শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

জিলহজ্ব মাসের ১ম দশ দিনের আমল

মুফতি ইমামুদ্দীন সুলতান | প্রকাশের সময় : ৩০ জুন, ২০২২, ১২:০৫ এএম

আরবী বার মাসের মধ্যে জিলহজ্ব অত্যন্ত গুরুত্ব ও ফজীলতপূর্ণ একটি মাস। বিশেষ করে এ মাসের ১ম দশদিন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাাহ তায়লা পবিত্র কুরআনের সুরা ফাজর এর মধ্যে এমাসের প্রথম দশ রাতের কসম খেয়েছেন।

আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘শপথ ফজর-কালের। এবং দশ রাতের’ -আল ফাজর-১-২
মুফাসসিরীনে কেরামদের মতে উক্ত দশ রাত বলতে জিলহজ্বেও ১ম দশদিন উদ্দেশ্য।

তাছাড়া এ মাসের ১ম দশদিন গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত এ মাসে মুসলিম উম্মার বিশেষ দুটি ইবাদত রয়েছে। কুরবানী এবং হজ্ব।

আট যিলহজ্ব থেকে হজ্বের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু। আট তারিখে মিনা গমন দিয়ে নয় তারিখে আরাফার প্রান্তরে অবস্থান, সূর্যাস্তের পর মাগরিব-ইশা একসাথে আদায় করতঃ মুযদালিফায় রাত্রি যাপন। দশ তারিখ সকাল হওয়ার পর মিনায় গিয়ে শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করে কুরবানী,হলক এবং তাওয়াফ। এরপর এগার,বার এবং সম্ভব হলে তের তারিখ শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করার মাধ্যমে হজের কাজ সম্পন্ন হয়।

অন্যদিকে এই মাসের ১০-১২ তারিখ পুরা মুসলিম উম্মাহ পবিত্র ঈদুল আযহা ও কুরবানির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং তাঁর সান্যিধ্য লাভ করে থাকে। এসব কারণে এ মাসের প্রথম দশক অতিগুরুত্বপূর্ণ।
তাই এমাসের প্রথম দশকের আমল বছরের অন্যান্য দিনের তুলনায় আল্লাহ তায়ালার কাছে অধীক পছন্দনীয় ও ফজীলতপূর্ণ। এক হাদিসে রাসূল সা. এ দশ দিনের গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে জিহাদের চেয়েও এ দিনগুলোর আমলকে ফজীলতপূর্ণ বলেছেন।

ইব্নু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যিলহাজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনের আমলের চেয়ে অন্য কোন দিনের আমলই উত্তম নয়। তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন, জিহাদও কি (উত্তম) নয়? নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ জিহাদও নয়। তবে সে ব্যক্তির কথা ছাড়া যে নিজের জান ও মালের ঝুঁকি নিয়েও জিহাদে যায় এবং কিছুই নিয়ে ফিরে আসে না। [সহিহ বুখারী, হাদিস নং-৯৬৯]

এই দিনগুলোর বিশেষ কিছু আমল: এক. তাকবির ও তাসবিহ পড়া : এই দিনগুলোতে তাকবির (আল্লাহু আকবার), তাহমিদ (আলহামদু লিল্লাহ), তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) ও তাসবিহ (সুবহানল্লাহ) পড়া সুন্নত।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘এ ১০ দিনের নেক আমল করার চেয়ে আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয় ও মহান কোনো আমল নেই। তাই তোমরা এ সময়ে তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবির (আল্লাহু আকবার) ও তাহমিদ (আল-হামদুলিল্লাহ) বেশি বেশি করে পাঠ করো।(মুসনাদে আহমদ-৫৪৪৬)

দুই. দিনে সিয়াম পালন ও রাতে নফল ইবাদত : এই দিনগুলোর বিশেষ একটি আমল হলো দিনের বেলায় সিয়াম পালন করা এবং রাতের বেলায় যথাসম্ভব নফল ইবাদতে মশগুল থাকা। হাদীস শরীফে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দিনগুলোর প্রতিটি রোযাকে পুরো বছরের রোযা এবং এ রাতের ইবাদতকে শবে কদরের ইবাদতের সমতূল্য বলেছেন: আবু বকর ইবনে নাফি আল বাসরী (রাহঃ) ...... আবু হুরায়রা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূল বলেন, এমন কোন দিন নাই যে দিনসমূহের ইবাদত আল্লাহর নিকট যিলহজ্জ মাসের দশ দিনের ইবাদত অপেক্ষা অধিক প্রিয়। এর প্রতিটি দিনের রোযা এক বছরের রোযার সমতুল্য। এর প্রতিটি রাতের ইবাদত লায়লাতুল কাদরের ইবাদতের সমতুল্য। [তিরমিজি-৭৫৮, ইবনে মাজাহ-১৭২৮]

তাই রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দিনগুলোতে রোযা রাখতেন।
মুসাদ্দাদ .... হুনায়দা ইবনে খালিদ তাঁর স্ত্রী হতে এবং তিনি নবী করীম এর কোন এক স্ত্রী হতে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ যিল-হজ্জের প্রথম নয়দিন ও আশুরার দিন রোযা রাখতেন। আর তিনি প্রতি মাসে তিনদিন, মাসের সোম ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখতেন। [আবু দাউদ-২৪২৯]

তিন. আরাফার দিনের রোযার বিশেষ গুরুত্ব দেয়া এবং আল্লাহর কাছে জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাওয়া: এই দশক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার বড় একটি কারণ হলো এই দশকে ইয়াওমে আরাফাহ রয়েছে। যা বছরের গুরুত্ব ও ফজীলতপূর্ণ দিন। এই দিনের ব্যাপারে হাদীস শরীফে পৃথক ফজীলত বর্ণিত হয়েছে।

হযরত কাতাদাহ রা. বলেন: রাসূল সা. ইরশাদ করেন আরাফার দিন (৯ তারিখ) এর একটি রোযার দ্বারা পূর্বের ও পরের এক বছরের গুনাহ মাফ হয়ে যায়। এবং আশুরার রোযার দ্বারাও পূর্ববর্তী এক বছরের গুনাহ মাফ হয়ে যায়। (তিরমিযি- ১/১৫৭ ইসলামিয়া, হাদিস নং-৭৫০, মুসনাদে আহমদ-২২৫৩৫]

তবে আরাফায় অবস্থানকারী হাজিদের জন্য রোজা রাখা মুস্তাহাব নয়। কেননা মহানবী (সা.) আরাফায় অবস্থান করেছিলেন রোজাবিহীন অবস্থায়। এছাড়া ভিন্ন এক বর্ণনায় এসেছে যে, আরাফা তথা ৯ই জিলহজ্জ আল্লাহ তায়ালা বছরের অন্যদিনের তুলনায় অধীক সংখ্যক জাহান্নামীদের মুক্তি দেন।

সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যাব (রহঃ) থেকে বর্ণিতঃ: তিনি বলেন, আয়িশা (রাঃ) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ আরাফাহ্ দিবসের তুলনায় এমন কোন দিন নেই- যেদিন আল্লাহ তা’আলা সর্বাধিক লোককে দোযখের আগুন থেকে মুক্তি দান করেন। আল্লাহ তাআলা নিকটবর্তী হন, অতঃপর বান্দাদের সম্পর্কে মালায়িকার সামনে গৌরব করেন এবং বলেনঃ তারা কী উদ্দেশে সমবেত হয়েছে (বা তারা কী চায়)? [সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-৩১৭৯]

চার:
এছাড়াও এমাসের চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানীর পশু জবাই করা পর্যন্ত কুরবানী আদায়কারীর জন্য বিশেষ একটি আমল রয়েছে। তাহল, উপরোক্ত সময়সীমার মধ্যে নখ, চুল ও শরীরের অবাঞ্ছিত লোম না কাটা। এটি মুস্তাহাব। যে ব্যক্তি এ নিয়ম পালন করবে, হাজীদের সাথে এটুকু সাদৃশ্য গ্রহণ করায় সে সাওয়াবের অধিকারী হবে।

উবাইদুল্লাহ ইবনে মূআয আম্বারী (রাহঃ) ... নবী এর সহধর্মিনী উম্মে সালামা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ বলেছেনঃ যে ব্যক্তির নিকট কুরবানীর পশু আছে সে যেন যিলহজ্জ এর নতুন চাঁদ দেখার পর থেকে কুরবানী করা পর্যন্ত তার চুল ও নখ না কাটে। [সহীহ মুসলিম-৪৯৫৯, আবু দাউদ-২৭৮২]

এক্ষেত্রে নখ,চুল এবং শরীরের অবাঞ্ছিত লোম কাটার সর্বোচ্চ সময়সীমা ৪০ দিন যেন অতিক্রম না হয় তাই চাঁদ ওঠার আগেই এসব পরিষ্কার করে নিবে। আর এ আমলটি উপরোক্ত হাদিসে কুরবানি আদায়কারীর জন্য বলা হলেও অনেকের মতে কুরবানী অনাদায়ীরাও এ আমল করতে পারে। আশা করা যায় তারাও সাওয়াবের অধিকারী হবে।

পাঁচ. ৯ জিলহজ ফজর থেকে ১৩ জিলহজ আছর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরয নামাযের পর তাকবীরে তাশরীক বলা: তাকবিরে তাশরিক নিয়ে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ”তোমরা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহকে স্মরণ করগ্ধ। (সূরা বাকারা: ২০৩) ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, এখানে নির্দিষ্ট দিনগুলো দ্বারা উদ্দেশ্য-তাকবিরে তাশরিক পাঠের দিনসমূহ। ( সহীহ বুখারী, মারিফাতুস সুনানি ওয়াল আছার, হাদিস-১০৮৭২)

ছয়: হজ ও ওমরাহ সম্পাদন করা : হজ ও ওমরাহ এ দুটি হলো এ দশকের সর্বশ্রেষ্ঠ আমল। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘এক ওমরাহ থেকে আরেক ওমরাহ মধ্যবর্তী গুনাহের কাফফারাস্বরূপ আর কবুল হজের প্রতিদান কেবলই জান্নাত।’ (বুখারি, হাদিস:১৭৭৩; মুসলিম, হাদিস:৩৩৫৫)

সাত. সামর্থবান হলে ১০-১২ জিলহজ্জ কুরবানী করা: কুরবানির ফজীলত সম্পর্কে হাদিস শরীফে ইরশাদ হয়েছে... হযরত যায়েদ বিন আরকাম রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, সাহাবায়ে কেরাম রাসূল সা. কে জিজ্ঞেস করলেন ইয়া রাসূল্লাহ! কুরবানি, ইহা কী? তিনি বললেন তোমাদেন পিতা ইবরাহীম আ. এর সুন্নত। সাহাবায়ে কেরাম পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, এতে আমাদের জন্য কী রয়েছে? রাসূল সা. বললেন, প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি পাওয়া যাবে। সাহাবায়ে কেরাম বললেন, ভেঁড়ার পশমের বিনিময়ে? রাসূল সা. বললেন, ভেঁড়ার প্রতিটি পশমের বিনিময়েও একটি করে নেকি পাওয়া যাবে। [ইবনে মাজাহ পৃষ্ঠা-২২৬ ইসলামিয়া, হাদিস নং: ৩১২৭]

অতএব মুসলিম উম্মাহ›র উচিত জিলহজ মাসের প্রথম দশদিনে হাদিসে বর্ণিত আমগুলোর মাধ্যমে আল্লাহর সান্যিধ্য অর্জন করা এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি লাভ করা।

লেখক : মুফতি ও মুহাদ্দিস-জামিয়া ইমদাদিয়া আরাবিয়া শেখেরচর, নরসিংদী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন