বুদ্ধি এবং বিবেকবোধের এক সমষ্টিগত রূপ হলো মন। যা চিন্তা, অনুভূতি, আবেগ, ইচ্ছা এবং কল্পনার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। মন কি,কিভাবে কাজ করে এবং মন-মানসিকতার পর্যায় কি কি, সে সম্পর্কে অনেক রকম তত্ত্ব প্রচলিত আছে। এসব তত্ত্ব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়েছে মূলতঃ প্লেটো, অ্যারিস্টটল এবং অন্যান্য প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকদের সময়কাল থেকে। বর্তমান সময়েও মনতত্ত্বের অনেক আলোচনা পর্যালোচনা বিদ্যমাণ।সর্বপ্রকার দার্শনিক মনে করেন মনের সর্বোত্তম পর্যায় হলো মুক্তমন তথা ফ্রি-মাইন্ড।মুক্তমন শব্দের অর্থ হলো অবারিত মন।যা সর্ব প্রকার পঙ্কিলতা,কলুষতা,ভাড়ামি,শঠতা ও ভন্ডামির উর্ধ্বে।যেখানে একের প্রতি অন্যের কু-ধারণা থাকবে না;কলুষতা ও আবিলতা মুক্ত অকপট বিশ্বাসে ভরা থাকবে মন,সহজ সরল হৃদয়ে একে অপরের কথা,কাজ ও আচরণকে গ্রহণ করবে,একে অপরের সান্নিধ্যে আসবে সকল বর্ণচোরা মনোবৃত্তি মুক্ত হয়েই।ইসলামী শরীয়তে সকল মুসলিমকে উত্তম চিন্তা লালনকারী ও উত্তম চরিত্রে অধিকারী হতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন-
‘মানুষের সাথে সুন্দরভাবে কথাবার্তা বলো।’(সূরা আল বাকারা, আয়াত ৮৩)নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,’’প্রতিটি ভালো কাজ ছদাকা। আর গুরুত্বপূর্ণ একটি ভালো কাজ হল, অপর ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করা’’। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯৭০
ইসলামে হারাম করা হয়েছে সকল কুধারণা,ভাড়ামি,শঠতাকে। নিষিদ্ধ করা হয়েছে পাপাচার ও অবাধ যৌনাচারকে।আল্লাহ তাআলা কুরআনে ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা অধিকাংশ (অহেতুক) অনুমান থেকে দূরে থাক। কারণ (অহেতুক) অনুমান কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাপ। (সুরা হুজরাত : আয়াত ১২)
অহেতুক মানুষের প্রতি কু-ধারণা পোষণ করার ফলে পরস্পরের প্রতি বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হয়; সামাজিক সুসম্পর্ক ছিন্ন হয়। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে পারস্পরিক ঐক্য, সাম্য ও সম্প্রীতি নষ্ট হয়। আর এ অহেতুক ধারণা থেকেই মিথ্যার সৃষ্টি হয়।রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরস্পরের প্রতি অহেতুক ধারণা করা থেকে বিরত থাকতে হাদিসের মাধ্যমে সুস্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা অহেতুক ধারণা থেকে বেঁচে থাকো। কেননা অহেতুক ধারণা জঘন্যতম মিথ্যা। (বুখারি ও মুসলিম)
ব্যাবহারিক জীবনে ফ্রি মাইন্ড ও মুক্তমন এর গুরুত্ব অপরিসীম।এটা একটা হৃদ্যতাপূর্ণ , আন্তরিক ও মুধুর জীবন যাপনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য অপরিহার্য।কিন্তু বর্তমান সময়কার আধুনিক সভ্যতার লোকেরা মুক্তমন তথা ফ্রি-মাইন্ড শব্দটার সাহায্যে আধুনিক রকম শুভংকরের ফাঁকি দিচ্ছে।বর্তমানের আধুনিকতার প্রবক্তারা ফ্রি মাইন্ডের নামে খোলামেলা স্বেচ্ছাচারী জিন্দেগী বা বেগানা নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা ,এমন কি ফ্রি সেক্সের পর্যায়ে চলে আসছে।প্রেমিক-প্রেমিকা স্কুল,কলেজ,প্রতিষ্ঠান,কর্মস্থল ফাঁকি দিয়ে পার্কের বৃক্ষের ছায়ায়,লেকের মৃদুমন্দ বাতাসে,ভার্সিটির বিভিন্ন চত্ত্বরে ,বড় বড় দেয়ালের আনাছে,পাবলিক লাইব্রেরিতে ,শহরের নামিদামি রেস্টুরেন্টে আহার ভোজনে,দেশের দর্শনীয় স্থানে ভ্রমনের নামে বাঁধাহীন মেলামেশার বর্তমান পরিভাষা হলো ফ্রী-মাইন্ড তথা মুক্তমন।বর্তমান অতি-আধুনিক পরিবার গুলোতে এই ফ্রী-মাইন্ডের এতো বেশি প্রচলন যে,স্বয়ং প্রেমিক-প্রেমিকা একে অপরের পরিবারে অবাধ যাতায়াত।যেখানে একদিকে প্রেমিক-প্রেমিকা একে অপরের সাথে নিজ বেডরুমে ফস্টিনস্টি করে অন্যদিকে তাদের অভিভাবক তাদের জন্য চা-নাস্তা,লাঞ্চ,ডিনারের ব্যবস্থা করে।আজকাল যৌনাচারই যেন ফ্রী-মাইন্ড তথা মুক্তমন।নাজায়েজ প্রেম প্রেম খেলা আর তারপর নোংরামি করে কলার ছিলকার ন্যায় ডাস্টবিনে নিক্ষেপ পর্যন্ত সবই ফ্রি মাইন্ড বা মুক্তমনার ছত্রছায়ায়-ই চলে।এসব তথা কথিত মুক্তমনা সম্পূর্ণ ইসলাম বিদ্বেষী।ইসলামে বিবাহবিহির্ভূত প্রেম, যৌন সম্পর্ক, আসক্তিমূলক আচরণ, সামাজিকতার নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ফাহেশা কথা-বার্তা বা চ্যাটিং সবই হারাম তথা নিষেধ। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কুরআনে পাকে সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন-‘হে নবি পত্নীগণ! তোমরা অন্য নারীদের মতো নও; যদি তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তবে পরপুরুষের সঙ্গে কোমল ও আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলো না। যার ফলে সে ব্যক্তির কুবাসনা সৃষ্টি হয়, যার অন্তরে আসক্তি আছে। তোমরা উত্তম (সংযত) কথাবার্তা বলো।’ (সুরা আহযাব : আয়াত ৩২) নারী-পুরুষ পরস্পরের প্রতি দৃষ্টি বিনিময়েও রয়েছে সুস্পষ্ট হুকুম। এ প্রসঙ্গে কুরআনে পাকে আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্ট নীতিমালা ঘোষণা করেছেন। পুরুষদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-‘(হে রাসুল! আপনি) মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা রয়েছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তাআলা সে ব্যাপারে খবর রাখেন।’ (সুরা নুর : আয়াত ৩০) আবার নারীদের উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-‘(হে রাসুল! আপনি) ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। সাধারণতঃ প্রকাশমান ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বুকের ওপরে ফেলে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, বাবা, শ্বশুর, ছেলে, স্বামীর ছেলে, ভাই, ভাইয়ের ছেলে, বোনের ছেলে, স্ত্রীলোক অধিকারভূক্ত বাদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ ও (এমন) বালক- যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতিত অন্য কারো সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। (এমনকি) তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তাওবা কর; যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।’ (সুরা নুর : আয়াত ৩১)
কুরআন-সুন্নাহর সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা হলো, মুসলিম নারী-পুরুষ উভয়ে অবৈধ সংস্পর্শ, কথা-বার্তা ও দেখা-সাক্ষাৎ, আসক্তি ও সাজ-সজ্জা থেকে বেঁচে থাকা। নিজেদের দ্বীন ও আত্মসম্মান রক্ষা করা।
কিন্তু আজকাল যতক্ষণ না কেউ ইসলামি জীবন বিধান লালন ও নৈতিক অনুশাসন থেকে মুক্ত হতে না পারছে,ততক্ষন যেন সে আধুনিকতার মানদণ্ডে ফ্রি মাইন্ড বা মুক্তমনের অধিকারী হতে পারছেনা।কেউ একটু পর্দা -পুশিদার কথা বা নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা থেকে বিরত থাকার কথা বললেই হয়ে যায় সেকেলে অথবা সংকীর্ণমনার মানুষ তথা মুক্তমনের পরিপন্থী।ফ্রী-মাইন্ডের ভাষ্য, নিজেকে দিতে হবে বিলিয়ে মনের দুয়ার মুক্ত করে,যেন সেই দুয়ার দিয়ে অবাধে প্রবেশ করতে পারে যে কেউ,তা সেটা কালনাগীন,বিচ্চু বা কালকেউটেউ হোকনা কেন।আর দুদিন পর সে কালকেউটের,কালনাগীনের দংশনে স্ফীতে তলদেশ মেদবহুল হয়ে উঠলেও থাকবেনা কোনো বাঁধা।এর বিপরীতে কথা বললেই আপনি হবেন মধ্যযুগীয় বর্বর,হয়তো আনকালচারও হয়ে ওঠবেন তাদের দৃষ্টিতে।
আফসোস যে আজকাল মুসলিম যুব সমাজও নিজস্ব সংস্কৃতিকে জলাঞ্জলী দিয়ে আধুনিকতার ছোবলে,ফ্রী-মাইন্ডের কবলে স্মার্ট হওয়ার জন্য পাশ্চাত্যের সংস্কৃতিকে লালন করছে।কথায় আছে,যৌন আবেগের প্রকাশই সমস্ত প্রেম প্রীতির ভালোবাসার উৎস। ফ্রী-মাইন্ডেড পরিচয় বহনের লক্ষে, স্মার্ট হওয়ার ভাবনায় আমাদের তারুন্যকে আজ জীবনের শুরুতেই নারীর হৃদয়ে স্থান দখলের যুদ্ধে অবর্তীণ হতে হচ্ছে।আমাদের সম্মানীত অভিভাবকগণের বক্তব্য ছিল,তোমরা নিজেদের তৈরী কর,সময়ের ব্যবধানে নারীর সন্ধান মিলবেই।কিন্তু ফ্রী-মাইন্ডের বিকাশ এমন পর্যায় গিয়ে পৌছেছে যে,অভিভাবক বলতে বাধ্য হচ্ছে,প্রেম ভালোবাসার প্রয়োজন তাহলে একটি নারীর হৃদয় নিয়েই সন্তুষ্ট থাক।কেন এত গুলো নারীর জীবনকে হুমকীর সম্মুখীন করছ?কিন্তু আজ আমায় বলতে হচ্ছে,কতগুলো নারীর প্রেম ভালোবাসা তোমার প্রয়োজন?সবই গ্রহণ কর!তবে অনুরোধ থাকবে পরকীয়া,ছদ্মবরণে আবদ্ধ করে কোন পরিবারকে ধ্বংসের সম্মুখীন করিও না। (চলবে)
লেখকঃ প্রাবন্ধিক ও শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন