২৪ ফেব্রয়ারি ইউক্রেন যুদ্ধের বর্ষপূর্তির প্রাক্কালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেন সফরে যেতেই আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ সংক্রান্ত ‘নিউ স্ট্র্যাটেজিক আর্মস রিডাকশন ট্রিটি (স্টার্ট)’ চুক্তি বাতিল করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, যার মাধ্যমে ২০১০ সালে দু’দেশের মধ্যে অস্ত্রের সংখ্যা ও ব্যবহার সীমিত করা হয়েছিল। চুক্তির মেয়াদ ২০২৬ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বাইডেনের ইউক্রেন সফরের পর দিন মঙ্গলবার এ চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা ঘোষণা করেন পুতিন। তিনি বলেন, ‘আমি ঘোষণা করতে বাধ্য হচ্ছি, কৌশলগত পরমাণু অস্ত্র সংক্রান্ত চুক্তি থেকে রাশিয়া সরে আসছে।’ যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যে এটিই ছিল শেষ চুক্তি।
পুতিন দাবি করেছেন যে, পশ্চিমারা ইউক্রেনকে একটি নতুন নাৎসি রাজত্বে পরিণত করেছে, যা রাশিয়া-বিদ্বেষী। এর কয়েক ঘণ্টা পর বাইডেন তার পোল্যান্ড সফরের ভাষণে বলেন যে, ন্যাটো এখন আগের চেয়েও বেশি ঐক্যবদ্ধ। কিইভ শক্তভাবে দাঁড়িয়েছে ও মুক্ত এবং ইউক্রেনের জন্য পশ্চিমাদের সহায়তা ব্যর্থ হবে না।’ তিনি সারা বিশ্বকে এও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, সামনে ভয়ঙ্কর দিন আসতে চলেছে। বাইডেন বলেন, ‘সামনে আরও কঠিন তথা ভয়াবহ দিন আসতে চলেছে। তবে এটুকু নিশ্চিত করতে পারি যে আগামী দিনেও একইরকমভাবে ইউক্রেনের পাশে থাকবে আমেরিকা ও গোটা ইউরোপ।’ পুতিনের উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বাইডেন বলেছেন, ‘তুমি আমাদের দেশ নিতে পারবে না। আমাদের স্বাধীনতা নিতে পারবে না। আর আমাদের ভবিষ্যৎ-ও নিতে পারবে না।’
এই সংকটের মধ্যে আগুনে ঘি ঢেলেছে চীন। দেশটি জানিয়েছে যে, পুতিনের সাথে সাক্ষাত করতে অচিরেই মস্কো সফর করবেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। এরপর, বাইডেনের কিইভ সফরে বলিয়ান হয়ে শক্তিশালী চীনকে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইউক্রেনও। সোমবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি চীনকে হুমকি দিয়ে বলেছেন যে, চীন রাশিয়াকে সমর্থন করলেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে। জার্মান দৈনিক পত্রিকা দাই ওয়েলÍকে জেলেনস্কি বলেন, ‘আমি চাই চীন আমাদের পাশে থাকুক। তবে এই মুহূর্তে আমি মনে করি না এটি সম্ভব। চীন যদি রাশিয়ার সাথে একত্রিত হয়, তাহলে বিশ্বযুদ্ধ হবে। আমি মনে করি যে চীনও সেই ব্যাপারে অবগত আছে।’
এর আগে. গোয়েন্দা বেলুন নিয়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে আরও তিক্ততা যোগ হওয়ার পর মঙ্গলবার মস্কো সফর করেন চীনের শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই। তখন চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায় যে, এই সফর চীন ও রাশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি দুই দেশের শক্তিশালী সম্পর্কের ইঙ্গিত বহন করে। এপ্রেক্ষিতে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন দাবি করেন যে, চীন রাশিয়াকে ভয়াবহ সামরিক সহায়তা সরবরাহ করার কথা বিবেচনা করছে। তিনি হুশিয়ারি দেন যে, রাশিয়াকে কোনো সামরিক সমর্থন চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করবে। উল্ল্খ্যে, ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে চীন তার রাশিয়ান তেলের আমদানি বাড়িয়েছে। নিষেধাজ্ঞার বিষয়গুলোও এড়িয়ে গেছে দেশটি।
এদিকে, এ মাসের শুরুর দিকে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল মার্কিণ গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে দাবি করে যে, চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলো মার্কিন নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাশিয়ার সামরিক বাহিনীকে সহায়তা প্রদান করছে। তবে, মার্কিন দাবিগুলি অস্বীকার করেছে চীন। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন বলেছেন, ‘এটি যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন নয়, যে অবিরামভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র পাঠাচ্ছে। আমরা যুক্তরাষ্ট্রকে তার নিজস্ব ক্রিয়াকলাপের প্রতি আন্তরিকভাবে চিন্তা করতে এবং পরিস্থিতি প্রশমিত করতে, শান্তি ও সংলাপকে উন্নীত করতে এবং দোষারোপ করা ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানো বন্ধ করার জন্য আরও কিছু করতে আহ্বান জানাচ্ছি।›
যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো দেশগুলির বিপরীতে রাশিয়া-চীন-ইরান চরম অবস্থান পরমাণু যুদ্ধের সম্ভাবনা উস্কে দিয়েছে বলে মনে করছেন সামরিক পর্যবেক্ষকরা। সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেকজান্দার ভুসিক বলেছেন, ‘মঙ্গলবার রাশিয়ান ও মার্কিন নেতাদের দেওয়া বক্তৃতা প্রমাণ করে যে, বিশ্ব ক্রমবর্ধমান বিরোধের পথে এগিয়ে চলেছে। প্রেসিডেন্ট পুতিনের কাছে, সত্য তার পক্ষে, রাশিয়ার পক্ষে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছে, ইউক্রেন এমন জায়গা যেখানে রাশিয়াকে জয়ী হতে দেওয়া উচিত নয়। তিনি মঙ্গলবার টিভি পিঙ্ককে একটি সাক্ষাতকারে বলেন, ‘আপনি যখন এটি সব শুনেছেন এবং যখন আপনি এটি বোঝাচ্ছেন, এটি স্পষ্ট যে আমরা সংঘর্ষের সম্প্রসারণ এবং এর বৃহত্তর বৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।’ মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে অংশ নেওয়ার পর ভুসিক নিকটবর্তী সময়ের মধ্যে শান্তি অর্জনের সম্ভাবনা নিয়ে গভীর সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এরআগে, সাবেক মার্কিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার সহ আরও অনেক রীতি নির্ধারক বলেছেন যে, বাইডেনের ভুল নেতৃত্ব বিশ^কে সঙ্কটের পথে ঠেলে দিচ্ছে।
এটি এখন স্পষ্ট যে, ইউক্রেনের যুদ্ধ আরো খারাপ মোড় নিতে যাচ্ছে। এটি ক্রমবর্ধমানভাবে বিস্তার লাভ করতে যাচ্ছে, যা অবশেষে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এবং এর ফলে, বিশ^ একটি চরম রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে পতিত হবে। এই যুদ্ধের ফলে ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাবে খাদ্য সঙ্কট, যা একটি বৃহত্তর মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নেবে। রাশিয়ার মতো পরাশক্তির ওপর নিষেধাজ্ঞা সৃষ্টি করে সমগ্র ইউরোপ এখন তেল ও গ্যাস সংকটে ভুগছে। এটি আগামী বছর আরও ভয়াবহ রূপ নেবে। এর মধ্যে রাশিয়া যদি কোনঠাসা হয়ে পারমাণবিক আকমণ করে বসে, তাহলে ইউক্রেন যুদ্ধ ও ধ্বংসপ্রাপ্ত রাশিয়ার অগাধ খনিজ সম্পদ ও ইউরোপের ফায়দা লুটবে কে?
যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যেই চড়াদামে তেল বিক্রি করে এবং ডলারের মাণ বাড়িয়ে ব্যাপক ফায়দা লুটছে। মার্কিন ডলারের বিরুদ্ধে রাশিয়া-চীন মুদ্রা ব্যবস্থা, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা কবলিত আরেক পরমাণু অস্ত্রধারী দেশ ইরানসহ ব্রিকদেশগুলির চীনের নেতৃত্বে নিজস্ব মুদ্রা প্রচলনের পরিকল্পনা এবং শক্তিশালী ইউরোর পতন হলে, সমগ্র বিশ^ যখন ভয়ংকর বিপর্যয়ে পতিত হবে, তখন তথাকথিত বিশ্বত্রাতা যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে তার সাফল্যের হিসাব করবে, তা সময়ই বলে দেবে। লেখক: কলামিস্ট ও সাংবাদিক। তথ্যসূত্র: দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, তাস।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন