ময়নসিংহের ত্রিশালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত মায়ের পেট ফেটে বের হওয়া হয় ফুটফুটে নবজাতক (মেয়ে শিশু) ভবিষ্যৎ কি হবে? কে নেবে তার মানুষ করার দায়িত্ব? দুর্ঘটনয় নিহত জাহাঙ্গীর আলম ও রত্না দম্পত্তির আরো দুই সন্তান ১০ বছর বয়সী মেয়ে মোছাম্মত জান্নাত আক্তার ও ৭ বছর বয়সী ছেলে মো. এবাদত হোসেন রয়েছে। তাদের কে খাওয়াবে সেটাই অনিশ্চিত। তারা কি শিশুটিকে মানুষ করতে পারবে?
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিহত জাহাঙ্গীরের বাবা মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু ও মা সুফিয়া আক্তার দুইজনই শারীরিক প্রতিবন্ধী। কবর দেয়ার মতো যায়গা না থাকায় দুর্ঘটনায় নিহত ছেলে-ছেলের স্ত্রী ও এক নাতনি সানজিদাকে বাড়ির উঠানেই দাফন করেছেন। তাদের থাকার ঘরটিও ভাঙ্গা টিন আর মাটির তৈরি। দরিদ্র পরিবারে জাহাঙ্গীরই ছিল উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। জাহাঙ্গীর আলমের মামাতো ভাই মোহাম্মদ আল আমিন জানান, এর আগে ১৯৯৫ সালে জাহাঙ্গীরের ছোটভাই ফজলুল হক ও ২০০৪ সালে জাহাঙ্গীরের চাচা শামসুল হক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া শিশুর দাদি শারীরিক প্রতিবন্ধী সুফিয়া আক্তার বলেন, ‘এই সড়ক আমারে শেষ করকে দিছে’। বাচ্ছাটি পেলেও তিনজনকে একসঙ্গে হারিয়ে আরও অসহায় হয়ে পড়েছেন তারা। এখন নবজাতকসহ তিন সন্তানের ভবিষ্যতও অনেকটা অনিশ্চয়তার মুখে।
নবজাতকের বোন মোছাম্মত জান্নাত আক্তার বাবা-মা-বোনকে হারিয়ে স্তব্ধ। তিনি বলেন, ‘মোবাইলে আমার বোনের ছবি দেখেছি। তাকে কোলে নিতে ইচ্ছা করছে। আদর করতে ইচ্ছা করছে। দাদা-দাদি ও আমি মিলে তাকে লালন পালন করবো। ছোট ভাই এবাদত কবরের পাশেই বসে থাকে।’
আল্লাহর অলৌকিক কুদরতে যখন পৃথিবীর আলো দেখলো নবজাতকটি তখনই তার পরিবারের সদস্যদের প্রাণ গেছে সড়কে। দুর্ঘটনায় মৃত মায়ের পেট থেকে জন্ম নেওয়া নবজাতক শিশুটি এখন ময়মনসিংহ চরপাড়া এলাকায় লাবিব হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। হাসপাতালটির মালিক মোহাম্মদ শাহজাহান ও তার স্ত্রীর তত্ত্বাবধায়নে শিশুটি রয়েছে।
মোহাম্মদ শাহজাহান জানান নিহত দিনমজুর জাহাঙ্গীর আলম তার পারিবারিক বন্ধু, তাদের বাড়ি একই এলাকায়। ছোটবেলায় তারা এক সঙ্গে খেলাধূলা করেছেন। এ কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় মায়ের পেট চিরে বের হওয়া নবজাতককে শুরু থেকে তিনিই চিকিৎসার দেখভাল করছেন।
মময়মনসিংহ সিবিএমসিবি হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মো কামরুজ্জামান শিশুটির চিকিৎসা করছেন। তিনি জানান নবজাতকের ডান হাতের হাড় ভেঙ্গে গেছে, তবে এখন বিপদমুক্ত আছে। তিনি বলেন, এ ঘটনায় হাসপাতালে প্রচুর সংবাদমাধ্যম কর্মী ও উৎসুক জনতা ভিড় করছেন ছবি তুলছেন লাইভ করছেন। এতে বাচ্চার জন্য সংকট তৈরি হতে পারে। এতে ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়ছে।
এদিকে গতকাল রোববার দুপুরে সমাজ সেবা অধিদপ্তরের ময়মনসিংহ প্রবেশন অফিসার আসাদুজ্জামান শিশুটির খোঁজ নিতে লাবিব হাসপাতালে যান। তিনি জানিয়েছেন শিশুটির নিরাপত্তা ও চিকিৎসার বিষয়টি তারা নিশ্চিত করছেন। অনেকেই শিশুটির পরিবারের কাছে দত্তক নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, যদি কোনো পরিবার দত্তক দেয় তাহলে আইন মেনে সমাজ সেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে দেওয়া হবে। তবে যতটুকু জানতে পেরেছি দত্তক দিতে রাজি নয় তার দাদা দাদি ও চাচারা।
ত্রিশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাইন উদ্দিন জানান ট্রাকটি আটক করা হয়েছে। চালককে খুঁজছে পুলিশ।
উল্লেখ, ৯ মাস গর্ভে থাকা সন্তান কেমন আছে জানতে ত্রিশালের অন্তঃসত্বা রত্না বেগম গত শনিবার যান আল্ট্রাসনোগ্রাম করাতে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ত্রিশাল কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় রাস্তার পাশ দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় ট্রাকচাপায় রত্না, জাহাঙ্গীর ও তাদের মেয়ে সানজিদা মারা যায়। দুর্ঘটনাস্থলেই মৃত মায়ের গর্ভ থেকে বের হয়ে আসে শিশুটি। কান্নার আওয়াজে জীবিত বুঝতে পেরে তাকে উদ্ধার করে প্রথমে ত্রিশাল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পরে ময়মনসিংহ সিবিএমসিবি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এদিকে ত্রিশালে সড়ক দুর্ঘটনাস্থলেই জন্ম নেয়া নবজাতকের অভিভাবকত্ব, ভরণ-পোষণ এবং ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিপূরণের বিষয়ে নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া শিশুর বিষয়টি হাইকোর্টের দৃষ্টিতে এনে এই নির্দেশনা চান সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহসিব হোসাইন। গতকাল রোববার বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী এবং বিচারপতি এসএম মনিরুজ্জামানের ডিভিশন বেঞ্চের নজরে আনেন তিনি। এ বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন সংযুক্ত করে তিনি আদালতের স্বপ্রণোদিত আদেশ প্রার্থনা করেন। এ প্রেক্ষিতে আদালত তাকে বিষয়টি আবেদন আকারে উপস্থাপন করার পরামর্শ দেন।
এদিকে ময়মনসিংহ ব্যুরো চিফ মো. শামসুল আলম খান জানান, ট্রাক চাপায় নিহত অন্ত:সত্ত্বা নারীর জন্ম দেয়া সেই শিশুর দায়িত্ব নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. এনামুল হক। এ সময় তিনি এই শিশুর চিকিৎসার যাবতীয় দায়িত্ব ও ভবিষ্যতে যেন তার কোন সমস্যা না হয় সেজন্য তার নামে একটি ব্যাংক একাউন্ট করে দেয়া হবে বলেও জানান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন