পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের একটি বক্তব্য সোস্যাল মিডিয়ায় ঝড় বইছে। তিনি বলেছেন, ‘র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার ব্যাপারে ভারতের সাহায্য চাওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত অনাবাসী ভারতীয়দের (নন-রেসিডেন্ট ইন্ডিয়ান, এনআরআই) সহায়তা চাওয়া হয়েছে তারা মার্কিন সরকারকে এ বিষয়ে অনুরোধ জানিয়েছেন’। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্য সোসাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। এ নিয়ে নানা জনে নানান মন্তব্য করছেন। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন এই বলে যে, ‘সরকার কি ভারতের পুতুল সরকার? বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কি ভারত চালায়? ’ কেউ লিখেছেন ‘এটা কি বাফার স্টেট?’ কেউ লিখেছেন ‘২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগের হয়ে জাতীয় পার্টির নেতা এইচ এম এরশাদকে পাতানো নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য করেছিলেন।’ কেউ লিখেছেন ‘বাংলাদেশ কি ভারতের চোখে বিশ্ব দেখে থাকে? তাহলে শত শত কোটি টাকা খবর করে বিভিন্ন দেশে দূতাবাস রেখে লাভ কি’। কেউ লিখেছেন ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক সময় বলেছিলেন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রক্তের সম্পর্ক; স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। স্ত্রী বিপদে পড়লে স্বামী পাশে দাঁড়াবে এতে দোষের কি আছে’। আবার কেউ লিখেছেন ‘যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ভারতীয় হিন্দুদের ওপর আওয়ামী লীগের নির্ভরতা বেশি, সেখানকার বাংলাদেশী প্রবাসী মুসলমানদের ওপর নয় কেন?’ বিষয়টি নিয়ে সোস্যাল মিডিয়ায় তোলপাড় চলছে; অনেকে অপ্রীতিকর মন্তব্য করেছেন।
র্যাবের ওপর থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে একজন লিখেছেন, র্যারের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে যে যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগ করা হলো সে টাকা কি পানিতে গেল? কেউ লিখেছেন ১০ ডিসেম্বর নিষেধাজ্ঞা জারীর পর মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতাদের যে ড্যাম কেয়ার ভাব এখন গেল কোথায়? পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী যে ভাব দেখিয়েছেন যেন বাশের চেয়ে কঞ্চি বড়। কেউ লিখেছেন সংসদে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘বাইডেন প্রশাসনের কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছাতে পারলে যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয়ই র্যাবের ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে।’ প্রশ্ন হচ্ছে সঠিক তথ্য তুলে ধরা গেল না কেন? একজন লিখেছেন ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দাবি করেছিলেন ‘র্যাব আস্থার প্রতীক’; পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম দাবি করেছিলেন, র্যাব হচ্ছে ‘ন্যায়বিচারের প্রতীক’। প্রশ্ন হচ্ছে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা র্যাবের উপর কি সরকার বিচার বিভাগের দায়িত্ব দিয়েছে?
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে সোস্যাল মিডিয়া যখন তোলপাড় তখন দেশের আওয়ামী লীগ সমর্থিত বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকরা নীরব! তথাকথিত প্রগতিশীল সংস্কৃতিসেবীরা তো গর্তে মুখ লুকিয়েছেন। অবশ্য এদের কেউ কেউ এই ভেবে অহংবোধ করছেন যে ‘আওয়ামী লীগ সরকার চীনের সহায়তায় দেশে উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ চালালেও শেষ পর্যন্ত দিল্লির স্মরণাপন্ন হয়েছে।’ টিভির টকশোয় কেউ কেউ বাংলাদেশের চেয়ে এখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গুলিতে বেশি মানুষ মারা যায় এমন মন্তব্য ছুঁড়ে দিচ্ছেন।
তবে ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম ও যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ একটি জাতীয় দৈনিকে এ নিয়ে চমৎকার দুটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছেন। সাকিব আলী নামের একজন সাবেক কূটনীতিক ওয়েবিনারে বলেছেন, নিষেধাজ্ঞাজারীর পর মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা যে ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা জারীর বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে গণমাধ্যম গরম করেছেন; এখন তারা নীরব হয়ে গেছেন। কারণ তাদের স্ত্রীরা ওই সব মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তাদের নীরব থাকতে বাধ্য করছেন। কারণ তারাও নিজেরা এবং ছেলেমেয়েদের যুক্তরাষ্ট্রে নিতে চান।
২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর র্যাবের সাবেক ও বর্তমান ৭ কর্মকর্তার উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা জারী করে। এরপর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা দেয়া মার্কিনীদের ফ্যাশন’। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জাতীয় সংসদে প্রথমে বিএনপির লবিস্ট নিয়োগ করে এটা করেছে অভিযোগ করলেও পরে তিনি জানান, সরকার র্যাবের ওপর থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞ তুলে নেয়ার দুতিয়ালির জন্য পিআর ফার্ম নিয়োগ করেছে।’ অতপর তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলারকে ডেকে নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড ঢাকা সফরে এলে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার চেয়ে আলোচনা, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি বিøনঙ্কেনের কাছে চিঠি দেয়া ইত্যাদি পর পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেছিলেন, ‘ভিত্তিহীন এবং বানানো তথ্যের ভিত্তিতে এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে’। পরবর্তীতে সংসদে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘সঠিক তথ্য পৌঁছাতে পারলে যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয়ই র্যাবের ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবে। তবে তার জন্য কিছু সময় লাগবে।’ প্রফেসর আলী রিয়াজ প্রশ্ন তুলেছেন ‘তাহলে কি সেই সময় শেষ হয়ে যাওয়ার ভারতের সহয়াতা চাওয়া হচ্ছে?’
র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে ভারতের সহায়তা চাওয়ার প্রসঙ্গে ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম লিখেছেন, ‘আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনন্দের সাথে বলেছেন যে তিনি ভারতীয়-আমেরিকান স¤প্রদায়ের সদস্যদের সাথে দেখা করেছেন (ভারতীয় বংশোদ্ভ‚ত মার্কিন নাগরিক) যারা র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য লবিং করতে সম্মত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ভারতের ৪৫ লাখ হিন্দু একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী গোষ্ঠী এবং তারা প্রতিশ্রæতি দিয়েছে মার্কিন প্রশাসনের সাথে সমস্যার সমাধান করবেন। কেন তাকে (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) এখানে ধর্মীয় পরিচয় আনতে হয়েছিল? আমি জানি যে ভারতীয়-আমেরিকানদের মধ্যে শিখদের সংখ্যা খুব বেশি। তিনি কোনও মুসলমানকে ভারতের প্রবাসী হতে বাধা দেন? তাই তিনি রাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্র সম্পর্কের বাইরে গিয়ে ভারতীয় প্রবাসীদের সাথে লবিং করেছেন। এটাকে আমরা তার পরিশ্রমের বাইরে বিবেচনা করি এবং তার মানসিকতার প্রমাণ করে যে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আচরণ করার ক্ষেত্রে এতটাই দুর্বল যে আমরা নিজেরাই কিছু করতে পারি না এবং অন্যের (ভারত) সাহায্যের প্রয়োজন হয়।
‘বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করবে ভারত?’ শিরোনামে এক উপসম্পাদকীয়তে প্রফেসর আলি রিয়াজ লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ কেন ভারতের মুখাপেক্ষী হয়েছে, সেটা দুর্বোধ্য নয়। প্রথমত, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক সখ্য ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের ভ‚মিকা। ক্ষমতাসীনদের ভারতনির্ভরতা সুবিদিত। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। দীর্ঘদিন ধরেই ওয়াশিংটন দিল্লির চোখে এ অঞ্চলের ছোট দেশগুলোকে দেখে এসেছে। ফলে বাংলাদেশ সরকার আশা করছে, নয়াদিল্লির তদবিরে কাজ হবে। কিন্তু ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক এখন সেই মাত্রায় আছে কি না, সে বিবেচনা গুরুত্বপূর্ণ। র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা যদি বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী হয়, তবে বাংলাদেশের স্বার্থে ভারত কেন প্রতিনিধিত্ব করবে? ভারত বা তৃতীয় পক্ষ কেবল তখনই সুপারিশ করবে, যখন তার স্বার্থ জড়িত থাকবে। এখন বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব যদি ‘আউটসোর্সিংয়ের’ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তবে বাংলাদেশের নাগরিকদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আছে। বাংলাদেশের সরকার এবং ক্ষমতাসীন দল দেশের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রায়ই উদ্বেগ-আশঙ্কা প্রকাশ করে। ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তিক্ষুন্ন’ করলে শাস্তি পাওয়ার আইন রয়েছে। এ সিদ্ধান্তে কি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকেক্ষুন্ন করবে না?’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন