রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

আধ্যাত্মিক সাধক হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ(র.)’র জীবন ও কর্ম

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভী | প্রকাশের সময় : ৭ জুলাই, ২০২২, ১২:০৩ এএম

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম জীবনাদর্শ মহান আল্লাহর মনোনীত ধর্ম আল ইসলামের শান্তির বাণী যাঁদের অক্লান্ত ত্যাগ ও শ্রমের বিনিময়ে বিশ্বব্যাপী প্রচারিত, যাঁদের নিরলস কর্মতৎপরতা ও অবিরাম সাধনার বদৌলতে ইসলাম আজ কালোত্তীর্ণ, যুগোপযোগী সার্বজনীন ও বিশ্বজনীন জীবনাদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, তাঁদের মধ্যে আল্লাহর প্রিয় নবী রাসূলগণের অবদান সর্বাগ্রে, প্রিয় নবীর তিরোধানের পর দ্বীন প্রচারের দায়িত্ব অর্পিত হয়, হেদায়তের উজ্জ্বল নক্ষত্র ছাহাবায়ে-কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন বুজুর্গানে-দ্বীন ও আউলিয়ায়ে কামেলীনদের উপর। রাহনুমায়ে শরীয়ত ও তরীক্বত, পেশোয়ারে আহ্লে সুন্নাত, অলীয়ে কামেল হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (র.) সেই সব পুণ্যাত্মা বান্দাদের একজন।

এই মহান ইনসানে কামেল, আধ্যাত্মিক সাধকপুরুষ হযরত আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (র.) পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের হাজারা বিভাগের অন্তর্গত সিরিকোট শেতালু শরীফের সৈয়দ বংশে যুগশ্রেষ্ঠ অলীয়ে কামেল হযরত মাওলানা সৈয়্যদ আহমদ শাহ ছিরিকোটি (র.) এর পবিত্র ঔরশে ১৯১৬ সনে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বুজুর্গ পিতা, শাহসুফী আল্লামা হাফেজ সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি (র.) এর সান্নিধ্যে থেকে ১৯২৭ সালে ১১ বছর বয়সে কুরআন শরীফ হেফজ করেন। অতঃপর সুধীর্ঘ ১৬ বছর হযরত সিরিকোটির প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে বুৎপত্তি অর্জন করেন।

তাফসীর, ফিকহ, উসূল, নাহু, ছরফ, আক্বায়িদ, সাহিত্য, বাগ্মিতা তাসাউফ, মারিফাত তরীক্বত ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে তিনি অসাধারণ পান্ডিত্য অর্জন করেন। এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন এক ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ।

তৎকালীন যুগ শ্রেষ্ঠ আলেম প্রখ্যাত হাদিসবেত্তা ও তাফসীরকার আল্লামা সরদার আহমদ লাইলপুরী (র.) এর সান্নিধ্যে থেকে তাফসীর ও হাদিসশাস্ত্রে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। ১৯৪৩ এর দিকে ২৮ বছর বয়সে তিনি কৃতিত্বের সাথে শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করেন। তিনি যেমন একজন পীরে কামেল, সাধক পুরষ ছিলেন, তেমনি একজন সুবক্তা হিসেবে গ্রামে গঞ্জে শহরে বন্দরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে সফরকালে জলসা মাহফিল ইসলামী সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, সম্মেলন, সমাবেশে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ তাক্বরীর ও ভাষণ গু ছিল অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী। কুরআন হাদিসের আলোকে বিভিন্ন সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম বিষয়াদির উপর তিনি গুরুত্বপূর্ণ তাকরীর করতেন। তাঁর তাকরীর ছিল যুক্তিপূর্ণ, তথ্য নির্ভর, সহজ-সরল, প্রাঞ্জল, হৃদয়গ্রাহী এবং মর্মস্পর্শী। তাঁর নুরানী তাক্বরীর শ্রবনে সমবেত শ্রোতাদের মধ্যে খোদাভীতি ও নবী প্রেমের আলোকধারা উদ্ভাসিত হতো, তাঁর নুরানী ভাষণগুলো খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও জনপ্রিয় ছিল। তাঁর বহু নুরানী তাক্বরীর পুস্তিকাকারে প্রকাশিত হয়েছে এবং বহু প্রদত্ত ভাষণ সংগৃহীত হয়ে প্রকাশের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

ইলমে শরীয়ত অর্জনের পাশাপশি তিনি তরীক্বতের দীক্ষা গ্রহণ করেন, ৪০ বছর বয়সের দিকে আব্বাজান হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি(র.) তাঁর উপর খিলাফতের দায়িত্বভার অর্পন করেন। ইবাদত-বন্দেগী, মুরাকাবা-মুশাহাদা ও রিয়াযত এর মাধ্যমে তিনি সুলুক ও তরীক্বতের বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করেন। তাঁর পিতার তিরোধানের পর ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রত্যেক বছরই তিনি বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) তাশরীফ এনেিেছলেন এবং পরবর্তী ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরই এদেশে শুভাগমন করে মুসলিম জনতাকে হেদায়তের পথে পরিচালিত করছেন। তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে অগণিত লোক সিলসিলায়ে আলীয়া কাদেরীয়ায় অর্šÍভুক্ত হয় । তাঁর অসংখ্য ভক্ত অনুরক্ত আজ পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। তাঁর কর্মের পরিধি শুধু মাতৃভূমিতে সীমাবদ্ধ ছিলনা বরং তাঁর কার্যক্রম বিশাল মহীরূহে পরিণত হয়েছে। যার শাখা প্রশাখা ও পুষ্পরাজির বিস্তৃতিতে দ্বীনের বাগান আজ সুশোভিত ও সুরভিত। এটা একমাত্র তাঁর বেলায়তী শক্তির প্রভাব। পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, বার্মা, আজাদ কাশ্মীর, সৌদি আরব, আরব আমিরাত, ইরাক, লন্ডন , ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকাসহ মুসলিম বিশ্বের অসংখ্য মানুষ তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে সিরাতুল মুস্তাকীম তথা হিদায়তের সঠিক পথে পরিচালিত হয়ে আসছে।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এ মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন একাধারে আলেমেদ্বীন, ইসলামী চিন্তাবিদ, শিক্ষাবিদ, সত্যের প্রচারক, দ্বীনের সেবক, আদর্শ সংগঠক, সফল সংস্কারক সর্বোপরি চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ আলা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান বেরলভী (র.) এর চিন্তাধারার সার্থক রূপকার । উপরন্ত ইসলামের মূলস্রোত ধারা কুরআন, সুন্নাহ, এজমা, কিয়াসের সমষ্টি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতাদর্শভিত্তিক ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, জাতীয় আর্ন্তজাতিক ক্ষেত্রে সুন্নী মতাদর্শের যথার্থ বাস্তবায়ন, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য সাধন, মুসলিম মিল্লাতের ঈমান আক্বিদা সংরক্ষণ ছিল তাঁর স্বপ্ন। এ লক্ষ্য বাস্তাবয়নে তাঁর প্রণীত কর্মসূচী ও গৃহীত পদক্ষেপ সমূহ সুন্নীয়তভিত্তিক কার্যক্রমকে করেছে বেগবান। ইসলামী আদর্শ প্রচারে প্রতিষ্ঠানের অপরিহার্যতার কথা চিন্তা করে তিনি এদেশে প্রতিষ্ঠা করেছেন মসজিদ খানকাহ, মাদরাসা, মক্তব, এতিমখানা, হেফজ খানা ও সমাজ সেবামূলক অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। তাঁর গতিশীল নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিতত দ্বীনি প্রতিষ্ঠান সমূহ সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে জনসাধারণের প্রশংসা অর্জন ও দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে।

১৯২৫ সালে বার্মায় সর্বপ্রথম ‘আনজুমানে শুরায়ে রহমানিয়া’ নামে তাঁর আব্বাজান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত দ্বীনি সংস্থা যা পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ‘আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া’ নামে পরিবতির্ত হয় এবং ১৯৬১ সালে হুজুর ক্বেবলা হযরত তৈয়্যব শাহ(র.) এর উপর এ সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতার দায়িত্ব অর্পিত হয়। (চলবে)

লেখক : অধ্যক্ষ মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী) ,, মধ্য-হালিশহর, বন্দর, চট্টগ্রাম।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন