদিকে, রুশ বাহিনী গত দিনে ডোনেৎস্ক এলাকায় ১২০ জনেরও বেশি ইউক্রেনীয় সেনা এবং একটি গোলাবারুদ ডিপোকে নির্মূল করেছে। ‘ডোনেৎস্ক এলাকায়, দক্ষিণ যুদ্ধ গ্রুপের ইউনিটগুলির সক্রিয় অপারেশন, বিমান হামলা এবং কামান গুলি চালানোর ফলে গত ২৪ ঘন্টায় ১২০ জনেরও বেশি ইউক্রেনীয় সেনা, তিনটি সাঁজোয়া যুদ্ধ যান, ডি-২০ এবং ডি-৩০ হাউইটজার ধ্বংস করা হয়েছে। এছাড়াও, ডোনেৎস্ক পিপলস রিপাবলিকের আভদেয়েভকার বসতি এলাকায় একটি আর্টিলারি গোলাবারুদ ডিপো ধ্বংস করা হয়েছিল,’ মুখপাত্র বলেছেন।
পাশাপাশি, দক্ষিণ ডোনেৎস্ক এবং জাপোরোজিয়ে এলাকায় রাশিয়ান বাহিনী গত দিনে ৯০ জনেরও বেশি ইউক্রেনীয় সৈন্য এবং তিনটি ট্যাঙ্ক ধ্বংস করেছে। ‘দক্ষিণ ডোনেৎস্ক এবং জাপোরোজিয়ে এলাকায়, পূর্ব যুদ্ধ গ্রুপের অপারেশনাল/কৌশলগত বিমান এবং আর্টিলারি ডোনেৎস্ক পিপলস রিপাবলিকের উগলেদার ও ডোব্রোভোলিয়ে এবং জাপোরোজিয়ে অঞ্চলের গুলিয়াইপোলের বসতিগুলির কাছে ইউক্রেনের সেনা ইউনিটগুলিতে ব্যাপক হামলা চালায়। এতে ৯০ জনেরও বেশি ইউক্রেনীয় সেনা নিহত ও তিনটি ট্যাঙ্ক, দুটি পদাতিক যুদ্ধের যান, দুটি সাঁজোয়া যুদ্ধের যান, দুটি পিকআপ ট্রাক, একটি মাস্টা-বি হাউইটজার এবং একটি ডি-২০ হাউইটজার ধ্বংস হয়েছে,’ মুখপাত্র বলেছেন।
সব মিলিয়ে, রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনী ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে ৩৯০টি ইউক্রেনীয় যুদ্ধ বিমান, ২১০টি হেলিকপ্টার, ৩,২৩৬টি মনুষ্যবিহীন আকাশযান, ৪০৫টি সারফেস টু এয়ার মিসাইল সিস্টেম, ৮,০২৭টি ট্যাংক এবং অন্যান্য সাঁজোয়া যুদ্ধ যান, ১,০৪৫টি মাল্টিপল রকেট লঞ্চার, ৪,২১৫টি ফিল্ড আর্টিলারি গান ও মর্টার এবং ৮,৫৩৮টি বিশেষ সামরিক মোটর যান ধ্বংস করেছে, কোনাশেনকভ রিপোর্ট করেছেন।
বাখমুতের উত্তরে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বসতির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে রুশ সেনা : আর্টিওমভস্কের (যাকে ইউক্রেনের বাখমুত বলা হয়) উত্তরে ইয়াগোদনয়ে শহর সম্পূর্ণরূপে রুশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। ওয়াগনার প্রাইভেট মিলিটারি কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ইয়েভজেনি প্রিগোজিন শনিবার এ তথ্য জানিয়েছেন।
প্রিগোজিনের প্রেস সার্ভিসের টেলিগ্রাম চ্যানেল তাকে উদ্ধৃত করে বলেছে, ‘২৫ ফেব্রুয়ারি, ওয়াগনার পিএমসির হামলাকারী ইউনিটগুলো বাখমুতের উত্তরে ইয়াগোদনয়ে জনবহুল এলাকা সম্পূর্ণরূপে দখল করে নেয়।’ প্রেস সার্ভিস শহরেরর প্রবেশ চিহ্নের সামনে ওয়াগনার যোদ্ধাদের একটি ছবিও প্রকাশ করেছে। ইয়াগোডনয়ে আর্টিওমভস্কের উত্তর শহরতলির সংলগ্ন এলাকা।
যুদ্ধ থামাতে সহায়তার জন্য চীন সফরে যাচ্ছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট : ইউক্রেনে সংঘাত থামাতে চীনের প্রেসিডেন্টের সহায়তা চাইতে আগামী এপ্রিল মাসে চীন সফর করবেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ। শনিবার তিনি নিজেই এ ঘোষণা দেন। ইতোমধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে আবারও আলোচনার আহ্বান জানিয়েছে চীন। যুদ্ধে উস্কানি দেয়ার জন্য তারা যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদেরও সমালোচনা করেছে। প্রতিবেশী ইউক্রেনে পরাশক্তি রাশিয়ার ‘বিশেষ সামরিক অভিযানের’ পর মস্কোর সঙ্গে বেইজিংয়ের ঘনিষ্ঠতার কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের পক্ষ থেকে বেশ চাপে আছে মহাপ্রাচীরের দেশটি।
এর আগে বৃহস্পতিবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত বার্তায় ১২ দফা তুলে ধরে নিজের অবস্থান আবারও স্পষ্ট করেছে দেশটি। শুক্রবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন এ তথ্য জানিয়ে বলেছে, চীন এই চলমান সংঘাতের রাজনৈতিক সমাধান চেয়েছে। বেইজিং চায়—যুদ্ধ বন্ধে আবারও শান্তি আলোচনা শুরু হোক এবং পশ্চিমের এক তরফা নিষেধাজ্ঞার অবসান হোক। প্যারিসে অনুষ্ঠানরত কৃষি বিষয়ক এক প্রদর্শনীতে অংশ নেয়ার পর পৃথক বক্তব্যে মাখোঁ জানান, তিনি ‘এপ্রিলের শুরুর দিকে’ চীন সফরে যাবেন। ফরাসি নেতা বলেন, ‘এটা একটা সুসংবাদ, যে চীন শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, শান্তি তখনই আসবে যখন, ‘রাশিয়ার আগ্রাসন বন্ধ হবে, সেনা প্রত্যাহার হবে এবং ইউক্রেনের ভূখণ্ডের সার্বভৌমত্ব ও জনগোষ্ঠীর প্রতি সম্মান জানানো হবে’।
তিনি যোগ করেন, ‘রাশিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য আমাদের চীনের সহায়তা প্রয়োজন, যাতে তারা কখনোই কেমিক্যাল বা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার না করে—এবং শান্তির আলোচনার পূর্বশর্ত হিসেবে তারা যেনো এই আগ্রাসন বন্ধ করে’। ম্যাখোঁর চীন সফরের ঘোষণা আসার অল্প সময় আগে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, শি জিন পিংয়ের আমন্ত্রণে ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ মার্চ বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কো রাষ্ট্রীয় সফরে চীনে থাকবেন। রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের দীর্ঘদিনের মিত্র হিসেবে লুকাশেঙ্কো সুপরিচিত।
চীন রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করবে বলে নিশ্চিত যুক্তরাষ্ট্র : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আত্মবিশ্বাসী যে, চীন রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহের বিষয়ে বিবেচনা করছে। মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক উইলিয়াম বার্নস সিবিএসকে দেয়া একটি সাক্ষাতকারে এ মন্তব্য করেছেন, যার কিছু অংশ শনিবার প্রচারিত হয়েছিল। ‘আমরা নিশ্চিত যে, চীনা নেতৃত্ব মারাত্মক অস্ত্র দেয়ার উপায়গুলো বিবেচনা করছে,’ বার্নস বলেছিলেন, ‘তবে আমরা এখনও বলতে পারছি না যে, এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে কিনা, এবং আমরা মারাত্মক অস্ত্রগুলোর প্রকৃত চালানের প্রমাণ দেখতে পাই না।’ মার্কিন নেতৃত্ব ভেবেছিল ‘এর পরিণতি কী হবে তা পরিষ্কার করা গুরুত্বপূর্ণ।’
বার্নস বলেছিলেন যে, চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সম্ভবত ইউক্রেনের রাশিয়ান বিশেষ অপারেশনটি খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি চূড়ান্তভাবে তাইওয়ানকে নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়ে আমাদের খুব গুরুত্ব সহকারে শি’র উচ্চাকাঙ্খার বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া দরকার। তবে আমাদের দৃষ্টিতে এটি নয় যে সামরিক দ্বন্দ্ব অনিবার্য।’ ‘আমি মনে করি আমাদের রায় হচ্ছে প্রেসিডেন্ট শি এবং তার সামরিক নেতৃত্ব এখনও নিশ্চিত নয় যে তারা তাইওয়ানে আক্রমণ করে সফল হতে পারবে কিনা,’ বার্নস যোগ করেছেন। সূত্র : আল-জাজিরা, তাস, রয়টার্স।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন