দেশে আবার বেড়ে গেছে অপরাধ ঘটনা। খুন, ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে হত্যা, ডাকাতি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। গতকালও ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিক পত্রিকায় ৮টি খুনের খবর ছাপা হয়েছে। রাজধানী ঢাকাতেও হঠাৎ বেড়েছে খুন, ছিনতাই ও অজ্ঞানপার্টির দৌরাত্ম্যসহ রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা। রাজধানীতে যানজটের মধ্যে দু’জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনার পর মানুষের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি হয়েছে। রাজধানীর রাজপথ কিংবা বাসভবন কোথাও নিরাপত্তা নেই সাধারণ মানুষের! রাজনৈতিক দলের নেতা, পুলিশ, ছাত্রী ও গৃহবধূ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। ঢাকার শেওড়া পাড়ায় গরিবের ডাক্তার খ্যাত আহমেদ মাহি বুলবুলের ছুরিকাঘাতে হত্যার পর মানুষের মধ্যে শঙ্কা রাস্তায় বের হলে কখন খুন, ছিনতাই, অজ্ঞানপার্টির খপ্পরে পড়লে জীবন নিয়ে ঘরে ফিরতে পারব তো?
কয়েকদিন পরেই শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান। যেভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি ঘটছে রমজান মাসে মানুষ স্বাভাবিকভাবে এবাদতবন্দিগি করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে নানান উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
জানতে চাইলে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. ওমর ফারুক বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে গৎবাঁধা পুলিশিং চলছে। অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে বিশেষায়িত পুলিশিং প্রয়োজন, যা এখনো হয়নি। বিভিন্ন ধরনের দ্বন্দ্বের পেছনে সামাজিক নানা টানাপোড়েন কাজ করে। কিশোর অপরাধের জন্য যে ধরনের পুলিশিং প্রয়োজন, সেটি এখনো গড়ে ওঠেনি। পরিবর্তনশীল সমাজের জন্য পুলিশের যে ধরনের সক্ষমতা ও দৃষ্টিভঙ্গী, তা যুগোপযোগী নয়। আসলে অপরাধের ধরন অনুযায়ী কোন ধরনের পুলিশিং প্রয়োজন, সেটি এখনো বুঝে ওঠা যায়নি। পুলিশ ট্র্যাডিশনাল দায়িত্বের বাইরে অন্য কোনো দায়িত্ব নিতে চায় না। তারা এটাকে মানসিক ও রাজনৈতিক চাপ মনে করে। যার কারণে একটি মনোভাব তৈরি হয়েছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার কারণে মানুষ আর্থিক টানাপোড়েনে পড়ায় অনেকে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। রাজনৈতিক নেতারাও এর মধ্যে রয়েছেন। টেন্ডারসহ বিভিন্ন আর্থিক দ্বন্দ্বে বাড়ছে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধ। এ ছাড়া আধুনিক সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুলিশিং গড়ে না ওঠায় অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
গত এক সপ্তাহে রাজধানীর শাহজাহানপুরে রাস্তার যানজটে শত শত মানুষের সামনে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু ও কলেজ ছাত্রী সামিয়া আফরান প্রীতিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ছাড়াও পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা, গরিবের চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত ডা. আহমেদ মাহি বুলবুল, নার্স, শিক্ষার্থী, গৃহবধূ মিলিয়ে ১৫ জন নৃশংসভাবে খুনের শিকার হন। একই সময়ে ছিনতাইকারীদের হাতে পুলিশের ৬ সদস্যের জখম হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। যদিও কয়েকটি ঘটনায় জড়িতদেরও গ্রেফতার করা হয়েছে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা বলছেন, অস্ত্রধারীরা কখনো টাকার বিনিময়ে ভাড়ায় আবার কখনো নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে খুন, ছিনতাই, ডাকাতি ও দখলসহ বিভিন্ন অপরাধ করছে। কখনো তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হচ্ছে, আবার কখনো এসব হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন হয় না। সন্ত্রাসী ও অস্ত্রধারীরা রাজনৈতিক ছত্রছায়া পাওয়ায় তাদের একটি ‘সেফ জোন’ তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন কর্মকর্তারা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের সন্ত্রাসী একটি গোষ্ঠীর কাছে অসংখ্য আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। সারাদেশে ক্ষমতাসীন দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘাত সংঘর্ষে অস্ত্রের ব্যবহার দেখা যায়। পত্রিকায় তাদের সশস্ত্র ছবি প্রকাশ হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা করেন। কিন্তু অনেক দিন ধরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি। তাই গত ইউপি নির্বাচনেও এসব অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে এবং শতাধিক মানুষ খুন হয়েছে। আর এখন এর প্রভাব পড়ছে খোদ রাজধানীতে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন ডিসি বলেন, অবৈধ একটি অস্ত্র চার থেকে পাঁচ হাত ঘুরে ব্যবহার হয়। অনেক সময় হত্যাকারী নিজেও জানে না, অস্ত্রটি কার। কারণ কয়েকটি হাত ঘুরে তাকে দিয়ে হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয়। মূলত আগ্নেয়াস্ত্রগুলো তারা সহজে বহন করে কিলিং মিশনে অংশ নিতে পারে। মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে পারে। টার্গেটকে নির্দিষ্ট করতে পারে। তাই সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন পেশাদার অপরাধীদের অধিকাংশ রাজনৈতিক সেল্টারে থেকে খুন, ধর্ষণ, ছিনতাইসহ নানা অপরাধ করে এবং এলাকার আধিপত্য নিজের কব্জায় রাখে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে এসব অপরাধীদের সম্পর্কে তথ্য থাকলেও এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সহজ নয়। তবে খুন বা অন্য কোনো বড় ধরনের অপরাধের ঘটনা ঘটলে তখন আর রাজনৈতিক প্রভাব কাজে আসে না।
ডিএমপির তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে রাজধানীতে খুন হন ৯ জন। ফেব্রুয়ারিতে খুনের ঘটনা ঘটে ১৬টি। এর মধ্যে ৫টি খুনের ঘটনা ঘটে মিরপুর এলাকায়। মার্চ মাস শেষ হতে এখনো ২ দিন বাকি। গত ২৮ দিনে আলোচিত একাধিক খুনের ঘটনা রয়েছে। সর্বশেষ গত ২৪ মার্চ বৃহস্পতিবার রাতে বাসায় ফেরার পথে বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু। তার গাড়িচালক মুন্না এসময় গুলিবিদ্ধ হন। জাহিদুলের গাড়ির পাশে রিকশায় থাকা বদরুন্নেসা কলেজের ছাত্রী সামিয়া আফরিন প্রীতিও সেসময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তবে এ খুনের ঘটনায় শুটার মাসুমকে গ্রেফতার করেছে ডিবি। গতকাল তাকে আদালতে তুলে ৭ দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসবাদ করা হচ্ছে। গত শনিবার রাজধানীর সবুজবাগের একটি বাসায় দুই শিশুসন্তানের মুখ বেঁধে রেখে তাদের মা মুক্তা আক্তারকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। গত রোববার ভোরে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে নিহত হন গরিবের দন্ত্যচিকিৎসক আহমেদ মাহি বুলবুল। এটিকে পরিকল্পিত হত্যা বলে দাবি করেছেন তার স্বজনরা। নিহত বুলবুল চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি ঠিকাদারি কাজ করতেন। ঠিকাদারির একটি কাজে নোয়াখালী যাওয়ার জন্য তিনি বাসা থেকে বের হয়েছিলেন।
জানতে চাইলে ডিএমপি মিডিয়া বিভাগের ডিসি ওমর ফারুক হোসেন বলেন, কে কাকে হত্যা করবে, সেটি মনোজগতের বিষয়। ডাক্তার নিহতের ঘটনাটি ছিনতাই নয়। এটি তার ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের কারণে ঘটেছে। কারণ, তিনি কিছুদিন আগে ১৫ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ পেয়েছেন। পুলিশ আহতের ঘটনাটিও আইনশৃঙ্খলার অবনতি নয়। ডাকাতি, ছিনতাই কিংবা চুরি বেড়ে গেলেই কেবল আইনশৃঙ্খলার অবনতি বলা যেতে পারে। অপরাধের মাত্রা কখনো বাড়ে, আবার কখনো কমে। আশা করা যাচ্ছে, সবকিছু শান্ত হয়ে যাবে। জনগণের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। সবকিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। অপরাধ করে কেউ পার পাবে না। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে থানাগুলোতে টহল জোরদার করা ও নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে রাজধানীতে মাটরসাইকেল বা গাড়ি চুরির ৩৬টি মামলা হয়েছে। এর আগে জানুয়ারি মাসে মোটরসাইকেল বা গাড়ি চুরির মামলা হয়েছিল ৩১টি। চাঁদাবাজির ঘটনায় গত দুই মাসে ঢাকায় মামলা হয়েছে ১৬টি। রাজধানীতে ছিনতাইয়ের ঘটনায় গত জানুয়ারি মাসে ৫টি ও ফেব্রুয়ারিতে আরো ৫টি মামলা হয়েছে। তবে ডিএমপির এ মামলার তথ্যে প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না। কারণ, ছিনতাইয়ের ক্ষেত্রে শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা থানায় গিয়ে মামলা করেন না।
রাজধানীতে গুলিতে নিহত শিক্ষার্থী সামিয়া আফরান প্রীতির বাবা মো: জামাল উদ্দিন বলেছেন মেয়ের হত্যার বিচার চাই না। মামলা চালানোর মতো অবস্থাও নেই। আমরা নিরীহ মানুষ। বিচার হয় না। বিচার চাইলে আল্লাহর কাছে চাই। তিনিই বিচার করবেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মামলা করব না। মামলা পরিচালনা করার মতো অবস্থা ও সুযোগ আমার নেই। কোনো বিবাদে জড়াতে চাই না। কেউ যদি সহযোগিতা করে সেটা ভিন্ন বিষয়।
শুধু নিহত প্রীতির বাবাই নয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দারস্থ হয়ে লাভের চেয়ে ঝামেলা বেশি এ জন্য অনেকেই থানায় মামলা করতে চান না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ জন্য দায়ী পুলিশের ব্যবস্থাপনা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত এ বাহিনী এখন শুধু রাজনৈতিক কারণে ব্যবহৃত হচ্ছে না; ঘুষ দুর্নীতি এবং ভুক্তভোগীদের সঙ্গে আচরণও ভালো করেন না। ফলে মানুষ বিপদে পড়লেও সহায়তা নিতে গিয়ে নতুন করে বিপদে পড়েন কি-না সে ভয়ে থানামুখি হতে চান না।
চলতি মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে মৌচাকের অফিস থেকে মেরুলবাড্ডার বাসায় ফিরছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী খন্দকার পলাশ। রিকশায় করে বাসায় ফেরার পথে রাত আটটার দিকে রামপুরা বাজার এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হন তিনি। খন্দকার পলাশ বলেন, ফোনে কথা বলছিলেন। হঠাৎ পেছন থেকে এক যুবক দৌড়ে এসে তার ফোনটি কেড়ে নিয়ে পালিয়ে যান। পুলিশের কাছে গেলে ঝামেলা হতে পারে। আবার ফোন উদ্ধার হবে কি না, সে নিশ্চয়তাও নেই। তাই থানায় গিয়ে কোনো অভিযোগ করেননি তিনি।
গত ২৩ মার্চ বুধবার দিনগত রাতে বংশাল থানার প্রবেশ গেটে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে এসআই রবি, হাসানসহ ৫ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে কনস্টেবল নজরুল ইসলামের অবস্থা গুরুতর।
ওসি আবুল খায়ের জানান, গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া এলাকায় থেকে ইমন ও জুয়েল নামে দুই ছিনতাইকারীকে পুলিশ হাতেনাতে ধরে ফেলে। পরে তাদের থানার গাড়িতে করে বংশাল থানার সামনে নিয়ে আসা হয়। থানার প্রবেশ গেটে গাড়ি থেকে নামিয়ে তাদের চেক করার সময় হঠাৎ ছিনতাইকারী ইমন সুইচগেয়ার বের করে পাঁচ পুলিশকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে। এতে এসআই হাসানসহ এএসআই তাজুল ইসলাম কনস্টেবল নজরুল, সজীব ও শফিকুল আহত হন। তবে গতকাল সোমবার পর্যন্ত ওই দু’জন অপরাধীকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
গত ২২ মার্চ মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে গুলিস্তান টিএন্ডটি অফিসের সামনের ফুটপাতে ছুরিকাঘাতে আহত হন এসআই জাহাঙ্গীর হোসেন। তিনি শাহবাগ থানায় কর্মরত। তিনি মামলার কাজে পুরান ঢাকায় জজকোর্টে যায়। রাতে বাসে করে গুলিস্তানে নামেন। রাস্তা পার হয়ে টিএন্ডটি অফিসের সামনে দিয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের দিকে যাচ্ছিলেন। এ সময় টিএন্ডটি অফিসের সামনে আসলে পেছন থেকে কে বা কারা তাকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায়ও জড়িতদের গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, রাজনীতির সঙ্গে সন্ত্রাসবাদ মিলে গেছে। তাই সন্ত্রাসীরা একটি করিডোর বা সেফ জোন পেয়েছে। রাজনীতিবিদরাও তাদের ব্যবহার করে। আবার সন্ত্রাসীরাও রাজনীতিবিদদের ব্যবহার করে। সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করে স্বার্থের রাজনীতি যত বৃদ্ধি পাবে, তত অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীও বাড়তে থাকবে। সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চা হলে এসব অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন