শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

টিকার ব্যয়ে ২৩ হাজার কোটি টাকা গরমিল

টিআইবি’র গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ ক্রয়-ব্যবস্থাপনাসহ সব মিলে ১৮ হাজার কোটি টাকা খরচ হতে পারে : ড. ইফতেখারুজ্জামান ঘুষ লেনদেনে বাধ্য হয়ে ২২ শতাংশের বেশি সেবাগ্রহিতা দুর্নীতির শিকার

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৩ এপ্রিল, ২০২২, ১২:০০ এএম

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের নেয়া টিকা কার্যক্রমে অর্থ ব্যয়ে স্বচ্ছতার ঘাটতি রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা খরচের কথা বলা হলেও টিকার প্রাক্কলিত ক্রয়মূল্য ও টিকা ব্যবস্থাপনার প্রাক্কলিত মোট ব্যয় হয়েছে ১২ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা থেকে ১৬ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। যা স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের দেয়া হিসাবের অর্ধেকেরও কম। ফলে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকার গরমিল রয়েছে। গতকাল ‘করোনা ভাইরাস সংকট মোকাবিলায় সুশাসন: অন্তর্ভুক্তি ও স্বচ্ছতার চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গবেষণায় প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। গবেষণাটি করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি)।
টিআইবি বলছে, ২০২১ সালের আগস্ট থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত গবেষণাটি করা হয়। গবেষণার অংশ হিসেবে ৪৩টি জেলায় ১০৫টি টিকা কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করা হয়। যার মধ্যে ৬০টি অস্থায়ী এবং ৪৫টি স্থায়ী টিকা কেন্দ্র ছিল। এছাড়া ৪৩ জেলার ৪৮টি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ৬৭১ জনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে এই গবেষণায়। অন্যদিকে করোনা সংশ্লিষ্ট জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে সরকারিভাবে ক্রয় করা হয়েছে প্রায় ৯ কোটি ২ লাখ ডোজ, কোভ্যাক্স কস্ট শেয়ারিং এর মাধ্যমে ৮ কোটি ৭ লাখ ডোজ টিকা ক্রয় এবং বিভিন্ন দেশের সরকার ও কোভ্যাক্স থেকে অনুদানের মাধ্যমে প্রায় ১১ কোটি ৭ লাখ ডোজ টিকা বিনা মূল্যে পাওয়া গিয়েছে। এক্ষেত্রে কোভিশিল্ড প্রতিডোজ ৫ ডলার (৪২৫ টাকা), সিনোফার্ম ১০ ডলার (৮৫০ টাকা) এবং কোভ্যাক্স কস্ট শেয়ারিং ৫.৫ ডলার (৪৬৭.৫ টাকা) হিসাবে ধরে আনুমানিক টিকার খরচ দাঁড়ায় ১১ হাজার ২৫৪.৪ কোটি টাকা। কিন্তু স্বাস্থ্যমন্ত্রী ২০২২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি গণমাধ্যমে তার বক্তব্যে করোনা টিকা ক্রয়ে ব্যয় ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি বলে উল্লেখ করেন।

অন্যদিকে ২০২১ সালের জুলাই মাসে গণমাধ্যমে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের মাধ্যমে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে টিকা প্রতি ৩ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। পরবর্তীতে ২০২২ সালের ১০ মার্চ গণমাধ্যমে টিকা কার্যক্রমে মোট ব্যয় ৪০ হাজার কোটি টাকা বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রী উল্লেখ করেন। সরকারি তথ্যমতে ২০২১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত মোট ২৪ কোটি ৩৬ লাখ ডোজ টিকা প্রদান করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের টিকা পরিকল্পনায় টিকা কার্যক্রম সম্পর্কিত ব্যয় টিকা প্রতি দুই ডলার (১৭০ টাকা) হিসেবে ধরা হয়। এছাড়া কোভ্যাক্স রেডিনেস অ্যান্ড ডেলিভারি ওয়ার্কিং গ্রুপের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের টিকা কার্যক্রম সম্পর্কিত ব্যয়ের মডেল করা হয় যেখানে একটি দেশের টিকা কার্যক্রমে বিদ্যমান অবকাঠামো ও জনবল ব্যবহার এবং আউটরিচ কেন্দ্রের অনুপাত বিবেচনায় টিকা ক্রয়ের পর থেকে মানুষকে টিকা দেওয়া পর্যন্ত সকল ব্যয় হিসাব করে টিকা প্রতি ব্যয় ধরা হয়েছে ০.৮৪ ডলার (৭১.৪ টাকা) থেকে ০২.৬৪ ডলার (২২৪.৪ টাকা)। সেই হিসাবে টিকা কার্যক্রম সংক্রান্ত ব্যয়ের প্রাক্কলিত পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৩৯.৬ কোটি টাকা থেকে ৫ হাজার ৪৬৭.৩ কোটি টাকার মধ্যে। উল্লিখিত টিকার প্রাক্কলিত ক্রয়মূল্য ও টিকা ব্যবস্থাপনার প্রাক্কলিত মোট ব্যয় দাঁড়ায় ১২ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা থেকে ১৬ হাজার ৭২১ কোটি টাকা যা স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রদত্ত হিসাবের অর্ধেকেরও কম। শুধু একটি দেশের ক্ষেত্রে টিকার ক্রয়মূল্য প্রকাশ না করার শর্ত থাকলেও অন্যান্য উৎস থেকে কেনা টিকার ব্যয় এবং টিকা কার্যক্রমে কোন কোন খাতে কত টাকা ব্যয় হয়েছে তা প্রকাশ করা হয়নি।

গবেষণা প্রতিবেদনে টিকা কার্যক্রমের বেশ কিছু ঘাটতির কথা উল্লেখ করা হয়। করোনা টিকা ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম-দুর্নীতি টিকা কেন্দ্রে টিকা গ্রহণের সময় ২ শতাংশ সেবাগ্রহীতা অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হয়েছেন; যার মধ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে সময়ক্ষেপণ, টিকা কেন্দ্রে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সরকারি কর্মকর্তাদের সুবিধা দেওয়া, দুর্ব্যবহার এবং কিছু কেন্দ্রে টিকা থাকা সত্ত্বেও টিকা কেন্দ্র থেকে টিকাগ্রহীতাদের ফিরিয়ে দেওয়া উল্লেখযোগ্য।

টিকা কেন্দ্রে অতিরিক্ত ভিড় এড়িয়ে যথাসময়ে বা দ্রুত টিকা পেতে ১০.১ শতাংশ সেবাগ্রহীতাকে গড়ে ৬৯ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। এছাড়া প্রবাসীরা টিকার নিবন্ধনের জন্য বিএমইটি নম্বর পেতে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছে। দু’একটি কেন্দ্রে নিয়ম-বহির্ভূতভাবে ১ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকার বিনিময়ে পছন্দ অনুযায়ী টিকা প্রদান করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে টিকা না নিয়েও টাকার বিনিময়ে প্রবাসীরা টিকা সনদ সংগ্রহ করতে হয়েছে। টাকার বিনিময়ে টিকা করা একটি গ্রুপ ফেসবুক পেজে প্রবাসীদের চাহিদা অনুযায়ী টাকার বিনিময়ে টিকা সার্টিফিকেট দেওয়ার বিষয়ে প্রচার করতে দেখা গেছে।

টিকা কার্যক্রমে অসমতা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এলাকায় উদ্বুদ্ধকরণ ও প্রচার কার্যক্রমে ঘাটতি, টিকা বিষয়ক তথ্যপ্রাপ্তিতে ঘাটতি, টিকা প্রাপ্তির প্রক্রিয়া সহজ না করা, টিকা কেন্দ্রে বিশেষ জনগোষ্ঠীর জন্য ব্যবস্থা না রাখা, টিকা কার্যক্রমে অব্যবস্থাপনা, করোনা চিকিৎসা সেবা ও নমুনা পরীক্ষায় অনিয়ম-দুর্নীতি, টিকাগ্রহীতাদের উদ্বুদ্ধকরণ ও প্রচার কার্যক্রমে ঘাটতি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং প্রস্তাবিত কৌশল বাস্তবায়নে ঘাটতির বিষয়ও উঠে এসেছে গবেষণায়।

এ সময় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, টিকা কার্যক্রমে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যন্য দেশগুলোর তুলনায় আমরা এগিয়ে রয়েছি। সার্কভুক্ত দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান তৃতীয়। এটি একটি ইতিবাচক দিক। তবে টিকা কার্যক্রমের বেশকিছু ঘাটতি রয়েছে। টিআইবির গবেষণার কারণ জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, আমাদের এই গবেষণায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উপস্থিতির বিষয়টি তুলে ধরেছি। জাতীয় পরিকল্পনায় বলা হয়েছিল দুর্গম এলকার, বস্তিবাসি, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদেও বাড়ি বাড়ি গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা হবে। তাদের ক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ টিকা দেয়া হবে। কিন্তু তাদের নিয়ে বাস্তবে সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম দেখা যায়নি। এ কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর টিকা প্রাপ্তির হার জাতীয় হারের তুলনায় অনেক কম। এটা উদ্বেগের বিষয়। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষেরা টিকা নেয়ার ক্ষেত্রে অবহেলা ও বৈষম্যের শিকার হয়েছে। তিনি বলেন, টিকা ব্যয়ে স্বচ্ছতার ঘাটতি ছিল। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোটাদাগে কয়েকটি ব্যয়ের কথা বলেছেন। টিকা ব্যয়ের কোন সুনির্দিষ্ট নির্ভরযোগ্য তথ্য জানানো হয়নি। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মিডিয়ায় টিকা বাবদ ৪০ হাজার কোটি টাকা খরচের কথা বলেছে। কিন্তু আমরা বিশ্লেষণ করে পেয়েছি টিকা ক্রয় ও ব্যবস্থাপনাসহ ১৮ হাজার কোটি টাকা খরচ হতে পারে। টিকার ক্ষেত্রে গোপনীয়তার সংস্কৃতি চলছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (6)
Sattar ১৩ এপ্রিল, ২০২২, ৪:২১ এএম says : 0
আরেকটা পদ্মা সেতু হতো এ টাকা দিয়ে
Total Reply(0)
Parvej ১৩ এপ্রিল, ২০২২, ৪:২১ এএম says : 0
আমাদের দেশের দলকানারা শুধু উন্নয়ন উন্নয়ন করে।উন্নয়নের নামে যে চুরি করে তা দেখেনা। তাদের কাঠের চশমাপরা উচিত।
Total Reply(0)
Md Obaydul Hoque ১৩ এপ্রিল, ২০২২, ৪:২২ এএম says : 0
এতদিন শুনেছিলাম এইদেশ টিকা পাঠাচ্ছে ঐদেশ টিকা পাঠাচ্ছে আর এখন শুনি টিকা ক্রয়ে ২২ হাজার কোটি টাকার ফারাক,সব অসম্ভবকে সম্ভব করার দেশ বাংলাদেশ
Total Reply(0)
Md Khalilur Salim ১৩ এপ্রিল, ২০২২, ৪:২২ এএম says : 0
অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে‌‌ সাথে খরচের সমন্বয় না থাকলে ‌আভিজাত্য প্রকাশ পায় না।তাই হয়তো এই বাড়তি ব্যয়।
Total Reply(0)
Md Rashedul Islam ১৩ এপ্রিল, ২০২২, ৪:২৩ এএম says : 0
জানতাম.... শ্রীলংকা দেশটাতো আর এমনিতেই দেউলিয়া হয়নাই... দেউলিয়া দেশটা হয়েছে, রাজা বাদশারা তো হননাই... ওনারা আছেন বহাল তবিয়তে গোপন সম্পদের ভান্ডারের সুঘ্রাণে...
Total Reply(0)
Miller Biswas ১৩ এপ্রিল, ২০২২, ৪:২৩ এএম says : 0
This is sad and also a disappointing news for us.
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন