শত বছরের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে এবারের বন্যা। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল উপদ্রুত। সিলেট, সুনামগঞ্জ বিপর্যস্ত। নেত্রকোণা, জামালপুর লণ্ডভণ্ড। কুড়িগ্রামের দিকেও ভয়াবহ বন্যা। দেশের মধ্যাঞ্চলও ধীরে ধীরে প্লাবিত হচ্ছে। সরে যাওয়ার সময় পানি যাবে রাজধানী ও আশপাশের নিচু জায়গা হয়ে। অতীতে এত দীর্ঘ সময় পানি থাকত না। এবারের বন্যা বেশি সময় ধরে প্রলয়ঙ্করীরূপে জানমালের ক্ষতি করছে বেশি। পাহাড়ি ঢল আসাম মেঘালয়ের পর বাংলাদেশের ভাটি ও হাওর অঞ্চল ডুবিয়ে দিয়েছে। বাঁধ ভেঙে ফসল ও বাড়িঘর ডুবে গেছে।
অপরিকল্পিত রাস্তাঘাট, ভরাট, নির্মাণ ইত্যাদি কারণে পানি নামতে দেরি হচ্ছে। বন্যাঞ্চল আকস্মিক ঢলে আক্রান্ত হওয়ায় মানুষ, গবাদি পশু, বাড়িঘর, দোকান ও বিচ্ছিন্ন পাড়া ভেসে গেছে। চারিদিকে পানিবন্দি মানুষ বিচ্ছিন্নতার কষ্টে ভুগছে। সিলেট শহরের বেশির ভাগ এলাকা পানির নিচে। বহু মানুষ যেখানে আশ্রয় নিবে সেসব কেন্দ্রেও পানি।
রাস্তা, বহুতল স্কুল, মাদ্রাসা ও বাঁধের ওপর মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। রান্না খাবারের কোনো ব্যবস্থা নেই। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের। সামাজিক ত্রাণ, শুকনা খাবার ও নিরাপত্তা নিয়ে মানুষ চিন্তিত। দেশের মানুষ অনেকটা বদলে গেছে। আগে এসব বিপর্যয়ে সাধারণ মানুষ যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ত, ইদানীং মানুষের মাঝে তেমনটা দেখা যায় না।
ঢাকাসহ সারা দেশের জনগণ বন্যার্তদের জন্য কিছু সহায়তা দেওয়ার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও হাতের কাছে বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন কাউকে পান না। এ ক্ষেত্রে তাদের মসজিদ মাদ্রাসা, আলেম ওলামা ও ধর্মীয় সংগঠনের কোনো বিকল্প নেই। দুর্গতদের সেবায় এদের ভূমিকাই বিগত সবসময়ের মতো এবারও সেরা। সরকারি ত্রাণ খুবই অপ্রতুল। বিশেষ করে বিপন্নদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী চরম ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করছে।
তবে উপদ্রুত এলাকার জনসংখ্যার তুলনায় সেনা ও নৌবাহিনীর কাজের পরিমাণ সীমিত। ত্রাণের সরবরাহও নিতান্ত স্বল্প। এ অবস্থায় দেশের বিত্তবান ব্যবসায়ী গ্রুপ, শিল্পপতি, সামাজিক সাংস্কৃতিক সেবামূলক সংস্থার ভূমিকা চোখে পড়ছে না। ব্যক্তিগত ও স্থানীয় কিছু উদ্যোগ দেখা গেছে। বিশেষভাবে নজরে পড়ছে দেশের ধর্মীয় সামাজিক সংগঠন, ইসলামী রাজনৈতিক দল, মাদ্রাসা, মসজিদ, আলেম-ওলামা, পীর মাশায়েখ, খানকা ও দরবারের অব্যাহত ত্রাণ তৎপরতা।
বর্তমানে পরিচিত মিডিয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগকে কেমনজানি গোপন করতে চায়। দেশের এক অংশের কষ্ট ও বিপদ অন্য অংশের মানুষকে জানাতে চায় না। এ জায়গায় এগিয়ে এসেছে সোশ্যাল মিডিয়া। এটি বর্তমানে মানুষের তথ্যের বড় মাধ্যম। এবারের বন্যার কঠিন রূপ সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণেই মানুষ জানতে পেরেছে।
দেশের আলেম-ওলামা ও নবীপ্রেমিক জনতা আন্তরিকভাবে নিজেদের সীমিত শক্তি নিয়ে বন্যার্তদের মাঝে পড়ে রয়েছেন। নৌকা, ট্রলার ও লঞ্চ নিয়ে তারা হাওরের বুকে বিচরণ করছেন। বিচ্ছিন্ন ক্ষুধার্ত ও ভেঙেপড়া মানুষকে সান্ত¦না মমতা ও সামান্য খাদ্য ও পানি দিয়ে সঞ্জীবিত রাখছেন।
আলেম-ওলামাদের বিভিন্ন ইমাম খতিব ও পীর মাশায়েখ প্রতিনিধি এবং তাওহীদি জনতা দিন-রাত একাকার করে সৃষ্টির সেবায় অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের যুবক তরুণ, খানকা দরবারের মুরিদ ও ভক্তবাহিনী মানবতার সেবায় মাঠে রয়েছেন। স্থানীয় লোকজনের বিপদে প্রবাসীরা নিজেদের লোকজনের সাহায্য করে যাচ্ছেন।
পানিবন্দি মানুষের মোবাইল ফোনচার্জ করার জন্য বিভিন্ন টিম ব্যবস্থা করছে। বিপজ্জনক স্থানে আটকেপড়া জনগোষ্ঠীকে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার জন্য সিলেটের বহু মাদ্রাসা ও মসজিদ ৫০/১০০ টাকা অনুরোধ পাওয়ামাত্র রিচার্জ পাঠাচ্ছে। এখানে শতকোটি টাকার বাণিজ্য করা মোবাইল অপারেটর ও প্রশাসনের কর্তব্য ছিল মোবাইল কার্যকর রাখার জন্য ব্যাটারি চার্জের ব্যবস্থা এবং নির্দিষ্ট এলাকায় প্রতি নাম্বারে রোজ ২০/৫০ টাকা করে বন্যার কয়েকদিন রিচার্জ দেওয়া। যেটি আলেম-ওলামাদের দায়িত্ব নিয়ে করতে হয়েছে। তারা নিজেদের অতি সীমিত সাধ্য এবং মানবিক সর্বসাধারণের সহযোগিতায় পালন করেছেন। হাদীস শরীফে, তুমি দুনিয়াবাসীর প্রতি দয়া কর আসমানের অধিপতি আল্লাহ তোমাকে দয়া করবেন। -মুসলিম। এ বাণীর ওপর আমল করছেন।
আগামী জুমায় দেশব্যাপী ইমাম খতিব, আলেম-ওলামা, নবীপ্রেমিক জনসাধারণ যদি বন্যার্তদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন তাহলে বিপুল সংখ্যক মানুষ নিজেদের ঘরবাড়িতে ফিরে যাওয়ার এবং বন্যা-উত্তর পুনর্গঠনে সহযোগিতা পেতে পারে। কারো ওপর ভরসা না করে ওলামায়ে কেরাম, পীর মাশায়েখ ও ধর্মপ্রাণ ছাত্রজনতা যেভাবে সামান্য কিছু নিয়ে বিপন্ন মানবতার সেবায় এগিয়ে এসেছেন, জাতিকেও এ প্রেরণাতেই এগিয়ে যেতে হবে। বেশি থাকলে বেশি দিবেন আর কম থাকলে কমই আল্লাহর পথে দিতে হবে।
একবার দু’জন বিপদগ্রস্ত মানুষ আল্লাহর রাসুলের দরবারে এলেন। নবীজী (সা.) উপস্থিত সাহাবীদের বললেন, এদের সাহায্য কর। যারা পারলেন সাহায্য করলেন। এরপর নবী (সা.) আবার আল্লাহর পথে দান করার ফজিলত বর্ণনা করলেন। সাহাবীরা আবারো সাধ্যমত দান করলেন। একটু আগে দান গ্রহণকারী দুই ব্যক্তিও তাদের প্রাপ্ত জিনিস থেকে অর্ধেক দান করে দিলেন। -আল-হাদীস।
যার যা আছে তা থেকেই নিজের বিপর্যস্ত ভাইকে সামান্য অংশ দেওয়া ইসলামের অপার সৌন্দর্য এবং নবী করীম (সা.)-এর আদর্শের অতুলনীয় মানবিক শক্তি। দেশ ও জাতির যে কোনো সঙ্কটে নবীপ্রেমিক মানুষ তাদের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক নেতৃত্বের দিকনির্দেশনায় রাসুল (সা.)-এর এ উত্তম আদর্শ নিয়ে এগিয়ে আসবেন। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এ অনন্য অভ্যাস ও আচরণের বরকতেই নিরাপদ এবং উজ্জ্বল হতে পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন