আল্লাহ আমাদের প্রভু। আমরা তাঁর বান্দা। বান্দা হিসেবে প্রভুর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা আমাদের কর্তব্য। যথাযথভাবে কর্তব্য পালন করতে পারলে দায়মুক্ত হওয়ার আশা করা সহজ। প্রভুর দেয়া বিধানানুসারে সঠিকভাবে স্বীয় কর্তব্য পলন করা আমাদের ক’জনের পক্ষে সম্ভব? হাজারো ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে যায়। থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আল্লাহ ক্ষমাশীল। তিনি ক্ষমা করতে পছন্দ করেন। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী প্রতিটি মুমিনের অন্তরে এই আস্থা রয়েছে যে, আল্লাহ আমার ভুল-ভ্রান্তিগুলো মার্জনা করবেন ইনশাআল্লাহ। এক্ষেত্রে বান্দার জন্য করণীয়- আল্লাহর সাথে ভালোবাসার সম্পর্কটা আরও গভীর করে নেওয়া। এই ভালোবাসার মাধ্যমে বান্দা যদি তার প্রভুর প্রেমাস্পদে পরিণত হতে পারে; তাহলে ওই বান্দার গুনাহ যদি পর্বতসমও হয় তবুও আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন। মুমিন কখনো আল্লাহর রহমত থেকে নৈরাশ হয় না। আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্ক কায়েম করার পূর্বশর্ত হল, সুন্নাতে নববীর অনুসরণ। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন, ‘আপনি বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও তো আমার অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। (সূরা: আলে ইমরান, ৩১)। আল্লাহর সাথে বান্দার গভীর সম্পর্কের জন্য নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ‘ইত্তেবায়ে সুন্নাতে’র বিকল্প নেই। সুন্নাতে নববীর অনুসরণের মাধ্যমে যে বান্দা আল্লাহর প্রেমাষ্পদ হতে পারবে সে তার অন্তরে মাওলার প্রতি এক অসাধারণ আকর্ষণ অনুভব করবে। এই আকর্ষণ প্রকাশ করার জন্য তার অন্তর ব্যাকুল হয়ে উঠবে।
বাইতুল্লাহর মেহমান: পবিত্র নগরী মক্কা ও মদিনা গোটা বিশ্বের মুসলমানদের কাছে পরম মহিমান্বিত তীর্থস্থান। প্রতিবছর হজব্রত পালনার্থে গোটা বিশে^র লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা সমবেত হন। আল্লাহর ঘরের মেহমান হওয়ার মতো এমন বরকতময় সফরের তাওফিক পাওয়া কত বড় সৌভাগ্যের বিষয়। এটা আল্লাহ রব্বুল আলামীনের ‘ইশক ও মুহাব্বতে’র আলামত। বাইতুল্লাহর মুসাফির হওয়ার সৌভাগ্য যাঁদের হয়েছে, তাঁরা যখন হজের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হন, তখন তাদের মনের অবস্থা থাকে ভিন্নরকম। এক অপার্থিব সুখানুভূতি অন্তরকে নাড়া দেয়। বিশেষ করে যারা দীর্ঘ প্রচেষ্টা দোয়া-কান্নাকাটির পরে কাবার মালিকের পক্ষ থেকে ডাক পেয়েছে তাঁর ঘরের মেহমান হওয়ার; তাদের মনের অবস্থা-ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। সত্যিকারার্থে ওই সব আল্লাহপ্রেমিক হজযাত্রীদের অন্তর আল্লাহকে পাওয়ার আশায় অস্থির থাকে। কিন্তু ইহজগতে সরাসরি আল্লাহর কাছে এ প্রেম-ভালোবাসা নিবেদন করা- বান্দার পক্ষে কী করে সম্ভব! আল্লাহপ্রেমিক বান্দাদের মনে সান্ত্বনা দেয়ার উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা’আলা একটি ঘরকে তাঁর প্রতি প্রেম নিবেদনের কেন্দ্র হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এ ঘরের মধ্যে তিনি রেখেছেন অদ্ভূত আকর্ষণ শক্তি। চুম্বক যেমন লৌহজাত বস্তুকে তার প্রতি আকর্ষণ করে, বাইতুল্লাহও তেমনি আল্লাহপ্রেমী সকল মুমিনের অন্তরকে সর্বদা আকৃষ্ট করে। বাইতুল্লাহর প্রেম যার অন্তরে যত বেশি, সে তত অস্থির! কবে কালো গিলাফে মোড়ানো কাবার দর্শনে চক্ষুদ্বয় শীতল হবে। বনের পাখি খাঁচায় বন্দি থাকলে যেমন ছটফট করতে থাকে মুক্তবনে উড়ার জন্য; তদ্রুপ মুমিন মাত্রই অস্থির থাকে বাইতুল্লার পানে ছুটে যেতে। কবি সুন্দর লিখেছেন- ‘আমার যদি থাকতো দু’টি পাখির মতো ডানা/ উড়ে যেতাম দূর আরবে কে করিত মানা।’ দুনিয়াতে আল্লাহ তা’আলাকে চর্মচক্ষু দ্বারা দেখা সম্ভব না। তাই আল্লাহর ঘর বাইতুল্লাহ দেখে বান্দার অস্থির অন্তর সান্ত্বনা লাভ করে। আল্লাহর দিদার লাভ করার সৌভাগ্য অর্জন হবে শুধুমাত্র বেহেশতে। পৃথিবীতে যত মসজিদ আছে সবই আল্লাহর ঘর। প্রতিটি মসজিদের রয়েছে স্বতন্ত্র নাম। বাইতুল্লাাহ এ নামটি শুধুমাত্র কাবা ঘরের সাথে নির্দিষ্ট। এই ঘরকে আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে, এ ঘরের সম্মান বৃদ্ধির জন্য। মজনু লায়লার শহরের অলি-গলি প্রদক্ষিণ করতো। মজনু কখনো লায়লার সাক্ষাত পায়নি। তাতে কি তার প্রেমের কোনো ঘাটতি ছিল? মোটেও না। মজনু লায়লার শহরে গিয়ে তাকে উদ্দেশ্য করে কবিতা আবৃত্তি করতো। শাইখুল হাদিস যাকারিয়া রহ. ফাযায়েলে তাবলিগের মধ্যে লায়লার উদ্দেশ্যে মজনুর আবৃত্তি করা কবিতার দু’টি পঙ্তি উল্লেখ করেছেন। অর্থ: ‘আমি যখন লায়লার শহরের উপর দিয়ে যাই, তখন আমি এ দেয়াল ওই দেয়াল চুম্বন করতে থাকি। বস্তুত শহরের ঘরবাড়ি আমাকে পাগল করেনি; বরং পাগল করেছে আমাকে এ শহরের অধিবাসিনীর প্রেম।’
আল্লাহপ্রেমের পর্যায়ক্রমিক স্তর: মজনু লায়লার প্রেমের সর্বশেষ স্তরে পৌঁছার পর লায়লার শহরে গিয়ে অলি-গলিতে ঘোরাফেরা করত। ঠিক তদ্রুপ দুনিয়াতে ঈমান ও কালিমার দ্বারা বান্দা আল্লাহর মহব্বতের প্রথম স্তর হাসিল করে। তখন বার বার আল্লাহর নাম জপতে মনে চায়। আল্লাহ কুরআনে ইরশাদ করেন, ‘ যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লহর যিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে; জেনে রেখো, আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তর প্রশান্তি লাভ করে।’ সূরা: আর-রা’দ, ২৮। দ্বিতীয় স্তরে নামায, কুরআনের তেলাওয়াত। তৃতীয় স্তরে আল্লাহর ইশক অন্তরে বাড়তে থাকায় খাবার-দাবারও ভালোলাগে না। এ জন্য রয়েছে রমযানে রোযার বিধান। প্রয়োজনে নফল রোযা- প্রত্যেক চন্দ্রমাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখ আইয়্যামে বীজের ও সোমবার, বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক রোযা। নিজ সম্পদ হতে কিছু অংশ দ্বীনের পথে ব্যয় করার স্পৃহা জাগে। এ জন্য আল্লাহ রেখেছেন যাকাত, দান-সদকার ব্যবস্থা। এভাবে আল্লাহর প্রেমসাগরে আবগাহন করতে করতে একসময় আল্লাহ পাকের দর্শন লাভের জন্য মন অস্থির হয়ে উঠে। বান্দার মনের এ আকাঙ্খা পূরণ করার জন্য আল্লাহ রব্বুল আলামীন হজও উমরার হুকুম দিয়েছেন। (চলবে)
লেখক : শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক। ভাইস প্রিন্সিপাল: মদিনা মাদরাসা রায়পুরা, নরসিংদী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন