এভাবে ধ্বংস না হলে, ঐসব বিষাক্ত পদার্থ শরীরের রক্তচাপ, একজিমা, অন্ত্র ও পেটের পীড়া ইত্যাদি বিভিন্ন রোগ-ব্যাধির জন্ম দেয়। এছাড়াও উপবাসে কিডনি ও লিভারের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং শরীরে নতুন জীবনীশক্তি ও মনে সজীবতার অনুভূতি তৈরি হয়।
রাশিয়ার প্রখ্যাত শরীর বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডাক্তার ডি,এন, নাকিটন বলেন,তিনটি নিয়ম পালন করলে শরীরের বিষাক্ত দ্রব্যাদি বের হয়ে যাবে এবং বার্ধক্য থেমে যাবে। যথা- অধিক পরিশ্রম করা, অধিক পরিমাণে ব্যায়াম করা এবং প্রত্যেক মাসে একদিন উপবাস থাকা।
ডক্টর ডিউই জোড় দিয়ে বলেন, রোগাক্লিষ্ট মানুষের পাকস্থলি থেকে খাদ্য দ্রব্য সরিয়ে ফেল, দেখবে রুগ্ন মানুষটি উপবাস থাকছে না, উপবাস থাকছে তার শরীরে বাসা বেঁধে থাকা দীর্ঘদিনের রোগটি।”
বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক ডা. নূরুল ইসলাম বলেন, রোযা মানুষের দেহে কোনো ক্ষতি করে না। ইসলামের এমন কোনো বিধান নেই, যা মানবদেহের জন্যে ক্ষতিকর। গ্যাস্ট্রিক ও আলসার-এর রোগীদের রোযা নিয়ে যে ভীতি আছে তা ঠিক নয়। কারণ রোযায় এসব রোগের কোনো ক্ষতি হয় না বরং উপকার হয়। রমযান মানুষকে সংযমী ও নিয়মবদ্ধভাবে গড়ে তুলে।
একটানা ১মাস রোযা রাখার ফলে জিহ্বা ও লালা গ্রন্থি সমূহ বিশ্রাম পাওয়ার সুযোগ পায়। এর ফলে এগুলো আরো সতেজ হয়। এতে জিহ্বায় খাদ্য দ্রব্যের স্বাদ বৃদ্ধি পায়। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনা বহুমুত্র রোগ কমাতে সাহায্য করে, অত্যধিক মোটা হওয়া থেকে শরীরকে বাঁচায়, লালা গ্রন্থি সমূহ বড় হবার আশংকা থেকে মুক্তি পায়। রোযা দেহের অন্ডকোষ এবং গ্রন্থিসমূহের নবজীবনীশক্তি প্রবাহিত করে দেয়। রোযার মাধ্যমে জৈবিক চাহিদাকে সাময়িকভাবে নিস্তেজ করে মনকে পবিত্র ও ভাল কাজের দিকে মনোনিবেশ করা যায়। রোযা মস্তিস্ক ও স্নায়ুতন্ত্রকে উজ্জীবিত করে। এতে ধ্যান-ধারণা পরিস্কার ও সহজ হয়। বিশিষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডাক্তার আলেক্স হেইগ বলেছেন-“সিয়াম হতে মানুষের মানুষিক শক্তি এবং বিশেষ বিশেষ অনুভূতিগুলো উপকৃত হয়, স্মরণ শক্তি বাড়ে, মনোযোগ ও যুক্তি শক্তি পরিবর্ধিত হয়, প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা, সহানুভূতি, অতীন্দ্রিয় এবং আধ্যাত্মিক শক্তির উন্মেষ ঘটে। ঘ্রানশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবনশক্তি বেড়ে যায়। ইহা খাদ্যে অরুচি ও অনিহা দূর করে। সিয়াম শরীরের রক্তের প্রধান পরিশোধক। রক্তের পরিশোধন এবং বিশুদ্ধি সাধন দ্বারা দেহ প্রকৃতপক্ষে জীবনশক্তি লাভ করে। যারা রুগ্ন তারাও সিয়াম পালন করা উচিত”। (চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে রোযা)
ডা : জুয়েলস, ডা : ডিউই, ডা : এলেক্স হিউ প্রমুখ প্রখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানীগণ স্বীকার করেছেন যে, রোযা শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এর ফলে দেহের জীবানুবর্ধক অন্ত্রগুলি ধ্বংস হয়, ইউরিক এসিড বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হয়। রোযা চর্মরোগ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, গ্যাষ্ট্রিক আলসার ইত্যাদির জন্য অত্যন্ত উপকারী বিবেচিত হয়েছে। মেদ ও কোলেষ্টরেল কমানোয় রোযার জুড়ি নেই। সর্বোপরি রোযা মনে শান্তি আনে, কুপ্রবৃত্তি প্রশমিত করে, দীর্ঘ জীবন দান করে। এভাবেই বিজ্ঞানীরা খুজে পেয়েছেন পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহতে আসা রোযা রাখার প্রতি উৎসাহের প্রকৃত রহস্য। আর তাই আজ উন্নত বিশ্বের জার্মান, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে বিভিন্ন জটিল রোগের প্রশমনের ব্যবস্থা পত্রে চিকিৎকগণ রোযা রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন। (সুন্নতে রাসুল ও আধুনিক বিজ্ঞান)
রোজার ঐতিহাসিক পটভূমিঃ আল কুরআন থেকে জানা যায়, আমাদের পূর্বে যারা ছিল, তাদের প্রতিও রোযা ফরজ করা হয়েছিল। আদি পিতা হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) থেকে শুরু করে হযরত ঈসা(আলাইহিস সালাম) পর্যন্ত সকল নবীদের উম্মতের উপর রোযা ছিল ফরজ ইবাদত। পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতের রোযার সময় ও সংখ্যার ক্ষেত্রে পার্থক্য বিদ্যমান ছিল। আগেকার যুগে রাতে নিদ্রা যাওয়া থেকেই রোযা শুরু হয়ে যেত। ইফতারের পর থেকে শয্যা গ্রহণের পূর্ব পর্যন্তই শুধুমাত্র পানাহার ও স্ত্রী সহবাসের অনুমতি ছিল। বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসবকিছু হারাম হয়ে যেত। আদি পিতা হযরত আদম (আলাইহিস সালাম) থেকে হযরত নূহ ( আলাইহিস সালাম) পর্যন্ত প্রতিটি মুসলমান প্রতি চন্দ্র মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোযা রাখতেন। হযরত ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) এর উম্মতের উপর ৩ দিন (পহেলা রমযান থেকে ৩ রমযান) রোযা রাখা ফরজ ছিল। হযরত ইসমাঈল (আলাইহিস সালাম) এর উম্মতের উপর সর্বমোট ৭টি রোজা রাখা ফরজ ছিল। হযরত সোলায়মান (আলাইহিস সালাম) এর উম্মতের উপর ৯টি রোযা ফরজ ছিল বলে জানা যায়। হযরত দাউদ (আলাইহিস সালাম) বছরের অর্ধেক সময় রোযা রাখতেন আর বাকী অর্ধেক সময় বিনা রোযাতে থাকতেন। হাদীস শরীফে এসেছে- প্রিয়নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেন: আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নিকট সবচেয়ে প্রিয় রোযা দাউদ (আলাইহিস সালাম) এর রোযা। তিনি এক দিন রোযা রাখতেন অন্যদিন বিনা রোযায় থাকতেন। ইহুদীরা রোযা রাখতো ৪০ দিন, খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের লোকেরা রোযা রাখতো ৫০ দিন। খ্রীষ্টানরা পরবর্তীকালে রোযা পরিবর্তন করে, ঘুরিয়ে দেয় দিনের সংখ্যা। আর হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর উম্মতের উপর রোযা ফরজ করা হয়েছে পূর্ণ এক মাস। সহীহ বুখারী; সহীহ মুসলিম; বায়হাকী শরীফ; ফাত্হুল বারী
সর্বপ্রথম কোন রোযা ফরজ ছিল এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। কারো কারো মতে, আশুরার রোযা ফরজ ছিল, কারো কারো মতে, প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখের রোযা ফরজ ছিল। কেননা, নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যখন মদিনায় আগমন করেন তখন এ রোযাগুলো পালন করতেন। হিযরতের দ্বিতীয় বছর শাবান মাসে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রোযার আদেশ নাযিল করেন। সে বছর অর্থাৎ হিজরী দ্বিতীয় বছর থেকেই উম্মতে মোহাম্মদীর উপর রমযানের ৩০টি রোযা ফরয করা হয়।
লেখক: আরবী প্রভাষক, রাণীরহাট আল আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদ্রাসা;
এমফিল গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন