বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

রাসুল সা.-এর চরিত্র মাধুরী

নাজমুল হাসান সাকিব | প্রকাশের সময় : ৩১ মার্চ, ২০২২, ১২:০৪ এএম

মহানবী সা. ছিলেন মহান চরিত্রের অধিকারী ও আদর্শের জীবন্ত প্রতীক। আল-কুরআন-ই হল তাঁর জীবনাদর্শ। হযরত আয়েশা রাযি.- বলেন, “তিনি ছিলেন আল-কুরআনের মূর্ত প্রতীক”। তিনি তাঁর জীবনে আল-কুরআনের প্রতিটি অনুশাসনের রূপায়ণ ও বাস্তবায়ন করেছেন। এজন্য তাঁকে ‘জীবন্ত কুরআন’ও বলা হয়।

জন্মলগ্ন থেকেই তাঁর মাঝে বিরাজ করছিল সর্বোত্তম চরিত্র মাধুরী, সর্বোত্তম আদর্শ। তিনি ছিলেন সর্বোত্তম মানুষ। বাল্যকাল থেকেই তাঁর স্বভাব ছিল কলুষতা, কাঠিন্য ও কর্কশতামুক্ত। নম্রতা ছিল তাঁর প্রধান হাতিয়ার। তিনি ছিলেন দয়াশীল, সহনশীল ও সহানুভূতিশীল এবং সর্বমহলে বিশ^স্ত।

ওয়াদা পূরণ বা অঙ্গীকার পালন করা নবী সা.-এর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকার পালন না করাকে তিনি জঘন্যতম পাপ বলে অভিহিত করেন। তিনি ঘোষণা করেন “যে অঙ্গীকার পালন করে না তার ধর্ম নেই”। তাই তিনি নির্দেশ দেন: “তোমরা যখন অঙ্গীকার করবে, তখন তা পালন করবে”।

ব্যক্তিগতভাবে ওয়াদা/অঙ্গীকার পালনে তিনি ছিলেন নিষ্কলুষ ও নির্ভেজাল। তাই তো অতি অল্প বয়সেই তিনি ‘আল-আমিন’ উপাধিতে ভূষিত হন। সাহাবী কবি হাসসান বিন সাবিত রাযি. রাসুল সা. সম্পর্কে বলেছেন,
অর্থাৎ: আপনার চেয়ে সুন্দর আমার দু‘চোখ কাউকে কখনো দেখেনি, আপনার চেয়ে সুন্দর সন্তান কোন নারী কখনো জন্ম দেয়নি। আপনাকে সৃষ্টি করা হয়েছে সকল দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত করে। হে আল্লাহ! আপনি যেমন চেয়েছেন ঠিক তেমন করেই তাঁকে সৃষ্টি করেছেন।

কবির এই কবিতাই বলে দিচ্ছে কেমন ছিলেন তিনি। কেমন ছিল তার অনুপম চরিত্রের সৌন্দর্য। অনুভব করার বিষয়। এজন্য তাঁর উন্নত আর্দশের স্বীকৃতি দিয়েছেন মহান আল্লাহ তায়ালা।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “নিশ্চয় আপনি সুমহান চরিত্রের অধিকারী”। (সুরা আল-কলম: ০৪)

আল্লাহ্ তায়ালা তাঁকে শুরু থেকেই সুন্দর ভূষণে নিরন্তর বিভূষিত করেছিলেন। অন্যায়ের প্রতিকার ও প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা আর বালা-মুসীবতে সহ্য ও স্থিরতা ছিল আখলাকে নববীর অন্যতম ভূষণ। প্রত্যেক ধৈর্য ও সহনশীল লোকদের জীবন বৃত্তান্ত খোঁজে দেখলে তাতে অবশ্যই কোন না কোন বিকৃতি ও ফাঁক-ফোঁকর পাওয়া যাবে। কিন্তু এর বিপরীতে রাসুল সা.-এর চরিত্র মাধুরী ছিল এতটা নিñিদ্র, এতটা সুনির্মল যে, শত্রুদের পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি জুলুম ও অত্যাচারের মাত্রা যতটা বেড়ে গিয়েছিল ঠিক তাঁর সহিষ্ণুতা আর স্থিরতার সীমাও ততটা বিরল ইতিহাসের জন্ম দিয়ে যাচ্ছিল। আরবের মূর্খ-মানুষগুলোর সীমালঙ্ঘনের পরিধি যতটা বেড়েছিল তাঁর সহনশীলতার পরিধিও ততটা বিস্তৃত হয়েছিল। হজরত আয়েশা রাযি. বলেন, যে কোন ক্ষেত্রে যখন রাসুল সা.-এর সামনে দু’টি পথ খোলা থাকত তখন তিনি বরাবর সহজ পথটিই অবলম্বন করতেন যতক্ষণ না গুনাহর পর্যায়ে পৌঁছে যেত। কারণ যে কোন গুনাহের কাজ থেকে তিনি ছিলেন দূরে। নিজের স্বার্থে তিনি কোনদিন কারও থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। কিন্তু আল্লাহর কোন বিধান লঙ্ঘণ করা হলে সে ক্ষেত্রে তিনি প্রতিশোধ নিতে দ্বিধায় ভুগতেন না। (বুখারী শরীফ: ১/৫০৩) রাগ আর ক্রোধ থেকে তিনি ছিলেন সবার চেয়ে দূরে আর রাযী ও সন্তুষ্টির ক্ষেত্রে সবার চেয়ে আগে। রাগ শয়তানের কুমন্ত্রণার অংশ বিশেষ বলে তিনি কখনো রাগ করতেন না। এজন্যই তিনি এক আগন্তুক ব্যক্তিকে উত্তম নসিহত হিসেবে বলেন, ‘রাগ করো না’। এমনটি তিনি তিনবার বলেছেন। (বুখারী শরীফ: ২/৯০৩) তবে পূর্বে যে বিষয়টি বলা হয়েছে যে, নিজের স্বার্থে তিনি কোনদিন কারও থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। কিন্তু আল্লাহর কোন বিধান লঙ্ঘণ করা হলে সে ক্ষেত্রে তিনি প্রতিশোধ নিতে দ্বিধায় ভুগতেন না। তা আপন জায়গায় বহাল থাকবে। হজরত আয়েশা রাযি.-এর সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সা. কখনো কাউকে মেরেছেন এমনটি হয়নি। নিজের কোন স্ত্রীর বেলায়ও না; এমনকি কোন সেবক, কর্মচারীর ক্ষেত্রেও না। তবে জিহাদের ময়দানে আল্লাহ তায়ালার জন্য বেঈমানদেরকে হত্যা করেছেন। কেউ তাকে কষ্ট দিলে তিনি তার থেকে প্রতিশোধ নিতেন না। তবে শরীয়তের কোন হুকুম লঙ্ঘণ করলে দোষী হিসেবে তাকে শাস্তি দিতেন। (সহিহ মুসলিম শরীফ)

মহানবী সা.-এর বদান্যতা ছিল তাঁর অন্যতম জীবনাদর্শ। দয়া ও দানশীলতা ছিল তাঁর চরিত্রের ভূষণ। নিজের কাছে কিছু থাকলে তিনি কাউকে ফিরিয়ে দিতেন না।

হজরত মুসা বিন আনাস রাযি. তাঁর পিতা সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসুল সা.-এর কখনো এমন হয়নি যে, কেউ তার কাছে কিছু চেয়েছে আর তিনি তা দেননি। তিনি বলেন, একবার একব্যক্তি নবিজী সা.-এর কাছে একটি ছাগল চাইলে তিনি তাকে এত বেশি পরিমাণ দান করলেন, যা দুই পাহাড়ের মধ্যস্থান পূর্ণ করে দেবে। অতঃপর লোকটি নিজ সম্প্রদায়কে বললেন, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা ইসলাম গ্রহণ করো। কেননা, মুহাম¥াদ সা. এতবেশি দান করেছেন যে, তিনি নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার ভয় করেন না। (সহিহ মুসলিম শরীফ)

হজরত আনাস রাযি. বলেন, লোকটি রাসুল সা.-এর কাছে শুধুমাত্র দুনিয়াবী স্বার্থের জন্যই এসেছিল। কিন্তু সন্ধ্যাবেলা এমন অবস্থা সৃষ্টি হল যে, রাসুল সা.-এর আনীত দীন উক্ত ব্যক্তির কাছে পৃথিবী ও তার মধ্যকার সকল কিছু থেকে শ্রেয়। (মুসনাদে আহমাদ)

কথাবার্তা, মতপ্রকাশ ও কোন কাজ করতে যাওয়ায় সাহসিকতা প্রদর্শন একটি চমৎকার গুণাবলী। যুদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ অবস্থায় তিনি ছিলেন সকল মানুষের চেয়ে বেশী সাহসী। বীর সিপাহী হজরত আলী রাযি. বলেন, যখন প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হত তখন আমরা রাসুল সা.-কে আড়াল নিয়ে আত্মরক্ষা করতাম। তিনি থাকতেন আমাদের মধ্য থেকে শত্রুদের সবচেয়ে নিকটবর্তী। এর অনেক প্রমাণ রয়েছে উহুদ ও হুনাইন যুদ্ধে।

নবীজী সা.-এর সর্বোত্তম আদর্শের অন্যতম ছিল তাঁর লজ্জাশীলতা। লজ্জাশীলতা ছিল তাঁর চরিত্রের এক মহান ভূষণ। লজ্জাশীলতা সম্পর্কে তিনি বলেন-“লজ্জা হলো ঈমানের অঙ্গ”। বস্তুত মহানবী হজরত মুহাম্মাদ সা.-এর প্রতিটি বাণী, কাজ-কর্ম, কথা-বার্তা, আচরণ এবং তাঁর জীবনের প্রতিটি ঘটনা ও তৎপরবর্তী বিশ্ববাসীর জন্য সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ, উৎকৃষ্টতম, অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় আদর্শ। একটি অনুপম আদর্শ ও চরিত্রে যতগুলো মহৎগুণ প্রয়োজন, মানব হিতৈষী বিশ্বনেতা মহানবী সা.-এর চরিত্রে তার সবগুলোরই অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছিল। তিনি তাঁর উৎকৃষ্টতম আদর্শের মাধ্যমে বিশ্ব মানবতাকে সত্যের দিকে আকৃষ্ট করেছেন। তাঁর অনুপম আদর্শে মুগ্ধ হয়ে মানুষ দলে দলে ইসলামের শান্তির পতাকাতলে সমবেত হয়ে তাঁর আদর্শে নিজেদের জীবনকে উজ্জ্বল করে গড়ে তুলেছিল। মানব জীবনের প্রতিটি ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তিনি বিশ্ব মানবতার জন্য শ্রেষ্ঠতম ও অনিন্দ্য সুন্দর অনুসরণীয় আদর্শ উপহার দিয়ে গেছেন যা প্রতিটি যুগ ও শতাব্দীর মানুষের জন্য মুক্তির দিশারী হিসেবে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।

উপরোক্ত আলোচনায় বর্ণিত নবীজী সা.-এর কয়েকটি বিশেষ গুণাবলী দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রতিয়মান হয় যে, হজরত মুহাম্মাদ সা. ছিলেন সর্বাপেক্ষা উত্তম চরিত্রের অধিকারী। যার পক্ষে পবত্রি কুরআনুল কারীমও একই কথা বলেন। যার জন্যে বলতে হয়, নবীজী সা. সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ একজন আদর্শ মহামানব এবং তিনি আখেরী নবী। কেয়ামত পর্যন্ত যারা তার অনুসরণ করবে অবশ্যই তারা হেদায়েত পাবে। আর ইহকালে শান্তি ও পরকালে মুক্তি লাভ করবে। নবীজী সা.-এর প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা-ভক্তি আমাদের আছে। কেন-ই বা থাকবেনা, অথচ তিনি সর্বোত্তম চরিত্র মাধুরীর অধিকারী সুন্দরতম মানুষ। প্রিয় নবী সা.-কে ভালবাসি তাঁর চরিত্র মাধুর্যের জন্যে, তাঁর অনুপম আদর্শের জন্যে।

লেখক : তাখাসসুস ফিল ফিকহ: আল-মারকাজুল ইসলামী বাংলাদেশ।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
কবির হোসেন ২০ অক্টোবর, ২০২২, ৩:৩৪ পিএম says : 0
সত্যিই নবী হয়রত মুহাম্মাদ (স) ছিলেন উত্তম চরিত্রে অধিকারি
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন