নাটক শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়। সমাজ বদলের হাতিয়ারও। নাটকের মাধ্যমে সমাজের ইতি-নেতি দিকসহ নানা সমস্যা এবং সমাধানের চিত্র উঠে আসে। এজন্য নাটককে সমাজের দর্পণও বলা হয়। বিনোদনের মাধ্যমে শিক্ষনীয় ও শুদ্ধ বিষয়বস্তু তুলে ধরাই এর মূল লক্ষ্য। বর্তমান সময়ের নাটকে এ ধরনের ঠাসবুনটের নাটক খুব কমই দেখা যায়। হালকা-চটুল গল্প এবং প্রেম-রোমান্সের কচকচানিই বেশিরভাগ নাটকে দেখা যায়। অথচ আমাদের নাটকের ইতিহাস এমনই যে, তা দর্শককে মাতোয়ারা করে তুলত। বিনোদন যেমন পেত, তেমনি চিন্তার খোরাকও পেত। শুধু দেশেই নয়, আমাদের নাটক দেশের সীমা ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী দেশেও দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। ৯০ দশকে আমাদের নাটক দেখার জন্য ভারতের সীমান্তলগ্ন এলাকার মানুষ এন্টেনায় ঘটি-বাটি লাগিয়ে রাখত, যাতে স্পষ্টভাবে নাটক দেখা যায়। সে সময় পরিবারের সদস্যরা একসাথে নাটক উপভোগ করত। টেলিভিশনে কবে, কখন নাটক দেখানো হবে তার সময়সূচী দর্শকরা মনে রাখত। সময়ের সাথে সাথে টেলিভিশন মিডিয়া যেমন ব্যাপ্তি লাভ করেছে, তেমনি নাটকের গল্পের ধরনেও পরিবর্তন এসেছে। তবে অনেকটা নেতিবাচক ধারায় রূপান্তরিত হয়েছে। বর্তমান সময়ের অধিকাংশ নাটকে অশ্লীল বাক্য, অশুদ্ধ উচ্চারণ, ভাষার বিকৃতি, গালিগালাজ, কুরুচীপূর্ণ ইঙ্গিত দেখা যায়, যা পরিবারের সদস্যদের সাথে বসে দেখতে গেলে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। অনেকেই এ ধরনের নাটক নির্মাণ করছেন। এটা তাদের মানসিক বিকৃতি ছাড়া কিছু নয়। সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধ কোনো সুস্থ ও শুদ্ধ ধারার নির্মাতা এমনটি করতে পারে না। সম্প্রতি কাজল আরেফিন নামে এক নির্মাতার বেশ কিছু নাটক দেখলে মনে হবে, আমাদের নাটকের গৌরব, সংস্কৃতি ও ধারা কি এমনই! তার পরিচালিত ব্যাচেলর পয়েন্ট নাটকের বিভিন্ন অংশে অসংখ্যবার গালিগালাজ, নামের বিকৃতি ও কুরুচীপূর্ণ ইঙ্গীতে ভরপুর ছিল। সম্প্রতি এই পরিচালকের ফিমেল-২ নামের একটি নাটকেও গালিগালাজ করা হয়েছে। শুধু এই নির্মাতাই নন, আরও অনেক নির্মাতাই রয়েছেন যাদের নাটকে এমনসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে, যা আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতি এবং নাটকের ঐতিহ্যকে ভুলুণ্ঠিত করছে। নাট্যবোদ্ধারা মনে করছেন, শর্টকাটে এবং অশালীন ও নিষিদ্ধ বিষয় নাটকে তুলে ধরে তারা দর্শক আকৃষ্ট করতে এমনটি করছেন। নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি মানুষের আকর্ষণ স্বভাবজাত। সমাজে অনেক অপ্রীতিকর ও অশালীন ঘটনা ঘটে। তাই বলে সেগুলো সরাসরি নাটকের মতো মননশীল মাধ্যমে তুলে আনা উচিৎ নয়। ভিন্নভাবে তুলে এনে তা যে ভালো নয় এ ম্যাসেজ দেয়া এবং সমাধানের কথা বলাই নাটকের মূল উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্যকে পাশ কাটিয়ে নির্মাতারা নেতিবাচক দিককেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন। এটা কোনো সুস্থ মানসিকতা হতে পারে না। তবে ভালো নাটক যে হচ্ছে না, তা নয়। এমন কিছু নাটক আছে যা দর্শকের মনে চিন্তার প্রসার এবং উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। এসব নাটক অশালীন নাটকের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে। নাট্যবোদ্ধারা মনে করেন, শুধুমাত্র ভিউ বাড়িয়ে আমাদের নাটকের ঐতিহ্যকে এভাবে নষ্ট করা কাম্য হতে পারে না। এসব নাটকের মাধ্যমে বিশ্বে আমরা কি বার্তা দিচ্ছি? আমাদের নাটক এমনই অশালীন, আমাদের সমাজ-সংসারে এমন ঘটনা এবং কথা-বার্তা হয়, এই বার্তাই কি দেয়া হচ্ছে না? অথচ আমাদের উচিৎ আমাদের সমাজ ও পারিবারিক সংস্কৃতির ইতিবাচক বিষয়গুলো তুলে ধরা। নির্মাতারা যদি এ মানসিকতা ধারণ করে নাটক নির্মাণ করে তবে দর্শকও তাই দেখবে। কারণ, একজন নির্মাতাই তার সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে দর্শক সৃষ্টি করেন। তিনি যা উপস্থাপন করবেন, তা কম-বেশি দর্শক দেখবে। ভালো হলে দর্শক বাড়বে, খারাপ হলে দর্শক কমবে। অর্থাৎ দর্শকের রুচি ও আগ্রহ তৈরির বিষয়টি একজন নির্মাতার ওপরই নির্ভর করে। এ বিষয়টি মাথায় রেখে নাটক নির্মাণ করা প্রয়োজন। অশ্লীল ও অশালীন নাটক দিয়ে সাময়িক দর্শকের মনে সুড়সুড়ি দেয়া যেতে পারে, তবে তা কখনো স্থায়ী হয় না। দিন শেষে মানুষ ভালো কিছুই পেতে চায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন