খুলনায় গত কয়েক বছরে স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন নিয়ে অর্থ বাণিজ্য ও স্বজনপ্রীতি এবং মনোনায়ন বঞ্চিত নেতাদের কর্মী সমর্থকদের হামলা-মামলার ঘটনাগুলো এখন বেশ পুরানো হয়ে গেছে। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত অনেক নেতা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়েছেন। বিপুল ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছেন নিজ দলীয় প্রার্থীদের। কোন কোন ইউনিয়ন ও উপজেলায় খোদ এমপিরাও বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়েছেন। এতোদিন দল থেকে তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলকে ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সেই সব বিদ্রোহী প্রার্থী ও তাদের সহায়তাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে খুলনা জেলা আওয়ামী লীগ। আগামী দু’মাসের মধ্যে উপজেলা ও ইউনিয়ন কমিটিগুলোর সম্মেলন শেষেই বহিষ্কার বা দলীয় প্রাথমিক সদস্য পদ বাতিলের মত কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে দল। বিষয়টি নিয়ে দলের ভিতরে চলছে চরম অসন্তোষ। অন্যদিকে, এ অসন্তোষ সহিংসতায় রূপ নিতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা-১ আসনে ননী গোপাল মন্ডল, এরপর ২০১৯-এর পাইকগাছা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে শেখ মনিরুল ইসলাম, ডুমুরিয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান গাজী এজাজ আহমেদ ও তেরখাদা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে শেখ শহীদুল ইসলাম বিদ্রোহী প্রার্থী ও দলীয় শৃঙ্খলা বিরোধী কার্যকলাপের সাথে জড়িত হওয়ায় অভিযোগে বহিষ্কৃত হলেও জেলা শাখায় ঠাই পান। অভিযোগ রয়েছে, ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মোস্তফা সরওয়ারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন খোদ ওই আসনের সংসদ সদস্য বাবু নারায়ন চন্দ্র। বিষয়টি ওই সময় মোস্তফা সরওয়ার একাধিকবার দলের হাইকমান্ডকে অবগতও করেন। নির্বাচনে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী গাজী এজাজ আহমেদ বিজয়ী হন। একইভাবে অন্য উপজেলাগুলোতেও যে সকল দলীয় প্রার্থী হেরেছেন, তাদের বিরোধিতা করার অভিযোগ রয়েছে এলাকার সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে।
ইউপি নির্বাচনে খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার যোগিপোল ইউনিয়নে পরাজিত হন খানজাহান আলী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনিসুর রহমান। যুবলীগের ওই থানার আহ্বায়ক সাজ্জাদুর রহমান লিংকনের কাছে লজ্জাজনক ভোটের ব্যবধানে ইউনিয়নের ৯টি ভোটকেন্দ্রেই তিনি হেরে যান। ওই সময় অভিযোগ ওঠে, বিশেষ সুবিধার বিনিময়ে আনিসুর রহমানকে দলের মনোনায়ন দেয়া হয়েছিল। যদিও পরে বিষয়টি চাপা পড়ে যায়। ২০২১ এর ওই ইউপি নির্বাচনে ৩৪টি ইউনিয়নের মধ্যে ৮টিতেই বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয়েছিল। আর ৪টিতে জিতেছিল স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা জিতেছিল ২১টি ইউপিতে।
এদিকে, দলের একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, তৃণমূল পর্যায়ে শাসক দলকে পুনর্গঠনের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে খুলনা জেলায় ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সম্মেলনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ মাসে জেলা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা ডেকে সম্মেলনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করা হবে। দলীয় সূত্র জানিয়েছে, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী ও তাদের সহায়তাকারীরা দলের পদ পদবী থেকে বঞ্চিত হবেন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে দলকে ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে এটি কেন্দ্রীয় নির্দেশনা। স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা ও পৌরসভা নির্বাচনের পর দলের মধ্যে কিছুটা বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের পছন্দমত প্রার্থীদের জেতানোর জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করা হয়। ইউনিয়ন পর্যায়ে একাধিক শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে নেতারা। ফলশ্রুতিতে ডুমুরিয়া ও দিললিয়ায় ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের বিপর্যয় ঘটে। বটিয়াঘাটা উপজেলার একটি কেন্দ্রে ব্যালটে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর কোন ভোট পাওয়া যায়নি। এসব ঘটনায় তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ইমেজ সঙ্কটে পড়ে।
আগামী বছরের শেষদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনমত পক্ষে আনার জন্য ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে সম্মেলনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রাক প্রস্তুতি হিসেবে খুলনা জেলার ৬৮টি ইউনিয়নে ৬১২টি ওয়ার্ডে ২০০ প্রাথমিক সদস্য নবায়ন, ৫০ জন করে নতুন সদস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সদস্য ফরমও জেলা নেতৃবৃন্দের কাছে এসে পৌঁছেছে। তবে শর্তারোপ করা হয়েছে যুদ্ধাপরাধী পরিবারের সদস্য, ইতিপূর্বে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ছাত্রশিবির, ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত, মাদক ব্যবসায়ী, ভূমিদস্যু, অস্ত্রধারী, সাজাপ্রাপ্তদের শাসকদলের প্রাথমিক সদস্য পদ দেওয়া হবে না। দলের কেন্দ্রীয় নির্দেশনায় বলা হয়েছে, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব নিরসন করতে হবে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক পরিস্থিতি তুলে ধরে সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. সুজিত অধিকারী বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তৃণমূল পর্যায় থেকে দলকে ঢেলে সাজাতে প্রাথমিক সদস্য পদ, ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা শাখার সম্মেলনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। সেপ্টেম্বরে প্রক্রিয়া শুরু হবে। প্রস্তুতি হিসেবে এ মাসে জেলার বর্ধিত সভা আহ্বান করা হচ্ছে। দলকে সুসংগঠিত করতে যা যা করা দরকার, তা আমরা করব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন