মহান আল্লাহ তাআ›লার কাছে তাঁর বান্দার যুবক বয়স অনেক বেশী পছন্দের ও মাকবুলের। যুবক বয়সের গুরুত্ব নিয়ে একটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, “কেয়ামতের দিন মাত্র সাত শ্রেণীর মানুষ মহান আল্লাহ তাআলার পবিত্র আরশে আযীমের নিচে ছায়া পাবে। সেই সাত শ্রেণীর মধ্যে এক শ্রেণী হবে সেই সকল যুবকের যারা তাদের যুবককালীন সময় ইবাদতে কাটিয়েছেন।” অর্থাৎ, যুবক বয়সের মাহাত্ম্য অকল্পনীয়। কিন্তু, পরিতাপের বিষয় এই যে, এই দুর্দান্ত বয়সে আমরা সঠিক পথের উপর অটল থাকতে পারি না, ধৈর্য ধারণ করতে পারি না। ফলে, অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে যায় পরকালের সুখময় বৃহৎ জীবনের সম্ভাবণা। যুবক বয়সে যুবকেরা নানা ধরণের পাপ ও অপকর্মে ডুবে থাকে। এই লেখায় সেরকমই বড় পাঁচটি গুণাহের স্বরুপ আলোচনা করা হবে, ইনশাআল্লাহ্।
প্রথমত, পরনারীর প্রতি দৃষ্টি: ইসলাম চারিত্রিক উৎকর্ষতার ধর্ম। নবী কারীম (সা.) বলেছেন, ্রনিশ্চয় মানুষদের মধ্যে ইসলামের ক্ষেত্রে সর্বোত্তম সে ব্যক্তি যে তাদের মধ্যে চরিত্রের দিক দিয়ে সবচেয়ে সুন্দরগ্ধ-(সহীহ বুখারী)। মানুষের চরিত্র ফুটে ওঠে তার আচার-আচরণ এমনকি তার চাহনির মধ্যেও। একজন পুরুষ বা স্ত্রী›র জন্য কোন নন-মাহরাম বা রক্তের সম্পর্কিত আত্মীয় ছাড়া অন্য কোন স্ত্রী বা পুরুষদের সাথে যাবতীয় মেলামেশা(কথা বার্তা, দেখা করা...) হারাম। কারণ, তাতে বিপদের সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়। যে বিপদের বাস্তব চিত্র আজকালকার সমাজে অহরহ দেখা যাচ্ছে।
হযরত আলী (রা.) বর্ণনা করেন, নবী কারিম তাকে বলেছেন, ্র...একবার দৃষ্টি নিক্ষেপের পর দ্বিতীয়বার দৃষ্টি নিক্ষেপ করবে না(বেগানা নারীর প্রতি)। কেননা, প্রথম দৃষ্টি তোমার স্বপক্ষে কিন্তু দ্বিতীয় দৃষ্টি তোমার বিপক্ষে।গ্ধ অর্থাৎ, রাস্তায় চলতে চলতে যদি কোন বেগানা নারীর প্রতি নজর চলে যায় তাহলে তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে হবে। দ্বিতীয়বার দৃষ্টি দেয়া তো দূরের কথা, প্রথম দৃষ্টিও দীর্ঘস্থায়ী করা যাবে না। প্রথম দৃষ্টি হতে পারে অসাবধানতাবশত অথবা চলার রাস্তা দেখার জন্য। অন্যত্র, মানুষের দৃষ্টিকে শয়তানের বিষাক্ত তীরের সাথে তুলনা করা হয়েছে। মানে, তীর যেমন মানুষের প্রাণনাশ করে তেমনি কু-দৃষ্টি মানুষের ঈমাননাশ করে।
অতএব, ঈমানের স্বার্থে, আল্লাহর ভয়ে ও জান্নাতের চিরস্থায়ী সুখের আশায় আমাদেরকে আমাদের দৃষ্টির হেফাজত করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বিজাতীয়দের অনুকরণ: পৃথিবীতে এমন কোন সমস্যা নেই যেটি ইসলামে আলোচনা করা হয় নি বা যার সমাধান ইসলামে নেই। একজন মানুষ তার ভালোর জন্য যা তালাশ করে বা যা কিছুর দরকার পড়ে তার সবকিছুই ইসলামের মধ্যে রয়েছে। আর যে জিনিসটি মানুষের জন্যে অপকারী ও নিষ্প্রয়োজন তা ইসলামের সুরক্ষিত গন্ডির বাইরে। এই জাহানের মধ্যে ইসলামই একমাত্র শতভাগ ভাইরাস ও জাঙ্কমুক্ত জীবনব্যবস্থা।
অথচ, আফসসের বিষয় হলো, আমাদের মুসলিম উম্মাহর অনেকে আজ ইসলাম ছেড়ে বিজাতি ইহুদি, মুশরিক, ক্রিশ্চানদেরকে নিজেদের আদর্শ বলে মেনে নিচ্ছে। তাদের লাইফস্টাইল চর্চা করছে। এমনকি, তাদের সাথে মিলে পালন করছে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানও। এভাবে মুসলিম সমাজে প্রমোট করছে থার্টি ফার্স্ট নাইট, ভ্যালেন্টাইন ডে কিংবা এপ্রিল ফুল এর মতো মুসলিম বিদ্বেষী, বেহায়া আর নির্লজ্জ দিবসগুলোকে। এগুলো ছাড়াও কেউ কেউ বিজাতীদের মতো পোশাক-পরিচ্ছেদ, খাওয়া-দাওয়া, চলা-ফেরা, উঠা-বসা, চাল-চলন ইত্যাদিতে তাদের অনুসরণ করছে। অথচ, পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে বলেছেন “তোমরা (মুসলমানগণ) কাফির ও মুনাফিকদের অনুসরণ-অনুকরণ করো নাগ্ধ-(সূরা আহযাব)। অন্যদিকে, হাদিসে এসেছে, ্রযে ব্যক্তি যে সম্প্রদায়ের সাথে মিল বা সম্পর্ক রাখবে, তাদেরকে অনুসরণ-অনুকরণ করবে, সে তাদের দলভুক্ত হয়ে যাবে। অর্থাৎ, তার হাশর-নশর তাদের সাথে হবেগ্ধ- (আবু দাউদ)গ্ধ। অতএব, মুসলিম হয়ে যারা কাফের, মুশরিকদের বা অন্যদের অনুসরণ করবে উক্ত হাদিস মোতাবেক তাদের হাশরও হবে সেই অমুসলিম ও কাফেরদের সাথে। আর যাদের হাশর মুশরিকদের সাথে তাদের পরকালের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
সুতরাং, আমাদেরকে অমুসলিমদের থেকে শিক্ষা লাভের কোন কিছু নেই, যেহেতু তাদের নিজেদেরই প্রকৃত শিক্ষা(পরকাল কেন্দ্রিক)বলতে কোন কিছুই নেই। মহান আল্লাহ তাআ›লা মুসলিমদেরকে সকল দুনিয়াবি ফেতনা- ফাসাদ থেকে হেফাজত করুন।
তৃতীয়ত, হারাম বিনোদন: ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। এতে মানুষের সকল ধরণের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে নির্দেশনা রয়েছে। মানবজীবনে যে বিনোদনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে সেটিও ইসলামে বর্ণনা করা আছে। পবিত্র কুরআনে বিনোদনের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। যেমন, সূরা আনআমে মহান আল্লাহ তাআ›লা তাঁর বান্দাদেরকে সফরের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। বিনোদনের আরো অনেক মাধ্যম রয়েছে যেমন- কবিতা আবৃতি, খেলাধুলা, সঙ্গীত, প্রতিযোগীতা ইত্যাদি, যেগুলোর ভিত্তি নবী সা. এর বিভিন্ন হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। অথচ, বর্তমানকালের যুবকেরা বিনোদনের নামে এক বিশাল পাপ সাগরে ডুবে আছে, তাদের বিনোদন অর্থহীন গান ও কুরুচিপূর্ণ নাচে। এমন অসুস্থ বিনোদন মনকে প্রভাবিত করে, ভুলিয়ে রাখে আল্লাহর ইবাদত। এই ধরণের বিনোদন ইসলামী বিধান অনুযায়ী সম্পূর্ণ হারাম। আমরা মুসলিম। আমাদের উচিৎ আমাদের নিজস্ব ধর্মীয় সংস্কৃতি আঁকড়ে ধরে সে মোতাবেক জীবন পরিচালনা করা।
চতুর্থত, নেশায় আসক্তি: হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,গ্ধসব ধরণের নেশা সৃষ্টিকারী দ্রব্য হারাম। শুধু দ্রবাদিই নয় নেশাযুক্ত যেকোন কাজই হারাম। কেননা, নেশা মানুষের স্বাভাবিক জ্ঞানকে কমিয়ে দেয়, সময়জ্ঞান হ্রাস করে। একজন নেশাগ্রস্ত মানুষ বিপজ্জনক, তাকে দিয়ে যেকোন পাপ কাজই সম্ভব।
আধুনিক এ কালে নেশাদায়ক বস্তু আজ মানুষের হাতের নাগালে। গভীরভাবে ভাবলে দেখা যাবে, আমাদের হাতের মোবাইল, পাশের ল্যাপটপ বা ডেস্কটপই আমাদেরকে নেশার সাতপ্যাঁচে ফেলে দিতে পারে। ক্ষেত্র বিশেষে এ নেশা মাদকের চেয়েও ভয়ংকর। মাদকের ভয়াবহতা কোন বিশেষ দিকে থাকলেও প্রযুক্তি নেশার ভয়াবহতা ব্যাপক। মাদকের চোরাচালান বন্ধ করা গেলেও প্রযুক্তির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার বন্ধ করা অসম্ভব। এগুলো ছাড়াও আরো অনেক ধরণের নেশাজাতীয় জিনিস রয়েছে। কিছু নেশা হতে পারে স্বভাবগত যেমন নারীনেশা, অর্থনেশা, খ্যাতিনেশা ইত্যাদি।
সমস্তরকম জাগতিক নেশার পাশ কাটিয়ে আমরা আমাদের স্বাভাবিক জীবনের সুন্দর অভ্যাসগুলো চর্চা করব। ধারাবাহিতা রক্ষা করব ইবাদাত ও আমলের, ইনশাআল্লাহ।
পঞ্চমত, অশ্লীল বা অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা: (খুব সম্ভবত) পৃথিবীতে যত দাঙ্গাফাসাদ, যুদ্ধ ও বিশৃঙ্খলাই সৃষ্টি হোক না কেন তার মূল কারণ সামান্য কথা। অর্থাৎ, কথাই সকল রক্তারক্তির মূল। নবী কারীম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ্রযে চুপ থাকে সে মুক্তি পাবেগ্ধ-(তিরমিজি)। যে যত বেশী কথা বলবে তার কথায় তত বেশী ভুল বা মিথ্যা থাকার সম্ভাবণা থেকে যাবে। আর, যত মিথ্যা তত গুনাহ। হাদীসে জিহ্বা বা কথা সংযত করার ব্যাপারে একাধিক নির্দেশনা জারি করা হয়েছে সেই সাথে কথা সংযত করার ব্যাপারে আকর্ষণীয় পুরষ্কারও ঘোষণা করা হয়েছে। যেমন, নবী কারীম (সা.) তাঁর এক হাদীসে বলেছেন,গ্ধ যে ব্যক্তি নিজের লজ্জাস্থান এবং জিহ্বার ব্যাপারে আমাকে নিশ্চয়তা দিতে পারবে আমি তার জন্য জান্নাতের জিম্মাদার হবগ্ধ-(সহীহ বুখারী)। কিন্তু আমরা বাস্তবে দেখি যুবকদের মধ্যে অতিরিক্ত কথা বলার প্রবণতা মাত্রাতিরিক্ত। তিন, চারজন যুবকের একসাথে দেখা হলেই জমে ওঠে তাদের আড্ডা। ভার্চুয়াল জগতের ফলে আড্ডাদেয়া এখন অতি সহজ। (চলবে)
লেখক: শিক্ষার্থী, আরবী বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন