চলমান বন্যায় ৫ বিভাগের ২১ জেলায় ৯৩টি উপজেলার ৬৭ হাজার ৬১০টি মৎস্য খামারের মাছ ভেসে গেছে। এর ফলে ক্ষতি হয়েছে ১৬০ কোটি ৪২ লাখ টাকা। তবে ব্যক্তি মালিকানার খামারিদের প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো অনেক বেশি বলে জানা গেছে। এর মধ্যে আরো ৭ জেলার তথ্য পাওয়া যায়নি।
গতকাল সোমবার মৎস্য অধিদফতরের ডিজি খ. মাহবুবুল হক ইনকিলাবকে বলেন, চলতি বন্যায় রোববার পর্যন্ত দেশের ৫টি বিভাগের সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুর, নীলফামারী, লালমনিহাট, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মানিকগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, ফেনী ও চট্টগ্রাম জেলায় বন্যার পানিতে পুকুরের মাস ভেসে গেছে। এর মধ্যে ১৫ জেলায় বন্যার পানিতে ১৬০ কোটি ৪১ লাখ ৯১ হাজার টাকার মাছ পানিতে ভেসে গেছে। এসব বেসরকারি পুকুর মালিকদের মাছ চাষের। তবে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে পুকুরের ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে। এখনো সব উপজেলার তথ্য আমাদের কাছে আসেনি।
মৎস্য অধিদফতরের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, এ বছর মাছ চাষের দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম উৎপাদক হিসেবে আবির্ভুত হয়েছিল। এক দশক আগে, কালচার্ড মাছের পরিমাণ ছিল ১৩ লাখ ৫০ হাজার টন। মৎস্য অধিদফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এটি মোট উৎপাদনের প্রায় ৪৭ শতাংশ। সিলেটে দেশের কালচার্ড মাছের মোট উৎপাদনের ৩ শতাংশ উৎপাদিত হয়। উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদন কার্যক্রম মূলত দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সীমাবদ্ধ। সেখানে খামারিরা মাগুর মাছ ও মিঠা পানির চিংড়ি চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। চলমান বন্যায় ২১ জেলায় মধ্যে সিলেট, সনামগঞ্জ, কুড়িগ্রাম রংপুর, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, নেত্রকোণা এবং ময়মনসিংহ পুকুরের খামারিরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রায় ৩২ হাজার ৮০২ জন খামারি ৫ হাজার ২৫৮ হেক্টর জমিতে কার্পজাতীয় মাছের চাষ করছিলেন। দেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের মৌসুমী বৃষ্টি ও ভারতের মেঘালয় ও আসামের ঢাল থেকে নেমে আসা পানিতে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যায় তাদের আর্থিক লাভের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।
সিলেটে মৎস্য অধিদফতরের বিভাগীয় উপ-পরিচালক ড. মো. মোতালেব হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, এটি একটি প্রাথমিক প্রাক্কলন। খামারিদের প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো অনেক বেশি হবে। কারণ সুনামগঞ্জের প্রায় সব খামারই পানিতে ভেসে গেছে। স্থানীয় খামারিরা এমন এক সময় এ ধরনের ক্ষতির শিকার হলেন, যখন এ অঞ্চলে মাছ চাষ সম্প্রসারিত হচ্ছিল। দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে এবং সঙ্গে বেড়েছে প্রোটিনের চাহিদা। ফলে অনেকেই আশা করছিলেন, এ বর্ধিত চাহিদার সুযোগে বাড়তি লাভ করতে পারবেন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে চাষের মাছে ভালো প্রবৃদ্ধি দেখা যায়। সেই অর্থ বছরের মতো ৪৫ লাখ টন উৎপাদিত মাছের ৫৭ শতাংশই এসেছে কালচার্ড ফিস (চাষের মাছ) থেকে। যেটি প্রোটিনের সাশ্রয়ী উৎস হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
সহকারী পরিচালক মোতালেব হোসেন বলেন, এ অঞ্চলে কার্পের পাশাপাশি তেলাপিয়া ও পাঙ্গাশ মাছের চাষ ইতোমধ্যে প্রচলিত আছে। বন্যার কারণে খামারে সৃষ্ট ক্ষতি একইসঙ্গে খামারি ও ভোক্তা উভয়কেই প্রভাবিত করবে। খামারিদের উচিৎ বন্যার হাত থেকে তাদের মৎস্য খামারকে সুরক্ষিত রাখার জন্য জাল ব্যবহার করা। শীর্ষ পোল্ট্রি ও ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্যারাগন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ম. মশিউর রহমান জানান, সিলেটে তাদের ২টি হ্যাচারি ও ২টি মাছের খামার আছে। আমরা আগে বন্যার পানির প্রবাহকে বাধা দেওয়ার জন্য স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ ফুট বেশি উঁচু একটি বাঁধ তৈরি করেছিলাম। পানির উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা জালগুলোর উচ্চতাও বাড়িয়েছি’।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার সীমান্তবর্তী মোগড়া ইউনিয়নের ছয়ঘরিয়া গ্রামের মাছ চাষি জয়নাল আবেদীন। তার ৭টি পুকুরের মধ্যে ৫টিই তলিয়ে গেছে বন্যার পানিতে। এসব পুকুরে ২০ লাখ টাকা পুঁজি খাটান তিনি। পোনা ছাড়াও বড় মাছ মজুদ ছিল পুকুরগুলোতে। আখাউড়ায় ভেসে গেছে ১০৯ পুকুরের মাছ, ক্ষতি ১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। সম্প্রতি ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে হাওড়া নদীর বাঁধ ভেঙে জয়নালের ১৫ লাখ টাকার মাছ ভেসে গেছে। পুঁজি হারিয়ে এখন দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে তার। পার্শ্ববর্তী মনিয়ন্দ ইউনিয়নের আইড়ল গ্রামের মাছচাষি বাছির মিয়া ১৯টি পুকুরে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ করেন। তার ৬টি পুকুরের মাছ সম্পূর্ণ ভেসে গেছে। এতে তার ৩০ লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হয়েছে।
আখাউড়া পৌর এলাকার দেবগ্রামের বাসিন্দা চাষি মফিজুল ইসলাম। মনিয়ন্দ ইউনিয়নের মিনারকোট, বড়-লৌহঘরসহ বিভিন্ন গ্রামে তার রয়েছে ১৬টি পুকুর। ঢলের পানিতে ভেসে গেছে তার ছোট-বড় ৫টি পুকুরের বিভিন্ন প্রজাতির দেশি-বিদেশি প্রায় ২০ লাখ টাকার মাছ। শুধু জয়নাল আবেদীন, বাছির মিয়া ও মফিজুল ইসলামের পুকুরই নয়, আকস্মিক বন্যার পানিতে এবার এ উপজেলার সীমান্তবর্তী মনিয়ন্দ, মোগড়া ও দক্ষিণ ইউনিয়নের ১০৯টি পুকুর তলিয়ে গেছে।
স্থানীয় উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে বলা হয়, অতিবর্ষণ ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে আখাউড়ায় হাওড়া নদীর বাঁধ ভেঙে ৩টি ইউনিয়নের ১০৯টি পুকুর তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে ৮৭ মেট্রিক টন মাছ ও ৪ লাখ মাছের পোনা। এতে স্থানীয় মৎস্যচাষিদের এক কোটি ২৩ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতির তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।
কুড়িগ্রামের মৎস্যচাষি হাবিবুর রহমান জানান, আকস্মিক বন্যার কারণে তারা এবার আগাম কোনো প্রস্তুতি নিতে পারেননি। বানের পানির স্রোত এতটাই প্রবল ছিল যে, জাল দিয়ে ঘেরাও করেও পুকুরের মাছ আটকানো যায়নি। অনেক পুকুরের পাড়ও ভেঙে গেছে। সব মিলিয়ে সেখানকার অনেক মৎস্যচাষি এখন পুঁজিশূন্য হয়ে পড়েছেন। তার সবকটি পুকুরেই পুরোনো মাছ মজুত ছিল। গত সপ্তাহে জাল ফেলে এসব মাছ ধরে বিক্রি করার কথা ছিল। কিন্তু সব মাছ ভেসে যাওয়ায় তিনি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ অবস্থায় এখন সরকারি সহায়তা না পেলে তাদেরকে পথে বসতে হবে।
স্থানীয় কর্নেল বাজারের মৎস্য খাদ্য ডিলার বাছির ট্রেডার্স-এর স্বত্বাধিকারী মো. বাছির মিয়া বলেন, বাণিজ্যিকভাবে চাষকৃত মৎস্য খামারে মাছের খাদ্য সরবরাহ করতে আমরা বিভিন্ন কোম্পানি থেকে কিনে মাছ চাষিদের কাছে তা বাকিতে বিক্রি করি। মাছ বড় করে বাজারজাত করার পর ওই মাছ বিক্রির টাকা দিয়ে আমাদের পাওনা টাকা পরিশোধ করেন মাছচাষিরা। কিন্তু এবার আকস্মিক বন্যায় মাছ চাষিরাই শুধু ক্ষতিগ্রস্তই হননি, আমরা মাছের খাদ্য সরবরাহকারীরাও একইসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।
আখাউড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা রওনক জাহান ইনকিলাবকে বলেন, উপজেলার মৎস্যচাষিরা আকস্মিক বন্যার কারণে এবার ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছেন। মৎস্যচাষিদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের কাজ এখন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্যচাষিরা সরকারি প্রণোদনার জন্য আবেদন করলে বরাদ্দ সাপেক্ষে তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন