শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

সড়কে প্রাণহানি কি কমবে না?

| প্রকাশের সময় : ৭ জুন, ২০২২, ১২:০৬ এএম

গত রোববার সাভারে একটি দূরপাল্লার নৈশকোচ পরমাণু শক্তি কমিশনের একটি স্টাফ বাসকে ধাক্কা দিলে তার চালক ও তিনজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নিহত হন। খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বালিয়াপুর এলাকায় ঢাকাগামী নৈশকোচটি বাম পাশ দিয়ে একটি গাড়িকে ওভারটেক করার সময় প্রথমে রাস্তার পাশে থাকা একটি বাসকে ধাক্কা দেয়। এ সময় নৈশকোচের চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়ি ঘোরানোর সময় একই লেনের একটি গরুবোঝাই ট্রাককে ধাক্কা দিয়ে রোড ডিভাইডার ভেঙ্গে অপর লেনে গিয়ে পড়ে এবং ঢাকা থেকে সাভারগামী পরমাণু শক্তি কমিশনের স্টাফ বাসের সামনে সজোরে আঘাত করে। এতে ঘটনাস্থলেই স্টাফ বাসের চালক মারা যায়। আহতদের হাসপাতালে নেয়ার পর একে একে তিনজনের মৃত্যু হয়। একইদিনে কোরানীগঞ্জের আলীপুর সেতুর কাছে একটি প্রাইভেট কার ও একটি অটোরিকশার মুখোমুখী সংঘর্ষে একজন ঘটনাস্থলেই মারা যায়। প্রাইভেট কার ও অটোর চালক আহত হয়। প্রাইভেট কারের চালক মাতাল হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল বলে জানা গেছে। ওই কেরানীগঞ্জেই একটি লেগুনার সঙ্গে একটি মোটরসাইকেলের ধাক্কা লেগে মোটরসাইকেলআরোহী তিন যুবকের দু’জন নিহত হয়। অপরজন গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছে। একদিনের সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির এই সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে কয়েকটি দিক বিশেষে করে সড়ক দুর্ঘটনার কিছু কারণ সামনে এসে যায়, যা বহুল আলোচিত। প্রথমত, নৈশকোচের চালক বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাচ্ছিল। নিয়ম-কানুনের প্রতিও তার কোনো তোয়াক্কা ছিলনা। বাম পাশ দিয়ে ওভারটেক করার নিয়ম নেই। বেপরোয়া গাড়ি চালানো এবং নিয়ম-কানুন অমান্য করার কারণে চারটি মূল্যবান প্রাণ চলে গেছে। দ্বিতীয়ত, অটো ও প্রাইভেট কারের সংঘর্ষ ও প্রাণহানির জন্য প্রাইভেট কারের মাতাল চালকই দায়ী হতে পারে। মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালানো বারন থাকলেও ওই চালক তা মানেনি। আইনবিধির প্রতি শ্রদ্ধা না থাকাই এর কারণ। তৃতীয়ত, লেগুনা এমনিতেই কোনো কিছু তোয়াক্কা করে না। তাই মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেয়া তার পক্ষে মোটেই অস্বাভাবিক নয়। অন্যদিকে মোটরসাইকেলে তিনজন ওঠার নিয়ম নেই। হেলমেট পরে মোটরসাইকেল চালানো নিয়ম। দু’জন উঠলে প্রত্যকের হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক। ওই তিন যুবকের হেলমেট পরা ছিল কিনা জানা যায়নি। থাকলে এমন মর্মন্তুদ পরিণতি হওয়ার কথা নয়। এখানেও নিয়মকানুন না মানার প্রতিফল মিলেছে।

এমন কোনো দিন নেই যেদিন সড়ক দুর্ঘটনা না ঘটছে। এক থেকে একাধিক এমনকি ১০-১২টা পর্যন্ত দুর্ঘটনার খবরও প্রতিদিন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে দেখা যায়। সাম্প্রতিককালে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা বেড়ে গেছে, যা জনমনে ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। গত ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ৬৮১ জন নিহত হয় বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়। ‘সড়ক দুর্ঘটনায় ১৫ দিনে ৪৪৩ জন নিহত, ৮৬৮ জন আহত’; ‘১০ দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় ২৪৯ জন নিহত’ ইত্যাদি শিরোনামীয় খবরও ইতোপূর্বে প্রকাশিত হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা যে অপ্রতিরোধ্য, বর্ণিত শিরোনামীয় খবরাদি তার সাক্ষ্য দেয়। সড়ক দুর্ঘটনার দিক দিয়ে আমাদের দেশ বিশ্বে শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর অন্যতম। প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনায় যারা হতাহত হচ্ছে, তাদের মধ্যে সব শ্রেণিপেশার মানুষই আছে। বিজ্ঞানী, অধ্যাপক, কবি-সাহিত্যেক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সরকারি কর্মকর্তা, ছাত্র, যুবক, বৃদ্ধ, নারী এবং অতি সাধারণ মানুষও সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। সবার জীবনই গুরুত্বপূর্ণ। তবে কোনো কোনো মানুষের জীবন তুলনামূলকভাবে অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই অধিক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ যখন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় তখন দেশ-ও জাতির যে ক্ষতি হয়, তা অপূরণীয়। অন্যদিকে পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের একটি বড় অংশ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ওই ব্যক্তির অবর্তমানে পুরো পরিবার নিরালম্ব হয়ে পড়ে। পরিবারের সদস্যদের কষ্ট-দুর্ভোগের সীমা থাকে না। আর দুর্ঘটনার শিকার হয়ে যারা পঙ্গু হয়ে যায়, তারা কার্যত পরিবারের বোঝায় পরিণত হয়। দুর্ঘটনায় হতাহতদের পরিবার-পরিজনের খোঁজখবর নেয়ার, সাহায্য করার কেউ নেই। সরকার এ ব্যাপারে নিরব। বেসরকারি কোনো উদ্যোগও নেই। হতাহতদের পরিবার-পরিজনের ক্ষতিপূরণ দেয়ার একটা ব্যবস্থা কাগজ-কলমে আছে বলে শোনা যায়। কিন্তু তার বাস্তবায়ন তেমন একটা দেখা যায় না। প্রশ্ন ওঠে, সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের পরিবার-পরিজন কি এভাবেই অবহেলিত হতে থাকবে।

সড়ক দুর্ঘটনার কারণ কমবেশি সবারই জানা। চালকের দক্ষতা-অভিজ্ঞতার অভাব, বেপরোয়ায় গাড়ি চালানো, আইন-কানুন না মানা, সড়ক সেতুর ত্রুটি, সড়ক-মহাসড়ক দখল, বাজারঘাটের অবস্থিতি, সড়কব্যবস্থাপনা ও পরিবহনব্যবস্থাপনা না থাকা, সড়ক-মহাসড়কে ধীরগতির যান বা থ্রি হুইলারের অবাধ চলাচল, মোটরসাইকেলের অধিক্য ইত্যাদির সঙ্গে ট্রাফিক শৃংখলার অনুপস্থিতি দুর্ঘটনার জন্য প্রধানত দায়ী। কীভাবে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমানো যায়, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা অনেক পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু এই পরামর্শ যাদের শোনার কথা, কার্যকর করার কথা, তাদের এদিকে নজর নেই। উচ্চ আদালত সড়ক-মহাসড়কে ধীরগতির যান বিশেষ করে, থ্রি হুইলারের চলাচল বন্ধ করার নির্দেশনা দিলেও সে নির্দেশনা প্রতিপালিত হয়নি। প্রায় সব ক্ষেত্রেই এভাবে আইনবিধি ও নির্দেশনা বেতোয়াক্কা করা হচ্ছে। এমতাবস্থায়, কেমন করে আশা করা যায়, সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমবে? দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি রোধ করতে হলে সড়কে ও পরিবহনে শৃংখলা নিশ্চিত করতে হবে, ট্রাফিক আইন মানা বাধ্যতামূলক করতে হবে, জনসচেতনতা বাড়তে হবে এবং প্রতিটি দুর্ঘটনার তদন্ত, বিচার এবং দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সড়ক-মহাসড়ক ও যানবাহন সংশ্লিষ্ট বহু কর্তৃপক্ষ ও প্রতিষ্ঠান আছে। এসব কর্তৃপক্ষ ও প্রতিষ্ঠানের কাজের সমন্বয় সাধন যেমন করতে হবে, তেমনি তাদের প্রত্যেকের জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করতে হবে। এসব করা সম্ভব হলে আশা করা যায়, সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমবে।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন