শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আন্তর্জাতিক সংবাদ

বিশ্বের জনপ্রিয় খেলনা লেগো ব্রিকের জন্ম হলো যেভাবে

অনলাইন ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৯ এপ্রিল, ২০২২, ২:২৩ পিএম

ডেনমার্কের বিলুন্ড শহরের লোগোল্যান্ড।


বিশ্বের জনপ্রিয় খেলনাগুলোর একটি লেগো ব্রিক। ১৯৫৮ সালে ডেনমার্কের ছোট্ট একটি শহর বিলুন্ডে এই খেলনাটির জন্ম। গডফ্রেড কির্ক ক্রিস্টিয়ানসেন প্লাস্টিকের এসব ব্রিক উদ্ভাবন করেন যা একসাথে জোড়া দিয়ে নানা রকমের জিনিস তৈরি করা যায়। সারা দুনিয়ায় এই লেগোর হাজার হাজার কোটি পিস বিক্রি হয়েছে।

লেগো উদ্ভাবনের সময় গডফ্রেডের ছেলে কিয়েল্ড কির্ক ক্রিস্টিয়ানসেনের বয়স ছিল মাত্র দশ বছর। কোম্পানির কারখানায় বসেই লেগো দিয়ে খেলতেন তিনি। শুধু তাই নয়, খেলনাটি তৈরির পর এর প্রাথমিক মডেল পরীক্ষাতেও তিনি সাহায্য করতেন। ডেনমার্কের পশ্চিমাঞ্চলে ছোট্ট একটি শহর- বিলুন্ড। এই শহরেই কিয়েল্ড কির্ক ক্রিস্টিয়ানসেনের দাদা ওলে কির্ক ক্রিস্টিয়ানসেন একজন কাঠমিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতেন।

কিয়েল্ড বলেন, "সেসময় সুইডেন ও ডেনমার্কে বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি হয়েছিল যা সারা বিশ্বেই আঘাত হেনেছিল। মানুষের কোনো কাজ ছিল না, বিশেষ করে ডেনমার্কের এই গ্রামীণ এলাকায়।" "আমার দাদা ওলে কির্ক ক্রিস্টিয়ানসেন তখন গৃহস্থালির জন্য প্রয়োজনীয় নানা ধরনের জিনিসপত্র বানাতে শুরু করেন। যেমন মই, কাপড় ইস্ত্রি করার বোর্ড ইত্যাদি। কাঠের অবশিষ্ট টুকরো দিয়ে তিনি শিশুদের জন্য ট্রাক, গাড়ি - এধরনের খেলনাও তৈরি করতেন। সেসময় এসব বিক্রি করে তিনি সামান্য অর্থও উপার্জন করতেন যা দিয়ে তিনি তার সংসার চালাতেন।"

বিলুন্ড শহরের সবাই যে তার উদ্ভাবিত নতুন এই পণ্যটিকে সাদরে গ্রহণ করেছিল তা নয়। অনেকেই মনে করতেন যেসব জিনিস কাজে লাগে না সেসব বানিয়ে কী লাভ! একারণে কাঠের খেলনা তৈরি করা তার জন্যে বেশ কঠিন ছিল। শহরের কেউ কেউ মনে করতেন কেন তিনি এগুলো তৈরি করছেন, তার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে! এর চাইতে কাজে লাগে এরকম জিনিস কেন তিনি তৈরি করছেন না!

ওলে কির্ক ক্রিস্টিয়ানসেন সব ধরনের কাঠের খেলনা বানাতেন। এসবের মধ্যে ছিল কুকুর থেকে শুরু করে ট্রাক এবং ট্র্যাক্টরসহ নানা ধরনের জিনিস তৈরির ব্রিক। কিয়েল্ড বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রচুর ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। যুদ্ধের পর লোকজন এসব পুনর্নির্মাণের জন্য কাজ শুরু করে। আমার দাদার বেসিক ব্রিক তৈরির যে ধারণা, সেটি আসলে ছিল বাড়িঘর নির্মাণের জন্যই।

দাদা ওলে কির্ক ক্রিস্টিয়ানসেনই এসব ব্রিকের নাম দিয়েছিলেন লেগো। ডেনিশ ভাষায় লেগো কথাটির অর্থ হচ্ছে - প্লে ওয়েল। লাই গট- এই দুটো শব্দ একসঙ্গে জোড়া দিয়ে এই লেগো শব্দটি তৈরি হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর ওলে এবং তার ছেলে গডফ্রেড নতুন নতুন উপাদান দিয়ে লেগো তৈরি পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেন। কাঠের খেলনার পাশাপাশি তারা তৈরি করেন প্লাস্টিকের খেলনাও।

"সেসময় এটিকে অভিনব উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কারণ প্লাস্টিক দিয়ে এমন জিনিস তৈরি করা যেত যা কাঠ দিয়ে বানানো সম্ভব ছিল না। আমার দাদা এবং পিতা - তারা দুজনেই শুধু কাঠ দিয়েই এসব খেলনা বানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্লাস্টিক দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরির যে সম্ভাবনা তাতেও তারা মুগ্ধ হয়েছিলেন," বলেন তিনি।

কিয়েল্ডের শৈশবে প্লাস্টিকের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। তখন তাদের পারিবারিক বাড়ির বেজমেন্টে প্লাস্টিক গলানোর একটি মেশিন স্থাপন করা হয়। নিচের তলায় যখন প্লাস্টিকের খেলনা তৈরি হতো তিনি তখন উপরের তলায় খেলাধুলা করতেন। তিনি বলেন, "আমি তখন সদ্যোজাত শিশু। তাই আমার বেশি কিছু মনে নেই। কিন্তু আমার মা মেশিনটার ব্যাপারে বিরক্ত ছিলেন। কারণ এটি প্রচণ্ড শব্দ করতো। আবার তার কিছু করারও ছিল না। যন্ত্রটিকে একটি কারখানায় সরিয়ে নেওয়ার আগ পর্যন্ত কিছু সময়ের জন্য সেটিকে তার মেনেই নিতে হয়েছিল।"

কিন্তু কাঠের খেলনা নাকি প্লাস্টিকের খেলনা- একটি ট্র্যাজিক ঘটনা এবিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজটা তাদের জন্য সহজ করে দিয়েছিল। কাঠের পুরনো যে কারখানা, যেখানে কাঠের খেলনা তৈরি করা হতো, সেটি আগুনে পুড়ে যায়। "আমার ধারণা ১৯৫৯ থেকে ১৯৬০ সালে শীতকালে ঘটেছিল এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। এই দুর্ঘটনা পরিষ্কার করে দিল যে কাঠের খেলনা তৈরির সময় শেষ হয়ে গেছে।"

এসব লেগো ব্রিকের মধ্যেই বেড়ে উঠেছিলেন কিয়েল্ড। স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে প্রায়শই তিনি খেলনার দোকানে চলে যেতেন। সেখানে ডিজাইনাররা নানা ধরনের মডেল তৈরি করতো। প্রথম দিকে তিনি তাদের কাজের সমালোচনা করতেন। তাদেরকে তিনি অন্যান্য জিনিস বানাতে পরামর্শ দিতেন। স্কুলের পড়াশোনার ব্যাপারে তার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। তাই দিনের তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় তিনি ওই দোকানেই কাটাতেন। এছাড়াও বিজ্ঞাপনের জন্য যেসব ছবি তোলা হতো তাতে তিনি এবং তার বোন মডেলও হয়েছিলেন।

"আমার দাদা ও পিতা- তারা দুজনেই কঠোর পরিশ্রম করতেন। তারা দুজনে খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। আমার দাদা তার জীবনটাকে বেশ হালকাভাবে নিয়েছিলেন। কিন্তু আমার পিতা ছিলেন একজন সিরিয়াস মানুষ। তিনি তার কাজের ব্যাপারে বেশ মনোযোগী এবং একনিষ্ঠ ছিলেন। কোম্পানিকে সফল করার জন্য তিনি বেশ সচেষ্ট ছিলেন।

১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে প্রথমবারের মতো তৈরি হলো প্লাস্টিকের লেগো ব্রিক। কিয়েল্ড বলেন, "১৯৫৮ সালে আমার বয়স ছিল ১০ বছর। ওই বছরেই আমার পিতা গডফ্রেড টিউব দিয়ে লেগো ব্রিক তৈরি করেন। তাকে নিয়ে আমাদের বেশ গর্ব ছিল কারণ তিনি এমন একটি খেলনা তৈরি করেছেন।"

ব্রিকের ভেতরে একটি টিউব যুক্ত করার কারণে এটি দিয়ে অসংখ্য জিনিস তৈরি করা যেত। দুটো ব্রিক লাগানো যেত পাশাপাশি, আড়াআড়ি, খাড়া করেও। একসময় তারা এসব ব্রিক জার্মানি, সুইজারল্যান্ড এবং আরো পরে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করতে শুরু করেন। ১৯৬২ সালে নতুন ধরনের এক লেগো উদ্ভাবন করা হলো যার নাম লেগো হুইল। ১৯৬৮ সালের মধ্যে লেগো আন্তর্জাতিক এক ব্র্যান্ডে পরিণত হলো। এবং কিয়েল্ডের পিতা গডফ্রেড বিলুন্ড শহরে একটি লেগো থিম পার্ক বানানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।

কিয়েল্ড বলেন, "বিলুন্ড শহরে খুব বেশি মানুষ ছিল না। তাই অনেকেই মনে করলো যে এই পার্ক সফল হবে না। আমার পিতা ভেবেছিলেন বছরে হয়তো আড়াই লাখের মতো মানুষ আসতে পারে এবং এটাই হয়তো যথেষ্ট। কিন্তু দেখা গেল লেগোল্যান্ড পার্কে বছরে ১৮ থেকে ১৯ লাখ দর্শক আসছে।"

বেসিক ব্রিক উদ্ভাবনের পর প্লাস্টিকের ছোট ছোট মানুষও তৈরি করা হলো। যেমন পুলিশ, জলদস্যু, সৈন্য, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার। তৈরি হলো দুর্গ এবং দমকল বাহিনীর আগুন নেভানোর গাড়িও। পরে এই কোম্পানিকে কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। ২০০৩ সালে বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়ে লেগো এবং সারা বিশ্বে তাদের যেসব থিম পার্ক ছিল সেগুলো বিক্রি করে দেওয়া হয়। ২০১৭ সালে রাজস্ব কমে গেলে ছাঁটাই করা হয় হাজার-খানেক লোকের চাকরি।

শিশুরা কম্পিউটারে খেলায় আগ্রহী হয়ে ওঠার কারণেই কি লেগোর এই পরিণতি? ডিজিটাল যুগেও লেগো কি বেঁচে থাকতে পারবে? কিয়েল্ড বলেন, "শারীরিক খেলা সবসময়ই থাকবে। আমি মনে করি এধরনের খেলা শিশুদের কল্পনা শক্তিকে উদ্দীপ্ত করে। এর মাধ্যমে শিশুরা শিখতে পারে, নতুন নতুন জিনিস বানানোর চেষ্টা করে। যদি সফল হয় তাহলে ঠিক আছে, আর যদি না পারে, তারা আবার চেষ্টা করে। এটাই শিশুদের সহজাত প্রবৃত্তি। সারা জীবন ধরেই এমনটা চলতে থাকে। আমরা তো সবসময়ই বড় হচ্ছি। কিন্তু আমাদের ভেতরে সর্বদাই একটি শিশু বাস করে যারা মজা করতে ভালবাসে।"

ক্রিস্টিয়ানসেনের পরিবার এখনও এই লেগো ব্যবসার মালিক। তবে ব্যবসা পরিচালনার জন্য বাইরে থেকে আরো অনেককেই নিয়ে আসা হয়েছে। বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রতি বছর সাড়ে সাত হাজার কোটি লেগো ব্রিক বিক্রি হয়। অর্থাৎ বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জন্য ১০টি করে লেগো। কিয়েল্ড কির্ক ক্রিস্টিয়ানসেন এখনও ডেনমার্কের বিলুন্ড শহরে বসবাস করছেন এবং এখনও তিনি লেগো ব্রিক দিয়ে বিভিন্ন জিনিস বানাতে পছন্দ করেন। সূত্র: বিবিসি।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন