আখাউড়া-সিলেট মিটারগেজ রেলপথটি ডুয়েলগেজে রূপান্তর করা হচ্ছে। তবে সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ হওয়ায় বিদ্যমান রেলপথের পাশে অস্থায়ী আরেকটি লাইন স্থাপন করতে হবে। আর বিদ্যমান রেলপথ ডুয়েলগেজে রূপান্তরের পর অস্থায়ী লাইনটি তুলে ফেলা হবে। এভাবেই অর্থের অপচয় করা হচ্ছে প্রকল্পটিতে। এতে আখাউড়া-সিলেট রেলপথ ডুয়েলগেজে রূপান্তরে ব্যয় পড়ছে একই ধরনের আরেকটি প্রকল্পের প্রায় ছয়গুণ।
একইভাবে জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডাবল লাইন ডুয়েলগেজ প্রকল্পেও অস্বাভাবিক ব্যয় ধরা হয়েছে। এ রেলপথের দৈর্ঘ্য ১৯৮ দশমিক ২৯ কিলোমিটার। এ রেলপথ নির্মাণের চুক্তিমূল্য ১০ হাজার ৩০২ কোটি টাকা। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ৫১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
চীনের অর্থায়নে আখাউড়া-সিলেট এবং জয়দবেপুর-ঈশ্বরদী রেললাইন স¤প্রসারণ প্রকল্পের ব্যয়কে অস্বাভাবিক বলে চিহ্নিত করে এর ব্যয় উল্লেখযোগ্য হ্রাস করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে রেলপথ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী, আখাউড়া-সিলেট মিটারগেজ রেললাইন ডুয়েলগেজ লাইনে রূপান্তর করার জন্য প্রকল্প থেকে ৩৩৫৪.৩১ কোটি টাকা ব্যয় হ্রাস করতে হবে, যা মোট প্রকল্প ব্যয়ের ২০.৮ শতাংশ। অন্যদিকে, জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডুয়েলগেজ রেললাইনকে ডাবল লাইনে উন্নীত করার জন্য ১,৪৯৫.৫২ কোটি টাকা ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে। যা মোট প্রকল্প ব্যয়ের পরিমাণ ১২.৯১ শতাংশ। রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পটি দুটি একনেকে অনুমোদন হওয়ার আগে থেকেই এগুলোর অস্বাভাবিক ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল।
বাংলাদেশ রেলওয়ের এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত ২৩৯ দশমিক ১৪ কিলোমিটার মিটারগেজ রেলপথ ডুয়েলগেজে রূপান্তরে ব্যয় হবে ১৬ হাজার ১০৪ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। গত বছর এপ্রিলে প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়। জিটুজি ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। দরপত্র ছাড়াই দরকষাকষির মাধ্যমে এ ঠিকাদার চূড়ান্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিমূল্য ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৪৯০ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ৬০ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ ডুয়েলগেজে রূপান্তরে ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বরে চুক্তি করে রেলওয়ে। ভারতের ঋণে (এলওসি) এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ভারতের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কালিন্দী রেল। ৫২ দশমিক ৫৪ কিলোমিটার এ রেলপথ ডুয়েলগেজে রূপান্তরের চুক্তিমূল্য ৫৪৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ১০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ এ প্রকল্পের তুলনায় পাঁচ দশমিক ৮৪ গুণ ব্যয়ে ডুয়েলগেজ করা হবে আখাউড়া-সিলেট রেলপথ।
এ বিষয়ে রেলওয়ের তৎকালীন মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন বলেন, আখাউড়া-সিলেট রেলপথটি পাহাড়ি ও ঢালু। এতে মাটির কাজও বেশ জটিল। আবার বিদ্যমান রেলপথের পাশে অস্থায়ী লাইন (বাইপাস) করে ট্রেন চলাচল চালু রাখতে হবে। এজন্য নতুন করে সব সেতু-কালভার্ট নির্মাণ করতে হবে। পরে ডুয়েলগেজ নতুন রেলপথ নির্মাণ করতে হবে। এরপর অস্থায়ী অংশ তুলে ফেলতে হবে। এসব কারণে ব্যয় অনেক বেশি হবে। যদিও এ বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করেন রেলওয়ের একাধিক সাবেক মহাপরিচালক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, আখাউড়া-সিলেট রেলপথ সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ হওয়ায় অর্থের অপচয় করা হচ্ছে। কারণ অস্থায়ী রেলপথ নির্মাণ করে পরে তুলে ফেলা কখনও যৌক্তিক নয়। বরং আখাউড়া-লাকসাম প্রকল্পের মতো আখাউড়া-সিলেট রুটেও প্রথমে নতুন ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ করে পরে বিদ্যমান মিটারগেজ রেলপথটি ডুয়েলগেজে রূপান্তর করা যেত। এতে ডাবল লাইন নির্মাণে পরবর্তীকালে পৃথক প্রকল্প দরকার হতো না। আবার ব্যয়ও সাশ্রয় হতো।
রেলের তথ্যমতে, আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত বিদ্যমান মিটারগেজ রেলপথটি ডুয়েলগেজ নির্মাণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি ডাবল লাইনও করা হচ্ছে রেলপথটি। এতে সব মিলিয়ে ১৮৪ দশমিক ৬০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ প্রকল্পের চুক্তিমূল্য তিন হাজার ৪৯৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা। অর্থাৎ ডাবল লাইন নির্মাণ ও ডুয়েলগেজে রূপান্তর মিলিয়ে এ প্রকল্পে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ১৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
অন্যদিকে, জয়দেবপুর থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত ডুয়েলগেজ রেলপথটি ডাবল লাইনে উন্নীত করা হবে। এজন্য ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর একটি প্রকল্প অনুমোদন করে সরকার। চীনের অর্থায়নে জিটুজি ভিত্তিতে রেলপথটি নির্মাণ করবে চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। দরপত্র ছাড়াই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। যদিও প্রকল্পটির ব্যয় রেলওয়ের একই ধরনের চলমান অন্যান্য প্রকল্পের চেয়ে অনেক বেশি। সূত্রমতে, জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডাবল লাইন প্রকল্পটির ব্যয় নিয়ে শুরু থেকে আপত্তি ছিল সংশ্লিষ্টদের। প্রকল্পটির ব্যয় খতিয়ে দেখতে কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে একটি কমিটি গঠন করে রেলওয়ে। ওই কমিটি প্রায় ২১৭ কোটি টাকা বেশি ব্যয় চিহ্নিত করে। দোহাজারী-কক্সবাজার ডুয়েলগেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের সঙ্গে তুলনাপূর্বক অতিরিক্ত ব্যয় চিহ্নিত করা হয়।
বাংলাদেশ রেলওয়ের সা¤প্রতিক এক বিশ্লেষণেও জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডাবল লাইন নির্মাণে অত্যধিক ব্যয়ের বিষয়টি উঠে আসে। এতে দেখা যায়, রেলওয়ের চলমান ৫টি ডুয়েলগেজ রেলপথ প্রকল্পের মধ্যে জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডাবল লাইন নির্মাণে ব্যয় সবচেয়ে বেশি। জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডাবল লাইন ডুয়েলগেজ রেলপথের দৈর্ঘ্য ১৯৮ দশমিক ২৯ কিলোমিটার। এ রেলপথ নির্মাণের চুক্তিমূল্য ১০ হাজার ৩০২ কোটি টাকা। এতে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়ছে ৫১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
এর বাইরে জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ হয়ে জামালপুর পর্যন্ত রেলপথেও ডুয়েলগেজ ও ডাবল লাইন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চীনের ঋণে জিটুজি ভিত্তিতে ১৬৬ কিলোমিটার এ প্রকল্পের চুক্তিমূল্য ধরা হয়েছে চার হাজার ৫৮৩ কোটি ২২ লাখ টাকা। অর্থাৎ কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় পড়বে ২৭ কোটি ৬১ লাখ টাকা। ঠিকাদারের সঙ্গে দরকষাকষি চূড়ান্ত হলেও এখনও প্রকল্পটি অনুমোদন হয়নি। এ প্রকল্পেও আখাউড়া-সিলেট ডুয়েলগেজের অর্ধেকের কম ব্যয় পড়বে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, আখাউড়া-সিলেট সিঙ্গেল লাইনে ডুয়েলগেজ প্রকল্পের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন আগেই প্রশ্ন তোলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। গতমাসে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে প্রকল্পটি প্রসঙ্গে ১১টি প্রশ্নের জবাব চাওয়া হয়। এগুলো হলো, বাইপাস (অস্থায়ী) লাইন স্থাপন করে লাইন মেরামত কতটা যৌক্তিক, বাইপাস স্থাপন করতে কতো অর্থের প্রয়োজন হবে, বাইপাসে রেল চলাচল করলে যাত্রীসেবায় সমস্যা সৃষ্টি হবে কি না, বর্তমান মিটারগেজের পাশাপাশি আরেকটি ডুয়েলগেজ লাইন স্থাপনে সমস্যা কোথায়, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ-জামালপুর ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন প্রকল্পের চেয়ে এই প্রকল্পের খরচ দ্বিগুণ হওয়ার কারণ কী, বিদ্যমান মিটারগেজ লাইনটি কবে স্থাপন হয়েছে এবং লাইফটাইম কতো, ডুয়েলগেজ করতে কতো সময় লাগবে এবং ডাবল লাইন করতে কতো সময়ের প্রয়োজন? চীন, ভারত ও বাংলাদেশে প্রতি কিলোমিটার রেললাইন স্থাপনে গড় খরচ কতো প্রভৃতি। এসব প্রশ্নের জবাব পাওয়ার পরই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দুটি প্রকল্প থেকে ব্যয় কমানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে রেলভবন সূত্র জানিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে রেলওয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এ ধরনের নির্দেশনা বিরলই নয়, বরং আমি মনে করি এটাই প্রথম। তিনি বলেন, চীনা অর্থায়নের প্রকল্প হলেই ব্যয় বেশি ধরা হয়-এটা রহস্যজনক। ওই কর্মকর্তা বলেন, অস্বাভাবিক ব্যয়ের প্রকল্প অনুমোদন পায় কিভাবে? একনেকে প্রস্তাব যাওয়ার পর তারা কি করেছে। প্রকল্প অনুমোদনের পর এর ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠে কেন সেটাও ভেবে দেখা দরকার। রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা রেলপথ মন্ত্রণালয়ে পৌঁছলেও এখনও তারা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার সাথে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা করতে পারেন নি। এ বিষয়ে রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামসুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেছেন, রেলপথ মন্ত্রণালয় নির্দেশনা পেয়েছে তবে আমরা তা এখনও পাইনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন