স্পেনে তাপদাহে ১০ দিনেই মৃত্যু ৫ শতাধিক
ইউরোপের আবহাওয়ার ধীরে ধীরে অবনতি ঘটছে। গোটা ইউরোপের তাপপ্রবাহ ক্রমশ হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। স্পেন, জার্মানি, ইংল্যান্ড, পর্তুগালে আগুনের হলকা। যুক্তরাজ্যে এই প্রথম আবহাওয়ার রেড অ্যালার্ট ঘোষিত হয়েছে। তাপের জেরে নষ্ট হচ্ছে ভ‚-সম্পত্তি, প্রাণিজ সম্পত্তি। যা সংশয়ে ফেলে দিয়েছে অর্থনীতিকেও। ইউরোপের অনেক বাড়ি বা পথঘাটই পুরনো প্রযুক্তিতে তৈরি। এগুলো ভয়ানক তাপের সঙ্গে লড়তে পারছে না। গলে যাচ্ছে রাস্তাঘাট, বেঁকে যাচ্ছে রেললাইন, ফেটে যাচ্ছে বাড়িঘর।
স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেড্রো সাঞ্চেজ গত বুধবার বলেছেন, ১০-দিনের তাপপ্রবাহে স্পেনে ৫০০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। এ পরিসংখ্যান খুবই ভীতিজনক। গত বছরের তুলনায় তাপপ্রবাহ-সম্পর্কিত এ মৃত্যু অনেকটাই বেশি। যদিও এ তথ্যকে এখনই অফিসিয়াল বলে ধরা হচ্ছে না। এটা মোটামুটি একটা অনুমানভিত্তিক পরিসংখ্যান।
ব্রিটেনে তীব্র দাবদাহের কারণে অসুস্থ হয়ে কমপক্ষে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছর দেশটির বিগত প্রায় সাড়ে ৩০০ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বুধবার লন্ডন ফায়ার ব্রিগেড তাদের সবচেয়ে ব্যস্ততম দিনটি পার করেছে। তীব্র তাপমাত্রার কারণে লন্ডনের বেশ কয়েকটি দালানে আগুন লেগে গিয়েছিল। ঘটেছে বিস্ফোরণের ঘটনাও। এমনকি লন্ডনের রেললাইনের পাশের ঘাসেও আগুন লেগে রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
গত কয়েক দিন থেকেই দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলোতে প্রচÐ গরম ও দাবানলের পর এখন মধ্য ও উত্তর ইউরোপের দেশগুলোতেও দাবদাহের প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে।
জার্মানির একটি পত্রিকা ‘এ গ্রীষ্মে ইউরোপে আগুন’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন ছেপেছে। বলেছে, দক্ষিণ ইউরোপে ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, ক্রোয়েশিয়া, পর্তুগাল, গ্রিসের বনভ‚মিতে দাবানল চলছে। এতে যে পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে তা পুনরুদ্ধার করতে কয়েক বছর সময় লাগবে। দাবানলের জেরে এসব দেশের কৃষিকাজ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বনভ‚মিতে অগ্নিকাÐের কারণে বহু মানুষকে বাড়িঘর ছাড়তে হয়েছে।
২০৬০ সাল পর্যন্ত থাকবে তাপদাহ –জাতিসংঘ : ইউরোপের বিভিন্ন দেশে দাবানল ছড়িয়ে পড়ায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটছে। কেবল স্পেন আর পর্তুগালেই এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে এক হাজার ৭০০ জনেরও বেশি মানুষের। অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যে গরম সইতে না পেরে সমুদ্রে নেমে মৃত্যু হয়েছে ৫ জনের। এ অবস্থায় জাতিসংঘ সতর্ক করেছে, তাপদাহের এমন প্রবণতা ২০৬০ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। ব্যাপক তাপদাহে ৭ থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত পর্তুগালে ১ হাজার ৬৩ জন মারা গেছেন বলে গত মঙ্গলবার রয়টার্সকে জানিয়েছেন দেশটির স্বাস্থ্য মহাপরিচালক। স্পেনের কার্লোস থ্রি ইনস্টিটিউটের মতে, গত সপ্তাহ তথা ১০ থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত দেশটিতে মৃত্যু হয়েছে ৬৭৮ জনের। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে, মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যাও নির্ণয় করা যাচ্ছে না। এ দুই দেশে এ অবস্থা আগামী সপ্তাহ বা তারও বেশি সময় ধরে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যে সর্বকালের উচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড ভাঙছে। এ অবস্থায় জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড মেটিওরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশনের প্রধান পেটেরি তালাস জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বায়ুমÐলে বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড ছাড়ছে- এমন দেশগুলোর জন্য বর্তমান তাপদাহটি সতর্ক বার্তা। যদি কার্বন নির্গমন বন্ধ করা না হয়, তাহলে বিশ্বকে এর চ‚ড়ান্ত মুহ‚র্তটি দেখতে হতে পারে। দাবানল অব্যাহত থাকলেও এক দিনের ব্যবধানে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সে তাপমাত্রা নেমে এসেছে অর্ধেকে। এরই মধ্যে ফ্রান্সের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ভয়াবহ দাবানল নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করেছে। ফ্রান্সে মঙ্গলবার রেকর্ড করা ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা থেকে নেমে বুধবার ২০ ডিগ্রিতে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যের তাপমাত্রাও অনেকটাই কমেছে, যা গত মঙ্গলবার ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যায়। গ্রিসে রাজধানী এথেন্সের উত্তর-পূর্বে মাউন্ট পেন্টেলিতে প্রায় ৫০০ অগ্নিনির্বাপণ কর্মী দাবানল নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন। এর আগে বড় ধরনের দাবানল ইতালিতেও প্রভাব ফেলেছে। ফলে আজ দেশটিকে সর্বোচ্চ তাপদাহের সতর্কতা জারি করা হয়েছে। তাপদাহ উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হওয়ায় বুধবার জার্মানির কিছু অংশে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এতে পরিবহন চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। সাগর ও নদীতে পানির স্তর কমে যাওয়ায় দেশটির কার্গো জাহাজগুলোতে মালপত্র কম বোঝাই করতে হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
দাবদাহের কবলে গুগল-ওরাকলের ডাটা সেন্টার : এদিকে যুক্তরাজ্যে তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড হয়েছে, দেশটিতে চলছে তীব্র দাবদাহ। আর এ মাত্রাতিরিক্ত গরমের প্রভাব পড়েছে গুগল ক্লাউড ও ওরাকলের ডাটা সার্ভিসের ওপর। সার্ভার ঠাÐা রাখতে না পেরে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল উভয় কোম্পানির ডাটা সেন্টার। এদিন যুক্তরাজ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর এ তাপের ধাক্কা সামলাতে না পেরে ডাটা সেন্টার অপ্রত্যাশিতভাবে বন্ধ হয়ে যায়। আর এ জন্য বাড়তি তাপমাত্রাকেই দুষছে উভয় প্রতিষ্ঠান।
গুগল ক্লাউডের স্ট্যাটাস পেজে কোম্পানিটি জানায়, শীতলীকরণ ব্যর্থতার শিকার হয়েছিল যুক্তরাজ্যে অবস্থিত কোম্পানির ডাটা সেন্টারগুলোর একটি। এতে ওই অঞ্চলে সক্ষমতা আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এতে ভার্চ্যুয়াল মেশিন (ভিএম) বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং আমাদের অল্প সংখ্যক গ্রাহক এর ভুক্তভোগী হয়েছেন। আরো ক্ষয়ক্ষতি রুখতে কিছু কম্পিউটার বন্ধ করে রাখার কথাও বলেছে গুগল। নিজস্ব পেজে একই রকমের বার্তা দিয়েছে অন্য মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানি ওরাকল। ভয়াবহ দাবদাহের কারণে ডাটা সেন্টার বন্ধ রাখতে হয়েছিল বলে জানিয়েছে শীর্ষস্থানীয় সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি। কারিগরি ক্ষয়ক্ষতি রুখতে মঙ্গলবার দিনের শুরুতেই নিজেদের বেশ কয়েকটি সার্ভার বন্ধ করে দিয়েছিল ওরাকল। সূত্র : রয়টার্স, এনডিটিভি ও বিবিসি নিউজ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন