সংস্কৃতি একটি দেশের ঐতিহ্য ও আত্মপরিচয়ের সাক্ষ্য বহন করে। পহেলা বৈশাখে বাংলা নববর্ষ উদযাপন বাঙ্গালী সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়ের অন্যতম স্মারক বহন করছে। একশ্রেণীর বর্ণবাদী বাঙ্গালী মুসলমানদের আলাদা করে চিহ্নিত করার প্রয়াস খুঁজলেও বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতার কোনো সুযোগ নেই। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পহেলা বৈশাখ উদযাপনের যেসব আয়োজন দেখা গেছে, তাতে এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ক্ষেত্রে হাজার বছরের ঐতিহ্য ও অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্ট্য বিনষ্টের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। খৃষ্টীয় ষোড়শ শতকে মুঘল বাদশা আকবর ফসলি সনের খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে হিজরী সনের অনুকরণে বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রবর্তণের নির্দেশ দেন। স¤্রাটের নির্দেশনায় সুফি সাধক ও জ্যোর্তিবিদ ফতেহ উল্ল্যাহ সিরাজী আকবরের সিংহাসন লাভের দিনটিকে স্মরণীয় রাখতে সেদিন থেকে বাংলা বর্ষপঞ্জি গণণা শুরু করেন। হিন্দু-মুসলমান জনসংখ্যার মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান থাকায় বাংলা বর্ষবরণের ঐতিহ্যে কখনো একতরফা ধর্মীয় আবেগ বা আনুষ্ঠানিকতা স্থান পায়নি। মূলত কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি ও খাজনা আদায়ের নিমিত্তে এই বর্ষপঞ্জী সংস্কার হওয়ায় একই ধারার কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির অংশীদার হওয়ায় মুঘল বাদশার প্রবর্তিত বাংলা সনকে হিন্দু-মুসলমানরা যার যার মত করে পালনে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে। জাতিসত্তা বিকাশের ধারায় হাজার বছরের রাজনৈতিক পরিক্রমায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন এ উপমহাদেশে বাঙ্গালী মুসলমানের আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে একটি বৈশ্বিক মর্যাদা এনে দিয়েছে। মুসলমানিত্ব এবং বাঙ্গালিত্ব বিসর্জন না দিয়ে যে স্বাধীন জাতিসত্তা তাই আধুনিক বাংলাদেশ। গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন এবং সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের লালন বিশেষ অবস্থান লাভ করাই এখানে সঙ্গত হতে পারত। তবে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ উৎযাপন এবং বাঙ্গালী সংস্কৃতির নামে যে সব আয়োজন চলছে তাতে বাঙ্গালী মুসলমানদের অপাঙতেয় করে তোলা হয়েছে। ষাট-সত্তুরের দশকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রভারতী প্রভাবিত ছায়ানটসহ কিছুৃ ব্যক্তি ও সংগঠন রমনার বটমূলে নৃত্যগীতের মাধ্যমে নববর্ষ আবাহণের একটি রেওয়াজ তৈরী করতে সচেষ্ট হয়। এরপর আশির দশকে শুরু হওয়া পহেলা বৈশাখের আনন্দ শোভাযাত্রা নব্বই দশকে এসে এক সময় তা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মঙ্গল শোভাযাত্রায় পরিনত হয়ে যায়। অখন্ড ভারতের স্বপ্ন নিয়ে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি দিল্লীর ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাংলাদেশের তথাকথিত সেক্যুলার ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার দাবিদার একটি গোষ্ঠি বাংলা বর্ষবরণের মত হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির উৎসবকে একটি হিন্দুয়ানি চরিত্র দেয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত হতে দেখা গেছে। অতি সাধারণ বাঙ্গালী সংস্কৃতির ধারক চিহ্ন ও বস্তুরাজি নিয়ে যে বৈশাখী মেলা ও আনন্দ শোভাযাত্রা শুরু হয়েছিল, দুই দশকের মধ্যে সেই উৎসবে শুধুই হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি ও দেবদেবী মূর্তির মিছিলে পরিনত হয়েছে।
বৈশ্বিক করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছর পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রা কার্যত বন্ধ ছিল। করোনা মহামারী এখন স্তিমিত হয়ে আসলেও করোনার কারণে দেশের মধ্যবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত শ্রেণীর অর্থনৈতিক অবস্থান অনেকটাই ধসে পড়েছে। লাখ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছে, আয়-রোজগারের পথ রুদ্ধ হয়েছে। প্রবাসি কর্মীদের রেমিটেন্স এবং গার্মেন্ট রফতানির উপর ভর করে করোনাকালীন বাস্তবতা থেকে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাড়াতে শুরু করলেও করোনার কারণে কর্মচ্যুত লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান এখনো হয়নি। দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চললেও রফতানিমুখী গার্মেন্ট সেক্টরসহ বিভিন্ন সেক্টরের গুরুত্বপূর্ণ পদে লাখ লাখ বিদেশি নাগরিক কাজ করে বছরে শত শত কোটি ডলার বিদেশে পাঠাচ্ছে। বলা বাহুল্য, দেশের বিভিন্ন সেক্টরে বৈধ-অবৈধভাবে কর্মরত বিদেশি নাগরিকের বেশীরভাগ ভারতীয়। করোনা সময়ের লকডাউনে দেশের অন্যসব সেক্টর বন্ধ থাকলেও রফতানিমুখী গার্মেন্ট ফ্যাক্টরীগুলো চালু থাকায় এ সেক্টরের বিদেশী কর্মীদের চাকরি হারাতে হয়নি। বাংলাদেশের প্রধান রফতানি খাতে লক্ষাধিক ভারতীয় নাগরিক কাজ করে বছরে কয়েকশ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স আয়ের সুযোগ থাকায় বাংলাদেশের এই খাতের অর্থনৈতিক স্বার্থের সাথে ভারতীয় স্বার্থও জড়িত। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনৈতিক খাতেও ভারতীয়দের কর্মসংস্থান ভারতকে বিশ্বের অন্যতম প্রবাসী কর্মী নির্ভর রেমিটেন্স অর্থনীতির দেশে পরিনত করেছে। এসব কারণে মধ্যপ্রাচ্য ও বাংলাদেশের মত দেশগুলোর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ঘটনাক্রমের সাথে ভারতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব লক্ষ্যনীয়। ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি এবং মুসলিম বিদ্বেষী নানা তৎপরতার প্রভাব তাদের বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং রেমিটেন্স প্রবাহের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে দেখা যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মুসলিম বিদ্বেষী স্টাটাস দেয়ার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে ভারতীয়দের চাকরি হারানোর ঘটনাও বেড়ে চলেছে। বলিউড ও দক্ষিণ ভারতের চলচ্চিত্র মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে মোটা অংকের ব্যবসা করে আসছে। সম্প্রতি একাধিক ভারতীয় চলচ্চিত্রে মুসলিম বিদ্বেষী উপাদান থাকায় কুয়েত ও কাতারে প্রদর্শন নিষিদ্ধ করার খবর বেরিয়েছে। এভাবেই সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ দেশে দেশে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে চলেছে। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তি বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম করার আগে সাংস্কৃতিক প্রভাব বলয় ও আধিপত্য সৃষ্টির ভ’-রাজনৈতিক প্রয়াস জারি রেখেছে। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মত বিকল্প মাধ্যমগুলো একটি পাল্টা রক্ষণবাদী জনমত গঠণের মধ্য দিয়ে আধিপত্যবাদী শক্তির তৎপরতা তাদের জন্য অনেকটা বুমেরাং হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শত শত বিলিয়ন ডলারের সামরিক বাজেট এবং মূলধারার সব গণমাধ্যমের একচেটিয়া একতরফা প্রপাগান্ডা চালিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র বদল এবং ইসলামোফোবিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
জায়নবাদ প্রভাবিত পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদ ইসলামকে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে দাড় করানোর চেষ্টা করলেও জনসাধারণের বোধবুদ্ধির বিচারে তা ধোপে টেকেনা। এ কারণে ট্রিলিয়ন ডলার খরচে তাদের ওয়ার থিয়েটারগুলো লাখ লাখ মুসলমানের জীবন ও কোটি কোটি মানুষের সম্পদ কেড়ে নিলেও কোথাও তারা সফল হতে পারছে না। একটি স্বচ্ছ আদর্শিক লড়াই-সংগ্রামকে বুলেট-বোমায় স্তব্ধ করা যায়না। বিশ্বের সর্বোচ্চ শক্তি ব্যবহার করেও ফিলিস্তিনের মুক্তির সংগ্রাম দুর্বল করা যায়নি। বø্যাক-আউটের অন্ধকারে নিক্ষেপ করেে চরম নিপীড়নের পন্থা বেছে নিয়েও কাশ্মিরকে আত্মীকরণ করতে পারছে না ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা। তবে আমেরিকার আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার মত ভারত হয়তো কাশ্মির ছেড়ে যাবেনা। একটি বিশাল ধর্মান্ধ জনগোষ্ঠিকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ তারা কখনোই হাতছাড়া করতে চাইবেনা। চলমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় ভারত ক্রমশ গুরুত্বহীন শক্তিতে পরিনত হতে শুরু করেছে। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের পর পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদীরা ইসলাম ও মুসলমানদেরকে তাদের প্রধান রাজনৈতিক-আদর্শিক প্রতিপক্ষ হিসেবে দাড় করিয়ে একটি অন্তহীন যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিল। একটি ফল্স ফ্লাগ অপারেশনে নিউ ইয়র্কের বিশ্ববানিজ্যকেন্দ্র ও পেন্টাগনে সন্ত্রাসী বিমান হামলার পর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণার পর পুরো বিশ্ব একটি মার্কিন ইউনিপোলার প্রভাব বলয়ে নিয়ে আসার পরিকল্পনা অনেকটাই সাফল্য লাভ করেছিল। আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ চীনকে মোকাবেলা করতে ভারতের শাসকরা সাবেক সোভিয়েত প্রভাব বলয় থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে একটি কৌশলগত ভূরাজনৈতিক চুক্তিতে উপনীত হয়। কিন্তু আফগানিস্তান ও সিরিয়ায় মার্কিন ও ন্যাটো জোটের পরাজয়, ইউক্রেন যুদ্ধের বাস্তবতায় ভারত এখন কার্যত বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে। দুই বছর আগে চীনের সাথে সীমান্ত বিরোধের সময় নিপাল-ভ’টানের মত তার ক্ষুদ্র প্রতিবেশীদের সমর্থন লাভে ব্যর্থ হয়েছিল ভারত। কিন্তু ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসক দলের নেতারা এখনো বৃহত্তর অখন্ড ভারত গঠনের স্বপ্নে বিভোর আছে। ভারত ও বাংলাদেশের শাসকদলের নেতা-আমলারা দুই দেশের বন্ধুত্বের অনন্য উচ্চতার কথা বলে থাকেন। সেই সাথে ভারতের বিজেপি নেতারা কিছুদিন পর পর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে হুমকি ও উস্কানিমূলক বক্তব্যও জারি রেখেছেন। বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন তৈরী করে কোটি কোটি বাংলাভাষি মুসলমানকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি দিচ্ছে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর বার্মিজ বাহিনীর গণহত্যায় সারাবিশ্ব নিন্দা-ধিক্কার জানালেও ভারতের সমর্থন এখনো রোহিঙ্গা এথনিক ক্লিনজিংয়ের পক্ষেই দেখা যাচ্ছে। ভারতের শাসকদল বিজেপির মূল সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ(আরএসএস) নেতা মোহন ভাগবত সম্প্রতি হরিদ্বারে দেয়া এক বক্তব্যে আগামী ১৫ বছরের মধ্যে অখÐ ভারত তৈরীর ঘোষণা দিয়েছেন। ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের এ লক্ষ্য অর্জনে যে শক্তি বাধা দিতে আসবে সেই শেষ হয়ে যাবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মোহন ভাগবত। বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের অন্যসব দেশের উপর আধিপত্য কায়েম এবং চুড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে পৌরাণিক মহাভারতের আদলে অখÐ ভারত প্রতিষ্ঠার সংকল্প হিন্দুত্ববাদীদের নতুন কোনো এজেন্ডা নয়। তারও অনেক আগে থেকে জায়নিষ্টরা সিরিয়া ফিলিস্তিন, লেবানন, জদার্নসহ পুরো লেবান্ট অঞ্চল দখল করে বিবলিক্যাল গ্রেটার ইসরাইল গঠনের স্বপ্ন দেখছে। পরিবর্তিত বিশ্ববাস্তবতায় ভারতের সাথে ইসরাইলে নিবিড় বাণিজ্য ও কৌশলগত বিনিময়ের সম্পর্ক এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তারা হয়তো একে অপরের পরিপুরক শক্তি হিসেবে দেখছে।
পোস্ট কলোনিয়াল যুগে একটি নয়া উপনিবেশবাদ সৃষ্টির মূল হাতিয়ার হচ্ছে সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের ধারণা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মত সাবেক বৃটিশ কলোনির শাসকশ্রেণী এখন আন্তজার্তিক ও আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী নয়া উপনিবেশ তৈরীর চেষ্টা করছে। সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ শিরোনামে জার্মান দার্শনিক এরভিন চ্যারগাফের একটি লেখা কয়েক বছর আগে প্রকাশিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারি এরভিন চ্যারগাফ ইংরেজীতে লেখা সিরিয়াস ম্যাটার নামের একটি প্রবন্ধ সংকলনে ফরাসি সংস্কৃতি মন্ত্রীর বক্তৃতায় ‘মার্কিন সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের’ অভিযোগের প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন। এ প্রসঙ্গে চ্যারগাফ গ্রেশামস ল’র ব্যাখ্যা দিয়ে কালো টাকা বাজারে ছড়িয়ে দিয়ে সাদা টাকাকে অচল করে দেয়ার ত্বত্ত¡ হাজির করেছেন। সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারের উদাহরণ দিতে গিয়ে এরভিন বলেছেন, বাজার দখলের জন্য হলিউডের চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়কদের দিয়ে মঞ্চে মুত্রপান করানোর অভিনয় করালেই হয়তো সাধারণ মানুষ মুত্রপান করা শুরু করবে না। এটা যদি সম্ভব হতো এতদিনে একটি আমেরিকান মূত্র কোম্পানীর আত্মপ্রকাশ ঘটত বলে তিনি মনে করেন। তবে এর বিপরীত একটি চলমান চিত্র হচ্ছে, শতকোটি মানুষের দেশ ভারতের শাসকরা ইতিমধ্যে ভারতের গোমুত্রকে একটি ব্র্যান্ডিং দেয়ার চেষ্টায় অনেকটা সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছেন। হিন্দুত্ববাদী প্রচারনায় গোমুত্র এখন গরুর দুধের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। ভারতের মুসলমানরা হাজার বছর ধরে গরুর গোশত খাচ্ছে। গরুর গোশত রফতানি করে ভারত শত শত কোটি টাকা আয় করলেও এখন ভারতে গরুর গোশত খাওয়ার কারণে মুসলমানদের হত্যাকান্ডের শিকার হতে হয়। অন্যদিকে জয়শ্রীরাম শ্লোগানের মত গোমুত্র বিধানকে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের সিস্টেমেটিক ধারণা তুলে ধরার জন্য বিংশ শতকের রাষ্ট্রচিন্তক ও দার্শনিকদের মধ্যে ইতালীর ফ্যাসিবাদ বিরোধী লেখক-দার্শনিক এন্তোনিও গ্রামসির নাম সমুজ্জ্বোল হয়ে আছে। বহুমুখী প্রতিভা ও বহুধা পরিচয়ে ঋদ্ধ গ্রামসি মাত্র ৪৬ বছর বয়েসে ১৯৩৭ সালে মুসোলিনীর কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার অপরাধে জীবনের শেষ ১১ বছর জেলে কাটিয়ে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। কিন্তু তার জেলখানার ১১ বছর বিফলে যায়নি। জেলখানায় বসে তিনি প্রায় ৩০টি নোটবই লিখেছিলেন। প্রখর মেধাবী মার্ক্সবাদী রাষ্ট্রচিন্তক গ্রামসির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ভাষাত্বাত্তি¡ক চিন্তাধারা এসব নোটবুকে উঠে এসেছে যা পরবর্তিতে সারাবিশ্বে মূল্যবান সম্পদ ও নতুন ধ্যান-ধারণা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। রাষ্ট্র ও সমাজদর্শেনের ক্ষেত্রে এন্তোনিও গ্রামসির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অনুধাবন হচ্ছে, কালচারাল হেজিমনি তত্ত¡ বা সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের ধারণাকে মানুষের সামনে নিয়ে আসার কারণে তৃতীয় বিশ্বের মানুষ নয়া ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলেও ইসলামোফোবিক এজেন্ডা সফল হয়নি। এই মুহূর্তে সম্ভবত ভারতের হিন্দুত্ববাদই হচ্ছে, বিশ্ব শান্তির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। এই হুমকি ইতিমধ্যে গণহত্যা পরিকল্পনার মত বড় আশঙ্কা হয়ে দেখা দিয়েছে। ভারতের নিকটতম প্রতিবেশি এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগেষ্ঠি হিসেবে এ ধরণের আশঙ্কা ভারতের প্রতি আমাদের সন্দিগ্ধ ও আতঙ্কিত করে তোলে। দেশের একজন অতি সাধারণ মানুষও মনে করেন, বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকার চারুকলা ও রমনার অনুষ্ঠানমালায় প্রচ্ছন্নভাবে মুসলিম জাতিসত্তা বিরোধি হিন্দুয়ানি সংস্কৃতির আধিপত্য কায়েম হয়েছে। এভাবেই একটি অসাম্প্রদায়িক ও ঐক্যবদ্ধ সমাজকে বিভক্ত ও পরস্পরের বৈরী করে তোলার নীলনকশা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে কিনা তা বিবেচনা করে দেখতে হবে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় অনুভ’তি ও ভাবাবেগকে মূল্য দিয়ে এবারের পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধ রাখাই সঙ্গত ছিল। তা না করে দেশের অধিকাংশ টেলিভিশন চ্যানেল ও গণমাধ্যম হিন্দুয়ানি মোঙ্গল শোভাযাত্রাকে সফল করতে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছে। তবে তাদের প্রচারণা তেমন কাজে আসেনি। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ রমজান মাসে হিন্দুয়ানি মঙ্গল শোভাযাত্রার অনুষ্ঠানকে কার্যত বর্জন করেছে। গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা সত্বেও এবার মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিল অনেকটাই নিস্প্রভ। এবার রমনার মঙ্গল শোভাযাত্রায় নগরবাসির অংশগ্রহণ ছিল খুবই সীমিত। শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারী সাধারণ মানুষের তুলনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের সংখ্যাই নাকি বেশি ছিল এবার।
কলকাতার পত্রিকায় পহেলা বৈশাখে ঢাকার মঙ্গল শোভাযাত্রাকে দুর্গাপূজায় অষ্টমীর একডালিয়ার পূজামন্ডপের সাথে তুলনা করা হয়েছে। শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে বর্ষবরণের একটি অসাম্প্রদায়িক উৎসবকে এভাবে একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবে পরিনত করার নেপথ্যের যে শক্তিই থাকুক এ দেশের সাধারণ মানুষও তাদের দূরভিসন্ধি বুঝতে সক্ষম। পহেলা বৈশাখ বাঙ্গালী হিন্দু-মুসলমানের অসাম্প্রদায়িক ও অরাজনৈতিক উৎসব হলেও এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে শুধু সাম্প্রদায়িকভাবেই পক্ষপাকদুষ্ট করা হয়নি। সেই সাথে রাজনৈতিকভাবেই পক্ষপাতদুষ্ট করার আলামত দেখা গেছে। মঙ্গল শোভাযাত্রায় বিএনপি চেয়ার পারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিকৃত প্রতিকৃতি বহনের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। চলমান বৈশ্বিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতায় যখন আমাদের ইস্পাত কঠিন জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা প্রয়োজন, তখন বর্ষবরণের মত সাম্প্রদায়িক ঐক্য ও সম্প্রীতির প্লাটফর্মকে বিভাজিত ও কলুষিত করা হচ্ছে কোন স্বার্থে। পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রায় সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক বিদ্বেষ-বিভাজনের অমঙ্গলজনক উদ্যোগ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ প্রত্যাখ্যান করবে।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন