শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

ঈদুল ফিতরে যা করতে হবে

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১ মে, ২০২২, ১২:০৩ এএম

রমজানুল মোবারকের অব্যহিত পরেই আসে ঈদুল ফিতর। এদিন দিবসে পানাহার বৈধ হয়ে যায় এবং উপবাস থাকা অবৈধ। ফিতর বা ইফতার রোজা ভঙ্গ করাকে বলা হয়। মাসব্যাপী রোজা রাখার পর পানাহার প্রভৃতির অনুমতি এদিন থেকে আরম্ভ হয়। ঈদের দিনে উপবাসে থাকা শরিয়ত মতে হারাম। আল-ক্বোরআনের মধ্যে মাত্র একটি স্থানে অর্থাৎ সুরা মায়েদার মধ্যে ঈদ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। সূরা মায়েদার ১১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: ‘ঈসা বিন মরিয়ম প্রার্থনা করে বলেন, হে প্রভু, আমাদের উপর আকাশ থেকে দস্তারখান অবতীর্ণ কর যাতে আমাদের প্রথম ও পরবর্তীদের জন্য ঈদ খুশির দিন হয় এবং আপনার পক্ষ থেকে তা নিদর্শন হবে। আমাদের অন্ন দান কর, নিশ্চয়ই আপনি শ্রেষ্ঠ অন্নদাতা।

হযরত ঈসা বনি ইসরাইলীদের বললেন, তোমরা রোজা রাখ, তারপর আল্লাহর কাছে যা চাবে তাই পাবে। যখন তারা রোজা রাখল, তখন তারা বলল, হে আল্লাহর নবী, কোনও মানুষের কাজ করলে সে নিশ্চয় আমাদের আহার করাতো। আমরা রোজা রেখেছি, ক্ষুধা-তৃষ্ণা সহ্য করেছি, আপনি আপনার প্রভুর কাছ থেকে উত্তম আহার (দস্তরখান) এর প্রার্থনা করুন। ঈসা সে মতো আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে তা লাভ করলেন। তারা অত্যন্ত আনন্দ সহকারে তা আহার করতে লাগলো, যা আর শেষ হয়নি। এমনকি চল্লিশ দিন পর্যন্ত তারা তা ভোজন করলো। পরে তারা কুপ্রবৃত্তি শুরু করে দিল। এজন্য আল্লাহ ধনীদের জন্য এ আহার বন্ধ করে দিলেন এবং শুধু গরিবদের জন্য তা নির্দিষ্ট করে দিলেন। ধনী সম্প্রদায় অসন্তুষ্ট হয়ে হযরত ঈসার কাছে এসে এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘আমি তোমাদের বলেছিলাম, দস্তারখানা চাশতের সময় আকাশ থেকে আসবে এবং আহার সমাপ্ত হলে তা উঠানো হবে। তবে শর্ত থাকবে তোমরা এর খেয়ানত করবে না। তোমরা এ শর্তে টিকে থাকতে পারনি। বরং তাতে তোমরা নিজেদের অংশ ছাড়া আরো বেশি নিতে চাও। এজন্য আল্লাহ তোমাদের ওপর নারাজ হয়ে আজাব নাযিল করেছেন।’ এ ঘটনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ এবং তাঁর আদেশ-নিষেধ মান্য করা বান্দাহর জন্য অপরিহার্য।

ঈদ আল্লাহর অবাধ্যতা এবং নাফরমানি থেকে বাঁচার এক নাম। যদি কেউ সমাজের দরিদ্রদের অবহেলা এবং উপেক্ষা করে থাকে তবে তার ওপর আল্লাহর শাস্তি অবধারিত। সে আল্লাহর আজাব থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না। যদিও উম্মতে মোহাম্মদিকে প্রকাশ্য এবং সম্মিলিত আজাব থেকে রেহাই দেয়া হয়েছে তবে প্রকৃত আজাব থেকে রক্ষা পাওয়া সহজ নয়। হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘এদিন তোমাদের জন্য ঈদ যেদিন তোমরা পাপ কাজ করো না।’ এদিন ফিতরা এজন্য আবশ্যক করা হয়েছে, যাতে দরিদ্রদের উপেক্ষা না করা হয়। একটি হাদিসে রয়েছে, ‘ঈদের দিনে আল্লাহ পৃথিবীতে অসংখ্য ফেরেশতা প্রেরণ করেন যারা হাটে-বাজারে, মাঠে-ময়দানে সর্বত্র দাঁড়িয়ে বলতে থাকেন, খোদা তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।’ ঈদের নামাযের শেষ সময়ে আল্লাহ ফেরেশতাদের গর্ব করে বলেন, যে শ্রমিক পরিপূর্ণভাবে কাজ করে তার পারিশ্রমিক দেওয়া উচিত। আল্লাহ বলেন, আমি তার ওপর সন্তুষ্ট হয়ে তাকে ক্ষমা করে দিলাম। তারপর রোজাদারের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমার ইজ্জত, আমার মর্যাদা ও করমের শপথ আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিলাম এবং যা প্রার্থনা করবে তা গ্রহণ করা হবে। ফিরে যাও সন্তুষ্টচিত্তে।’

রমজানুল মোবারকের পুরো মাস রোজাদার আল্লাহর মেহমান হয়ে যায়। মেহমানের বিদায়কালে সন্তুষ্ট হয়ে বিদায় শুভেচ্ছা জানানো স্বাভাবিক। তখন বিদায় গ্রহণকারীরও উচিত তা পরবর্তী সময়ে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করা। রোজাদারের তেমন হওয়া উচিৎ। রমজানের মতো বাকি মাসগুলোতে সেভাবে আল্লাহর ভয়কে অন্তরে রেখে সে-মতো কার্য পরিচালনা করা। ঈদের দিনে হুকুকুল্লাহ (আল্লাহর হক) এবং হুকুকুন্নাস (মানবের হক) এর প্রতি লক্ষ রাখা উচিৎ। ঈদের দিনে সব ধরনের অপকর্ম থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন।

আল্লাহর নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) নিজের অধীনস্থদের ভুল ত্রুটি ক্ষমা করে দিতেন, নতুন কাপড় পরিধান করতেন, সাহাবাদের আমন্ত্রণ জানাতেন, আহলে বয়াতদের ঘরে গমন করতেন, বিধবা ও অনাথদের তোহফা পাঠাতেন, দরিদ্র ও অসহায়দের খবর নিতেন। রমজান মাসে প্রকৃত রোজাদার কৃচ্ছ্র সাধনার কোনো ত্রুটি করতে পারে না। এ মাসে ক্ষুধার্ত মানুষের বেদনা, সর্বহারার যন্ত্রণা, দরিদ্র ব্যক্তির কান্না সহজে উপলব্ধি করা যায়। ইসলামের অক্ষয় সাম্য নীতির ফলে রমজান মাসে মানবতার স্পর্শে, মনুষ্যত্বের মহান পরশে ভোগ ও লালসায় ভরা মানুষ সুশিক্ষা লাভের সুযোগ লাভ করে।

রোজা শেষে ঈদের দিনে শুধু আনন্দে বিভোর হলে হয় না, সেই সঙ্গে তাকে ফিতরা প্রদান করে দুস্থ ও দরিদ্রদের মুখে আনন্দ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতে হয়। এজন্য ঈদের দিনের প্রথম ও প্রধান কাজ ঈদের নামাজের সঙ্গে সঙ্গে সামর্থবানদের (সাহেবে নিছাব) ফিতরা আদায় করতে হয়। ইসলামী অর্থনীতির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্থ, সম্পদ ব্যক্তি বিশেষের কব্জায় না রেখে সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়া-যাতে করে সমাজের দীনতম ব্যক্তিও এর থেকে উপকৃত হয়, তার দৈন্য লাঘব হয়। তবে ফিতরা-যাকাত দান করার নামে অহেতুক নিজের প্রভাব বিস্তার করার কুমতলব গ্রহণযোগ্য নয়। বাড়ীর ফটকের সামনে শত শত নিঃস্ব মানুষের ভিড় জমিয়ে নিজেকে কৃতার্থবোধ করা বা নিজেকে প্রচার করা আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় নয়। এক্ষেত্রে সুসংগঠিতভাবে ফিতরা, জাকাত সংগৃহীত করে সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রকৃত প্রাপকদের হাতে পৌঁছে দেয়া সমাজের জন্য অধিক কল্যাণকর হতে পারে এবং সমাজ থেকে দরিদ্রতা লোপ পেতে পারে।

ঈদ আনন্দোৎসব হলেও তার একটি সীমারেখা রয়েছে। এ সীমারেখা লঙ্ঘন করতে নেই। কেননা সীমালঙ্ঘনকারীদের আল্লাহ কখনো পছন্দ করেন না। ঈদ-উল-ফিতরের প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে ঈদের দু’রাকাত নামাজ সমবেতভাবে আদায় করা। নামাজের সময় হচ্ছে সূর্যোদয়ের প্রায় ত্রিশ মিনিট পর থেকে দ্বিপ্রহরের পূর্ব পর্যন্ত। এর সঙ্গে নামাজের পূর্বে ফিতরা আদায় করার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য সুন্নত কাজের মধ্যে রয়েছে প্রত্যুষে গোসল করা, সামর্থ অনুযায়ী উত্তম পোশাক পরিধান করা, সুগন্ধ ব্যবহার করা, ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে সুগন্ধি ও সুমিষ্ট দ্রব্য ভক্ষণ করা, এক রাস্তায় ঈদগাহে যাওয়া ও অপর রাস্তায় ফিরে আসা, বেশী করে তকবির পাঠ করা, পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজনদের খোঁজ খবর করা ইত্যাদি। জোর করে চাঁদা আদায় করে তা অপচয় করা, অপ্রয়োজনীয় আলোকসজ্জা বা তোরণ নির্মাণ করা, রাতভর গানবাজনা করে আমোদ-প্রমোদ করা বা এ ধরনের কোনও কাজের স্বীকৃতি ইসলামে নেই।

ঈদ-উল-ফিতরে সমস্ত মনবতাবাদী কাজের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের আত্মসংশোধনের প্রতি কঠোর দৃষ্টি রাখা, হারাম-হালালের পার্থক্য নিরূপণ করা, অসৎভাব পরিত্যাগ করা, অন্যায় হত্যা, লুণ্ঠন থেকে বিরত থাকা, সাম্য শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা করা এবং সর্বোপরি খোদাভীতি অর্জন ফিতরের মহান শিক্ষা। এসবের প্রতি সর্বাবস্থায় দৃষ্টি দেওয়া আজকেও প্রাসঙ্গিক।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন