২৬ বছর পর ২১ জুলাই কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হওয়ার কথা থাকলেও এমপি - চেয়ারম্যানের কিল-ঘুষিতে তা স্থগিত করে দিলেন কেন্দ্রীয় কমিটি। জাতীয় সংসদ ভবনের দ্বিতীয় তলায় এলডি হলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন প্রস্তুতি সভায় এমপি- উপজেলা চেয়ারম্যানের কিল, ঘুষি ও মারামারির রেশ ধরে ওই সিন্ধান্ত নেওয়া হয়।
উপজেলার এলাহাবাদ ইউপি কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করাকে কেন্দ্র করে কমিটির প্রতি এমপির অনাস্থা এবং চেয়ারম্যানের অভিনন্দন। অত:পর ক্ষুব্ধ এমপি চেয়ারম্যানের উপর হঠাৎ চড়াও হয়ে নাকে মুখে উপর্যুপুরি কিল-ঘুষি মারতে মারতে মেঝেতে ফেলে দেয়। চেয়ারম্যানও উঠে এমপির সাথে হাতাহাতি কিল-ঘুষিতে জড়িয়ে পড়েন। পরে বৈঠক ছেড়ে জেলা ও উপজেলার নেতৃবৃন্দ বেড়িয়ে গেলে জেলা সভাপতি ম. রুহুল আমিন তাদের পেছনে এসে সকলকে পুনরায় বৈঠকে সমবেত হওয়ার আহবান জানাতে গেলে ম.রুহুল আমিনের সাথে নেতাদের ধাক্কা ধাক্কি হয়।
রোববার সন্ধ্যায় দৈনিক ইনকিলাবকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন, কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হুমায়ুন কবির।
ওই ঘটনায় শনিবার সন্ধ্যা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চেয়ারম্যান সমর্থক ও এমপি সমর্থকদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনায় একজন এএসপির নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যক পুলিশ উপজেলা সদরে দিনব্যপী টহলে থাকতে দেখা যায়। দোকান-পাঠে লোক সমাগমও খুব কম ছিল। পরিস্থিতি থমথমে দেখা যায়। তবে কোন পক্ষকেই মিছিল মিটিং করতে দেখা যায়নি।
এ বিষয়ে দেবিদ্বার থানার ওসি কমল কৃষ্ণ ধর দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, শনিবার রাতের ঘটনায় কোন পক্ষই রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত মামলা করেনি।
রোববার জেলা সভাপতি ও সাধারন সম্পাদকসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ চট্রগ্রাম বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন এমপির সাথে সৃষ্ট পরিস্থিতি নিয়ে এক জরুরী বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে আগামী ২১ জুলাই অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলন স্থগিত ঘোষণা করে ওইদিনই ঢাকা আওয়ামীলীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সভা ডাকা হয়।
দেবিদ্বার উপজেলা আওয়ামীলীগের আভ্যন্তরীন দ্বন্দ্বে ২৬ বছরেও সম্মেলন করা সম্ভব হয়নি। দেশ স্বাধীনের পর দু’টি পূর্ণাঙ্গ কমিটি এবং মাঝে মাঝে আহবায়ক কমিটি দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে দলটি।
১৯৮৫ সালে দেবিদ্বার নির্বাচনী এলাকার সাবেক প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ও বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি আব্দুল আজিজ খান আলী আশরাফ ভূঁইয়াকে সভাপতি ও এডভোকেট জানে আলমকে সাধারন সম্পাদক করে একটি কমিটি গঠন করে যান। পরবর্ততে ১৯৯১ সালে অধ্যক্ষ এম হুমায়ুন মাহমুদ সভাপতি ও আব্দুল মতিন মূন্সীকে সাধারণ সম্পাদক করে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি ঘোষণা করা হয়। দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালে। তখন আলহাজ¦ জয়নুল আবেদীনকে সভাপতি ও একেএম মনিরুজ্জামান মাষ্টারকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি গঠন করা হয়।
সর্বশেষ গঠিত এই কমিটির ৫১ সদস্যের মধ্যে গত ২৬ বছরে সভাপতি, সহ-সভাপতি, সম্পাদক, সদস্যসহ বিভিন্ন পদের ১৪ জন মারা গেছেন। দুইজন বিএনপিতে যোগদান করেছেন। ১৩ জনকে কেউ চেনেনা (ওরা আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে প্রবাসী ও দেশের অভ্যন্তরে নিরুদ্দেশ রয়েছেন)। ১৫ জন নিস্ক্রীয় এবং ৭জন সক্রিয়-আধা সক্রিয় রয়েছেন।
অবশেষে গত ২৩ মে জাতীয় সংসদ ভবনের দ্বিতীয় তলায় এলডি হলে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মামুন এমপির হস্তক্ষেপে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদকসহ অন্যান্যদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সাংগঠনিক সভায় সম্মেলনের তারিখ চূড়ান্ত করা হয়। অনুষ্ঠিত ওই সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন, কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক মাহবুব উল হানিফ, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার সবুর আহমেদ। এতে সভাপতিত্ব করেন, কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ম. রুহুল আমীন। ওই দিন ২ জুলাই সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে অপর একটি বৈঠকে ২ জুলাই থেকে পরিবর্তন করে ২১ জুলাই সম্মেলনের তারিখ পুনঃনির্ধারণ করা হয়।
গত শনিবার জাতীয় সংসদ ভবনের দ্বিতীয় তলায় এলডি হলে অনুষ্ঠিত সম্মেলন প্রস্তুতি সভায় উপজেলার এলাহাবাদ ইউনিয়নের কমিটি ঘোষণাকে কেন্দ্র করে এমপি রাজী মোহাম্মদ ফখরুল এবং উপজেলা চেয়ারম্যান, কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল কালাম আজাদের মধ্যে অনাকাঙ্খিত মারামারির ঘটনায় রোববার এক জরুরী বৈঠকে দেবিদ্বার উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন স্থগিত ঘোষণা করা হয়।
২০০৮ সালে সাবেক মন্ত্রী, সচিব ও জাতীয় পার্টির ‘নাজিউর রহমান মঞ্জু- এবিএম গোলাম মোস্তফা’ গ্রুপ থেকে এবিএম গোলাম মোস্তফাকে এনে নৌকা প্রতীকে এমপি নির্বাচন করার পর দেবিদ্বার আওয়ামীলীগ ঘুরে দাড়াতে সক্ষম হন, কিন্তু ২০০৯ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মামা-ভাগ্নের আভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব শুরু হয়। মামা সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামীলীগ মনোনীত এমপি এবিএম গোলাম মোস্তফা বনাম ভাগ্নে সাবেক উপ-মন্ত্রী ও এমপি এ,এফ,এম ফখরুল ইসলাম মূন্সীর মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ওই দুই গ্রুপের বাহিরেও কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক রোশন আলী মাষ্টার, কুমিল্লা উত্তর জেলার সাবেক সহ-সভাপতি অধ্যক্ষ এম হুমায়ুন মাহমুদের উপদলে বিভক্ত ছিল।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভাগ্নে জাপার সাবেক উপ-মন্ত্রী ও এমপি এবং আওয়ামীলীগ কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য এ,এফ,এম ফখরুল ইসলাম মূন্সী নৌকা প্রার্থীর বাহিরে নিজ পুত্র রাজী ফখরুলকে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী করেন। সেখান থেকেই দলীয় আভ্যন্তরীন দ্বন্দ¦ শুরু হয়। যা আজও অব্যাহত আছে।
১০ হাজার লোকের উপস্থিতিতে আয়োজিত সম্মেলনকে ঘিরে দেবিদ্বার রেয়াজ উদ্দিন সরকারি মডেল পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের এবিএম গোলাম মোস্তফা ষ্ট্যাডিয়ামে মঞ্চ ও প্যান্ডেল নির্মানের কাজ চলছিল। হঠাৎ সম্মেলন স্থগিতের কারণে রোববার সন্ধ্যা থেকে আবার প্যান্ডেলের সমস্ত আয়োজন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদাররা খুলে নিতে দেখা যায়। সম্মেলন স্থগিত করায় দলীয় নেতা-কর্মী সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে।
দেবিদ্বার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একেএম মনিরুজ্জামান মাষ্টার এমপি’র বরাত দিয়ে দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, গত শনিবার জাতীয় সংসদ ভবনের দ্বিতীয় তলায় এলডি হলে এমপি- চেয়ারম্যনের অনাকাঙ্খীত ঘটনার সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত সম্মেলন স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন