আল্লাহ্ তা’য়ালার এমন কিছু বান্দা আছেন- যাঁদের জন্ম সৃষ্টির প্রতি আল্লাহর তা’য়ালার বিশেষ অনুগ্রহ, যাঁদের মাধ্যমে আল্লাহর বান্দাগণ নাজাতের পথ খুঁজে পায় এবং তাঁদের পিছু পিছু চলে চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করে। এমন বান্দাদের সংখ্যা খুবই সীমিত। নবী রাসূলের পথে ওয়ারেসাতুল আম্বিয়া তথা নবীগণের উত্তরসূরী হয়ে পূন্যাত্মা আলেম ও আউলিয়াগন দ্বীন ইসলামের আলোকে দুনিয়ার বুকে টিকিয়ে রেখেছেন। অসাধারণ জ্ঞানগভীরতার অধিকারী, আধ্যাত্মিক জগতের বাতিঘর, উপমহাদেশের প্রখ্যাত অলিয়ে কামেল, ইমামে আহলে সুন্নাত, আল্লামা কাযী মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম হাশেমী (রহ.)। এ উপমহাদেশের বিদগ্ধ ওলামায়ে আহলে সুন্নাতের মধ্যে বর্তমানে তিনি অদ্বিতীয় ও অতুলনীয় ছিলেন। প্রিয়নবী ছরকারে দো’আলম হুযুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম- এর সুন্নাতের একনিষ্ঠ অনুসারী এ মহান ব্যক্তিত্ব আমাদের অনুপম অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে সমুন্নত।
আউলিয়া কেরামের স্মৃতিধন্য চট্টগ্রাম জেলার তৎকালীন পাঁচলাইশ বর্তমানে বায়েজীদ বোস্তামী থানার অর্ন্তগত জালালাবাদের এক ধর্মভীরু সম্ভ্রান্ত মুসলিম কাযী পরিবারে হাশেমী বংশে আল্লামা কাযী মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম হাশেমী (রহ.) আরবী মাসের ১৫ রজব ১৩৪৯ হিজরী সনে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতা শাহ্ সুফী মাওলানা কাযী আহছানুজ্জমান হাশেমী (রহঃ) ছিলেন প্রসিদ্ধ হাশেমী বংশের একজন কৃতিপুরুষ। তাঁর মাতা ছিলেন বাংলার মোহাদ্দেসে আযম অলিয়ে কামেল চট্টগ্রাম শাহী জামে মসজিদের সাবেক ইমাম ও খতীব আল্লামা ছফিরুর রহমান হাশেমী (রহঃ)- এর ঔরসজাত কন্যা। তাঁর পূর্বপুরুষ সৈয়্যুদুশ শোহাদা ইমাম হোসাইন (রাঃ)- এর বংশধর। তাঁর পিতার পূর্বপুরুষ মদিনা শরীফ হতে হিযরত করে বাগদাদে আসেন। (তাদের বংশ ইমাম হাসান (রহঃ)- এর সাতে মিলিত হয়)। ওখান থেকে দিল্লীর বাদশাহ্ আওরঙ্গজেব আলমগীরের আমলে কাজীউল কুজাত বা প্রধান বিচারপতি হতে দিল্লীতে আসেন। দিল্লী থেকে নবাবী আমলে ইসলাম খাঁর অনুরোধে কাজীর দায়িত্ব গ্রহন করে বিশেষত ইসলাম প্রচারের নিমিত্তে চট্টগ্রামে তশরীফ আনেন। হযরত গাউসে আযম আহমদ উল্লাহ্ মাইজভান্ডারী (রহঃ)- এর শ্রদ্ধেয় পীর কুতুবুল আরেফীন, ইমামুল মাশেয়েক হযরত খাজা ছালেহ লাহোরী (রহঃ)- এর সুযোগ্য খলিফা পাঁচলাইশ থানার বাকলিয়া নিবাসী মাওলানা সৈয়দ আব্দুন্নবী (রহঃ) এর কন্যা বিবি শরীফা খাতুনের সঙ্গে তাঁর দাদাজান মাওলানা কাজী আব্দুর রহীম হাশেমীর সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। উল্লেখিত জীবনে দেখলেই বুঝা যায় ইমামে আহলে সুন্নাত, আল্লামা কাযী মুহাম্মদ নুরুল ইসলাম হাশেমী (রহ.) পিতা ও মাতা উভয় দিক থেকে তাঁর বংশধারা ছিল সম্ভ্রান্ত ও উঁচুস্তরের।
তিনি বাল্যকাল থেকেই তীক্ষè মেধাবী ও অত্যান্ত প্রতিভাবান ছিলেন। তিঁনি মাত্র ছয় বছর বয়সে ক্বোরআন মজীদ খতম করেন। উর্দু, ফার্সি, আরবী, বাংলার প্রাথমিক জ্ঞান স্বীয় গৃহে আপন বুযর্গ পিতার কাছ থেকে অর্জন করেন। অতঃপর প্রাইমারী স্কুল পাশ করে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন প্রসিদ্ধ দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ওয়াজেদীয়া আলীয়া মাদরাসায় ভর্তি হন এবং নিয়মিতভাবে শিক্ষা অর্জন করেন। সেখান থেকে প্রত্যেকটি পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে পাশ করে ১৯৪৫ সালে জামাতে পঞ্জুমের পরীক্ষায় শিক্ষা বোর্ডের অধীনে কৃতিত্বের স্বাক্ষর স্বরুপ সনদ ও মাদরাসার পক্ষ থেকে গোল্ড মেডেল লাভ করেন। ১৯৪৯ সালে জামাতে উলা পর্যন্ত শিক্ষা কৃতিত্বের সহিত সমাপ্ত করেন। তিনি আরবী ভাষার বিভিন্ন বিষয়ে পান্ডিত্য লাভ করতে সক্ষম হন। আল্লামা হাশেমী উচ্চতর জ্ঞান অর্জনের নিমিত্তে ঢাকা গমন করেন এবং তৎকালীন ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাদরাসাই আলীয়া ঢাকাতে ১৯৫১ সালে টাইটেল ক্লাশের হাদীস বিভাগে ভর্তি হন। তিঁনি তখনকার সময়ে পাক ভারতের অনন্য ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন আলেম শরীয়ত ও তরিকতের মাজমাউল বাহরাইন আরবী ও উর্দু ভাষায় বিভিন্ন বিষয়াদির উপর অগনিত গ্রন্থ রচিয়তা প্রখ্যাত আলেম আল্লামা মুফতি সৈয়দ আমীমুল এহছান মুজাদ্দেদী বরকতী কুদ্দেসা সিররুহুর সান্নিধ্যে থেকে ইলমে হাদীস, ফেকাহ, তাফসীর ইত্যাদি বিষয়ের উপর গবেষণা করে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। আল্লামা হাশেমী (রহ.) ১৯৫২ সালে হযরত মুফতী সাহেব (রহঃ) তাকে ‘‘নাইমুল মুরাম বে-আসানি আশ শাইখ নুরুল ইসলাম’’ বিশেষ সনদ ও সম্মাননা প্রদান করেন। এছাড়া তিনি প্রখ্যাত আরবী সাহিত্যিক আল্লামা আব্দুর রাহমান কাশগরী (রহঃ)- এর স্নেহ লাভেও ধন্য হন।
ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের অবদান: দ্বীনের সেবায়, রক্ষায়, চর্চায় ও দেশ চিন্তাই উদ্ভব থাকেন সারাক্ষণ। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকা আলীয়া মাদরাসা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন সময় মাতৃভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহনে বাংলার প্রতি দরদ এবং ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও পরামর্শে এক বীরত্বপূর্ণ ও সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন। যা জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে। তদানিন্তন আলেম সমাজের চিরচারিত পাকিস্তান তোষন নীতির ব্যতিক্রম হিসেবে স্বাধনীতা সরাসরি সমর্থন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়-পশ্রয় দিয়েছেন ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা হাশেমী। ‘বাংলাদেশে তিনিই একমাত্র ইসলামী চিন্তাবিদ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসা, ছোবহানিয়া আলীয়া মাদ্রাসা ও ওয়াজেদিয়া আলীয়া মাদ্রাসায় রাজাকার/আলবদর কমিটি গঠনে বাধা প্রধান করে সাফল্য লাভ করেছিলেন’ (বাঙ্গাল কেন যুদ্ধে গেল, পৃষ্ঠা-২৮৭)।
সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক জীবনে আল্লামা হাশেমী মাদ্দাজিল্লুহুল আলী ১৯৮০ সালে জামাতে আহলে সুন্নাতের অঙ্গসংগঠন হিসাবে আকাঈদে আহলে সুন্নাতের ধারক বাহক হিসাবে এদেশে সুন্নী মতাদর্শ ভিত্তিক ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলনরত একক সুন্নী ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনা গঠনে গুরু দায়িত্ব পালন করেন। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের সুদৃঢ় করণে হুযুর কেবলা আজীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করে গিয়েছেন। বর্তমানে এদেশের সুন্নী আকীদা বিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্যের বিরাট দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এছাড়া তিনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’য়াতের কেন্দ্রীয় পরিষদের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’য়াতের কেন্দ্রীয় পরিষদের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট, আহলে সুন্নাত সম্মেলন সংস্থা- বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্ঠা, এদেশের আ’লা হযরত চর্চা ও গবেষণার একমাত্র ঐতিহ্যবাহী সংগঠন আ’লা হযরত ফাউন্ডেশন- বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্ঠা, জাতীয় ঈদে মিলাদুন্নবী কমিটির সম্মানিত আহ্বায়ক ছিলেন। (চলবে)
লেখক: প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন