১৮ নং ধারা পূরণের আগেই বরের স্বাক্ষর নিয়ে নেওয়া : অনেকে কাবিননামার ধারাগুলো পূরণ করার আগেই সাদা ফরমে দস্তখত করে দেয়। সাধারণত বিবাহের রেজিস্টার বা কাজীরা বর-কনের কাছ থেকে এভাবে আগেই স্বাক্ষর নিয়ে নেয়। এরপর তারা ধারাগুলো, বিশেষ করে ১৮ নং ধারাটি নিজেদের মতো করে পূরণ করে নেয়। এটিও একটি বড় ভুল। এতে ঐ কাবিননামায় বরের স্বাক্ষর করাসত্ত্বেও স্ত্রীকে তালাক গ্রহণের ক্ষমতা অর্পণের বিষয়টি শরিয়তের দৃষ্টিতে অনেক ক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্য হয় না এবং স্ত্রী কর্তৃক ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিয়ে অন্যত্র বিবাহ বসে ঘর-সংসার করা বৈধ হয় না। বরং তা শরিয়তের দৃষ্টিতে জিনা-ব্যভিচার হিসেবে গণ্য হয়। তাই এই ১৮ নং ধারার শর্ত ও তালাক প্রয়োগের ক্ষমতা লেখার সময় বা পরে পাত্রকে অবহিত করেই তার স্বাক্ষর নেওয়া জরুরি। এ বিষয়টির প্রতি গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ্য রাখা উচিত। অবশ্য এক্ষেত্রে সাদা ফরমে স্বাক্ষর করার অর্থ যেহেতু ‘ধারাগুলো পূরণ করার ব্যাপারে কাজীকে অনুমতি প্রদান’, তাই ফিকহের দৃষ্টিতে এ স্বাক্ষর গ্রহণযোগ্য। তবে এটি নিয়ম পরিপš’ী এবং অদূরদর্শিতা। কারণ সেক্ষেত্রে কাজীরা নিজেদের মতো করে ধারাগুলো পূরণ করবে। যা অনেক সময় স্বামী-স্ত্রীর স্বার্থবিরোধী কিংবা সম্মতিহীন হয়ে যেতে পারে। অতএব, এমনটি না করাই কাম্য।
স্বামীকে তালাক দিলাম বলা বা লেখা : উক্ত ধারায় স্বামী কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতাবলে স্ত্রী যখন তালাক গ্রহণ করে, তখন অনেক ক্ষেত্রে তালাকপত্রে বিষয়টি এভাবে লেখা হয়, ‘আমি আমার স্বামী অমুককে তালাক দিলাম’ বা ‘প্রদান করলাম’। এভাবে তালাক দেওয়ার পর অনেক সময় স্ত্রী অন্যত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সংসার করা আরম্ভ করে। এটি একটি মারাত্মক ভুল। কেননা শরিয়তের দৃষ্টিতে তালাক প্রদানের ক্ষমতা কেবল স্বামীর, স্ত্রীর নয়। তবে স্বামীর দেওয়া ক্ষমতাবলে স্ত্রী নিজের ওপর তালাক গ্রহণ করতে পারে; স্বামীকে তালাক দিতে পারে না। এক্ষেত্রে স্ত্রী নিজের ওপর তালাক গ্রহণের পরিবর্তে স্বামীকে মৌখিক বা লিখিতভাবে তালাক দিলে শরিয়তের দৃষ্টিতে তা কার্যকর হয় না। বরং তার স্বামীর সঙ্গে তার বিবাহ বন্ধন পূর্বের মতোই বহাল থাকে।
সুতরাং উক্ত অগ্রহণযোগ্য তালাকের ভিত্তিতে স্ত্রীর জন্য অন্য পুরুষের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া এবং ঐ পুরুষের সঙ্গে একত্রে বসবাস করা সম্পূর্ণ হারাম হবে। অতএব, ১৮ নং ধারায় উল্লিখিত শর্ত যথাযথভাবে পাওয়া গেলে এবং সব দিক বিবেচনায় বি”েছদের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলে স্ত্রী তালাক গ্রহণের কথা এভাবে বলবে বা লিখবে, ‘আমি কাবিননামার ১৮ নং ধারায় স্বামী কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নিজ নফসের ওপর এক তালাকে বায়েন গ্রহণ করলাম।’ ‘অমুককে তালাক দিলাম’ বা ‘ডিভোর্স দিলাম’ এ ধরনের শব্দ বলবে না এবং লিখবেও না। এ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলদের উচিত, উকিল বা তালাক রেজিস্টারদের তালাকপত্র লেখার সময় বিষয়টির প্রতি পূর্ণ খেয়াল রাখা।
তাবেঈ হজরত মানসুর (রহ.) বর্ণনা করেন, এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে বলেছে, ‘তোমার তালাক গ্রহণের ক্ষমতা তোমার হাতে।’ এ কথা শুনে স্ত্রী বললো, ‘আপনি তিন তালাক।’ এ সম্পর্কে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা তাকে বৃষ্টি না দিন (অর্থাৎ তার উদ্দেশ্য সফল না হোক)।’ যদি সে (ঐভাবে না বলে) বলতো, ‘আমি তিন তালাক’, তাহলে যা বলেছে তা-ই হতো।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ৯/৫৮২, আল বাহরুর রায়েক : ৩/৩৪৩, বাদায়েউস সানায়ে : ৩/১৮৭)।
তাই আমাদের দেশের কাবিননামার উক্ত ধারার ভাষ্যটিও সঠিক নয়। কেননা তাতে লেখা আছে, ‘স্বামী স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ করিয়াছে কিনা? করিয়া থাকিলে কি কি শর্তে?’ সম্ভবত এখান থেকেই উক্ত ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, স্বামী স্ত্রীকে তালাক গ্রহণের ক্ষমতা দিলে স্ত্রী স্বামীকেই তালাক দিতে পারে। এখানে কথাটা এভাবে লেখা উচিত ছিলো, ‘স্বামী স্ত্রীকে নিজ নফসের ওপর তালাক গ্রহণের ক্ষমতা অপর্ণ করিয়াছে কিনা?’ অথবা এভাবেও লেখা যেতো, ‘স্বামী স্ত্রীকে তালাক গ্রহণের ক্ষমতা প্রদান করিয়াছে কিনা?’ পারিবারিক আদালতে এ বিষয়টি আমলে নেওয়া উচিত।
উল্লেখ্য, আলোচ্য ক্ষেত্রে কোনো কোনো সাহাবি ও তাবেঈ থেকে এক তালাক কার্যকর হওয়ার কথাও বর্ণিত আছে। যদিও হানাফি মাজহাবের ফতোয়া এর ওপর নয়। কিš‘ সাহাবি ও তাবেঈর উক্ত অভিমতের কারণে সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। তাই কোনো স্ত্রী যদি কাবিননামার ক্ষমতাবলে ভুলভাবে নিজে তালাক গ্রহণ না করে স্বামীকে তালাক দেয়, এরপর তারা পুনরায় একত্রে ঘর-সংসার করতে চায়, তবে সতর্কতামূলক বিবাহ দোহরানো উচিত।
১৮ নং ধারায় শুধু ‘হ্যাঁ’ শব্দ কিংবা ‘না’ শব্দ লেখা : অনেকে কাবিননামার ১৮ নং ধারায় শুধু ‘হ্যাঁ’ শব্দটি লিখে দেয়। এটাও ভুল। কেননা এতে স্ত্রী নিঃশর্তভাবে তালাক গ্রহণের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়। আর স্ত্রীকে তালাক গ্রহণের ক্ষমতা প্রদান যদিও শর্তযুক্ত বা শর্তহীন দু’ভাবেই হতে পারে; কিš‘ নিঃশর্ত ক্ষমতা প্রদানের ক্ষেত্রে যেহেতু ঝুঁকি রয়েছে, তাই এমনটি করা আদৌ ঠিক নয়। সুতরাং এতে ভারসাম্যপূর্ণ শর্ত যুক্ত করা বাঞ্ছনীয়। আবার অনেক সময় পাত্রপক্ষ শুধু ‘না’ শব্দ লিখে দেয় ও পাত্রীপক্ষ তাতে দ্বিমত পোষণ করে না। বর্তমান ফেতনা-ফাসাদের যুগে এটাও মারাত্মক ভুল। কেননা এতে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর ওপর জুলুম হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
১৮ নং ধারাটি খালি রেখে দেওয়া : নেক ক্ষেত্রে কাবিননামার ১৮ নং ধারাটি পূরণ না করে ফাঁকা রেখে দেওয়া হয়। এটা মোটেও ঠিক নয়। কারণ মুসলিম বিবাহ বি”েছদ আইনে যে ৯টি কারণে বিবাহ বি”েছদের অনুমতির কথা বলা আছে, তার কোনোটি না থাকলে এবং খোলার মাধ্যমেও স্বামীর কাছ থেকে বি”েছদ না পেলে একজন স্ত্রীর পক্ষে বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে কাবিননামার ১৮ নং ধারায় স্বামী যদি স্ত্রীকে তালাক গ্রহণের ক্ষমতা অর্পণ না করে, তাহলে স্ত্রী নিজে তালাক গ্রহণ করতে পারে না। অথচ স্বামীর প্রতারণা বা জুলুমের কারণে স্ত্রীর কখনও তালাক গ্রহণের মাধ্যমে নিজ থেকে বিবাহ বি”েছদ ঘটানোর প্রয়োজন হয়। উক্ত অসুবিধার কথা চিন্তা করেই মূলত কাবিননামায় ১৮ নং ধারাটি সংযোজন করা হয়েছে। যাতে স্ত্রী অপেক্ষাকৃত কম জটিলতায় তালাকে তাফঈযের মাধ্যমে মুক্তি পেতে পারে। এজন্য উক্ত ধারাটি পূরণ করা উচিত। অনেকে এ বিষয়টি সম্পর্কে না জানার কারণেও ধারাটি শূন্য রাখে। তাই কাবিননামা পূরণের সময় কাজীদের অবশ্যই দু’পক্ষকে এই ধারা সম্পর্কে বিশেষভাবে জানানো উচিত।
সুন্নত তরিকায় বিবাহের আগেই কাবিন করে ফেলা : আমাদের সমাজে প্রায়ই দেখা যায়, বিয়ের বহু আগেই অনেকে কাবিন করে রাখে। আবার অনেক সময় সরকারি কাজী বিবাহের মজলিসে ইজাব-কবুল সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই সময় না থাকা বা অন্য কোনো কারণ দেখিয়ে কাবিনের ফরম পূরণ করে ফেলে এবং বর-কনে ও সাক্ষীদের স্বাক্ষর নিয়ে নেয়। এটা নিতান্ত ভুল কাজ। কেননা কাবিননামা হলো, প্রচলিত আইন অনুসারে বিবাহের রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন। তাই শরিয়তের বিধান হলো, কাবিন করতে হলে পূর্বে নিয়মমাফিক বিবাহ সম্পন্ন করতে হবে। তারপর নির্ধারিত কাবিননামার ফরম পূরণ করবে। এ সংক্রান্ত সরকারি আইনও এ কথাই বলে যে, বিবাহের পরে ফরমটি পূরণ করত সংঘটিত বিবাহকে সরকারি রেজিস্টারভুক্ত করবে। কেননা বিবাহই যদি সম্পাদিত না হয়ে থাকে, তাহলে রেজিস্ট্রেশন ও নিবন্ধন কিসের হবে? সুতরাং বিবাহের আগে কাবিন করা একে তো আইনসিদ্ধ নয়, দ্বিতীয়ত এ ক্ষেত্রে আরও কিছু বড় বড় সমস্যা রয়েছে। যেমনÑ কাবিননামার যে ফরমটি পূরণ করতে হয়, তাতে অনেকগুলো ধারা রয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি হলো, কতো তারিখে বিবাহ সম্পাদিত হয়েছে? কোথায় বিবাহ পড়ানো হয়েছে? বিবাহ কে পড়িয়েছেন? বিবাহ পড়ানো ছাড়া কাবিন করা হলে ফরমের এ ধারাগুলোতে মিথ্যা তথ্য লিখতে হয়। কেননা বিবাহ না হওয়ায় বিবাহ সম্পাদনের তারিখ, ¯’ান ও বিবাহ পড়ানেঅলাÑ সবকিছু বানিয়ে লিখতে হবে। এক কথায়, বিবাহের আগে কাবিন করার দ্বারা পাত্র-পাত্রী, সাক্ষী, সনাক্তকারী, সরকারি নিবন্ধক কিংবা কাজীÑ সবাই মিথ্যার আশ্রয় নি”েছ। সবাই মিথ্যা কথার ওপর স্বাক্ষর করছে।
উপরিউক্ত মিথ্যা তথ্য লেখা ছাড়াও বিবাহের আগে কাবিন করার ক্ষেত্রে আরেকটি জটিল সমস্যা হ”েছ, কাবিননামার ১৮ নং ধারা পূরণের মাধ্যমে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে তালাক গ্রহণের ক্ষমতা প্রদান করা। বিবাহের পর যেমনিভাবে স্বামী নিজে স্ত্রীকে তালাক প্রদানের অধিকার লাভ করে, তদ্রুপ স্ত্রীকেও তালাক গ্রহণের অধিকার দিতে পারে। কিš‘ বিবাহের আগে যেহেতু স্বামী নিজেই তালাক প্রদানের অধিকার রাখে না, তাই স্ত্রীকেও সেই অধিকার দিতে পারে না। দিলেও স্ত্রীর জন্য উক্ত অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না। কেননা বিবাহ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত স্বামী তার স্ত্রীর জন্য পরপুরুষ। আর কোনো পরপুরুষ তো পরনারীকে তালাক দিতে পারে না। দিলেও তা অনর্থক ও অগ্রহণযোগ্য বলে গণ্য হয়। অতএব, পাত্র যদি বিবাহের আগে কাবিননামার ফরম পূরণ করত তাতে স্বাক্ষরও করে, তবুও এর দ্বারা বিবাহের পর পাত্রী তালাক গ্রহণের অধিকারপ্রাপ্ত হবে না। এমতাব¯’ায় স্ত্রী যদি সেই অধিকার বলে কোনোদিন নিজের ওপর তালাক গ্রহণ করে, তবে তার তালাক গ্রহণ শরিয়ত মতে শুদ্ধ হবে না। কিš‘ প্রায়ই দেখা যায়, বিবাহের আগে করা কাবিনের ভিত্তিতেই স্ত্রী ডিভোর্স নিয়ে নেয় এবং অন্যত্র বিবাহও করে ফেলে। অথচ তার ডিভোর্স গ্রহণ কার্যকর না হওয়ায় অন্যত্র বিবাহ বসা বৈধ হয় না। এ ক্ষেত্রে ডিভোর্স নেওয়ার পরও সে পূর্বের স্বামীরই স্ত্রী থেকে যায়।
বিবাহের আগে কাবিন করার ক্ষেত্রে আরেকটি বড় মন্দ দিক হলো, অনেকে এই কাবিনকেই বিবাহ মনে করে। ফলে মৌখিকভাবে বিবাহের ইজাব-কবুল না করে শুধু কাবিন করার দ্বারাই বিবাহ সম্পন্ন হয়ে গেছে বলে ধরে নেয়। অথচ স্বাক্ষীদের সামনে মৌখিক বা লিখিত ইজাব-কবুল ছাড়া শুধু কাবিন করার দ্বারা কখনোই বিবাহ সংঘটিত হয় না। ফলে বর-কনের একত্রে থাকাও বৈধ হয় না। এ ছাড়া অনেকে কাবিনকে বিবাহ মনে না করলেও কাবিন করার পর ছেলে-মেয়ের পরস্পর কথাবার্তা, দেখা-সাক্ষাত, একসঙ্গে চলাফেরা ও নির্জনে সময় কাটানো ইত্যাদিকে বৈধ মনে করে। অথচ নিয়মতান্ত্রিক বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার আগে এসবের কোনোটিই বৈধ নয়। তাই সার্বিক দিক বিবেচনায় ইসলামি শরিয়ত ও সরকারি আইন অনুযায়ী বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার পরেই কেবল কাবিননামার ফরম পূরণ করতে হবে, বিবাহের আগে নয়। কখনও যদি বিবাহের আগে ফরম পূরণ করে ফেলা হয়, তবে বরের স্বাক্ষর যেনো বিবাহের আকদ সম্পন্ন হওয়ার পরেই নেওয়া হয়। আর যদি বরের স্বাক্ষরও বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার আগেই নিয়ে নেওয়া হয়, তবে বিবাহের পর অন্তত ১৮ নং ধারাটি সম্পর্কে বরকে অবগত করে তার অনুমোদন ও পুনঃস্বাক্ষর নেওয়া জরুরি।
লেখক : সিনিয়র মুহাদ্দিস : জামিআ তাযকিয়াতুল উম্মাহ, ২৪/৮, পল্লবী, মিরপুর, ঢাকা
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন