তুরস্কে ধর্মীয় পুনর্জাগরণের অগ্রনায়ক ও বিশ্বখ্যাত সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম, শায়খ মাহমুদ আফেন্দি গেলো ২৩ জুন ২০২২ ইন্তেকাল করেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর। ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক মসজিদ আল-ফাতিহের প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হয় তাঁর জানাজার নামাজ। দেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদ, ইসলামিক স্কলার ও সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ জানাজায় অংশ নেন। বিপুলসংখ্যক মানুষের উপস্থিতির কারণে মসজিদ প্রাঙ্গন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে, রাস্তার অলিগলি সব লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। তুরস্কের মাটি ও মানুষের অন্তরে ছিল তাঁর প্রতি অগাধ ভক্তি ও ভালোবাসা। প্রেসিডেন্ট এরদোগান শায়েখের লাশবাহী কফিন কাঁধে বহন করে কবরস্থানে নিয়ে যান। তিনি ছিলেন তার আধ্যাত্মিক গুরু। বিশ্বনন্দিত এই মনীষীর ইন্তেকালে প্রেসিডেন্ট রজব তায়েব এরদোগান তার টুইট বার্তায় বলেন- ‘আমাদের দেশের একজন আধ্যাত্মিক পথপদর্শক মাহমুদ আফেন্দিকে আল্লাহ জান্নাত নসিব করুন। তিনি ইসলামের জন্য আমরণ খেদমত করে গেছেন আমি তার পরিবার, ছাত্র ও ভক্তদের প্রতি ধৈর্যধারণ করার আহ্বান করছি।’ মূলনাম মাহমুদ উসমানোগলু। মুসলিম বিশ্বে তিনি শায়েখ মাহমুদ আফেন্দি নকশন্দি নামে অধিক পরিচিত। তিনি ১৯২৯ সালে তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ ট্রাবজনের মাইকো গ্রামের সম্ভ্রান্ত এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা-মাতা উভয়ে ছিলেন দ্বীনদার, আল্লাহভীরু। পিতা গ্রামের মসজিদে ইমাম ইমামতি করতেন। পেশায় ছিলেন কৃষিজীবি। মসজিদের অবস্থান ছিলো চাষের জমি থেকে বেশ দূরে। তিনি নামাজের সময় হলে মসজিদে উপস্থিত হয়ে যেতেন। অনেক সময় এমন হতো, মসজিদে তিনি ছাড়া আর কোনো মুসল্লি আসবে না, তা জেনেও জমির কাজ ছেড়ে মসজিদে উপস্থিত হতেন এবং আজান দিয়ে একাই নামজ আদায় করতেন। এভাবে আল্লাহর ঘর মসজিদ আবাদ রাখার চেষ্টা করতেন। অনেক কষ্টে টাকা সঞ্চয় করে ১৯৫৫ সালে তিনি হজ আদায় করেন। এর কিছুদিন পর সেখানেই তিনি ইন্তেকাল করেন। মক্কার ‘জান্নাতুল মুআল্লা’ কবরস্থানে তাঁর পিতা মুস্তফা আফেন্দির- পাশে তাঁকে দাফন করা হয়েছে। তাঁর আম্মা ফাতেমা হানিমের ধার্মিকতা পুরো জনপদে প্রসিদ্ধ ছিলো। কথিত আছে, তিনি খুব সতর্ক থাকতেন যেন তার গৃহপালিত কোনো পশু কারো ফসলে মুখ না দেয়। কখনো যদি এমন হতো, তিনি জমির মালিকের কাছে গিয়ে মাফ চাইতেন এবং গাভীর দুধ তাকে দিয়ে দিতেন। এমন মহৎ পিতা-মাতার ঘরে এমন নেককার সন্তান জন্ম হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। মাত্র ছয় বছর বয়সে তিনি পিতার কাছে কোরাআন হিফয করেন। তখন থেকেই তিনি নামাজের পূর্ণ পাবন্দ ছিলেন। তারপর যুগের শ্রেষ্ঠ আলেম শায়খ তুরসুন ফারাযীর সান্নিধ্যে থেকে দ্বীনি শিক্ষা অর্জনে করেন এবং মাত্র ১৬ বছর বয়সে তাঁরই কাছ থেকে ইলমের সনদ হাছিল করেন। পরে শায়খ ফারাযীর কন্যাকে তাঁর কাছে বিবাহ দেন। শায়খ মাহমুদ ১৯৫২ সালে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য বন্দিরমা যান। সেখানে শায়খ আলি হায়দার আফেন্দি-এর সঙ্গে তাঁর আধ্যাত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শায়খ আলি হায়দার আফিন্দি ছিলেন তাঁর যুগে মুসলিম জাহানের শীর্ষস্থানীয় আলেম ও আধ্যাত্মিক পুরুষ। বস্তুত শায়খ আলি হায়দার-এর আধ্যাত্মিক দীক্ষা ও তারবিয়াতই শায়খ মাহমুদ- এর জীবনের মোড় পরিবর্তন করে দেয়। শায়খের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তাঁর সান্নিধ্যে থেকে বিচ্ছিন্ন হননি। ফলে শায়খের পক্ষ হতেও তিনি লাভ করেন গভীর স্নেহ-ভালোবাসা। শায়খের মৃত্যুর পর শুরু হয় তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায়। ইস্তাম্বুল শহরের আলফাতিহ এলাকায় ইসমাঈল আগা মসজিদের ইমাম ও শিক্ষকরূপে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। সেখানে তাঁর থেকে ইলম হাসিলের উদ্দেশে দূর-দূরান্ত থেকে ছাত্ররা সমবেত হতে থাকে। আর তিনি তাদের শিক্ষা-দিক্ষা ও তা’লীম-তরবিয়াতের মহান কাজ নিষ্ঠার সাথে আঞ্জাম দিতেন। এ ছাড়া আমর বিল মা’রূফ ও নাহী আনিল মুনকার- এর দায়ত্ব তিনি সর্বোচ্চ হিম্মত ও সাহসিকতার সঙ্গে পালন করেন। সময়টা ছিল কমিউনিস্ট কামাল আতাতুর্ক ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের চরম উত্থানকাল। হাজার হাজার আলেমকে তখন হত্যা করা হয়েছে। এমন কঠিন দুর্যোগপূর্ণ সময়েও তিনি দাড়ি রাখা ও পর্দা পালন করার উপদেশ দিতেন। ফলে তাঁর এবং তাঁর অনুসারীদের উপর নেমে আসে অত্যাচার ও নির্যাতন-নিপীড়নের ভয়াবহ সব অবস্থা। কামাল আতাতুর্ক যখন তুরস্কের মসজিদগুলো মিউজিয়ামে পরিণত করে। দ্বীনি শিক্ষার পাঠশালা মাদরাসাগুলোর যাবতীয় সম্পদ ক্রোক করে নেই। ধর্মীয় শিক্ষা নিষিদ্ধ করে দেয়। এমন কঠিন সময়ে তিনি কারো পরোয়া না করে, গ্রামে-গঞ্জে দ্বীনি শিক্ষা অব্যাহত রাখেন। এমনকি তাঁকে হত্যা করার জন্য গুপ্ত ঘাতক নিয়োগ করা হয়, কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি নিরাপদ থাকেন। বিভিন্ন শহর, গ্রাম ও জনপদে তিনি দাওয়াতি সফর করতেন এবং মানুষকে আমলের দাওয়াত দিতেন। অন্যায় কাজ থেকে বাধা দিতেন এবং সৎ কাজের আদেশ করতেন। যেখানেই যেতেন, মানুষকে তিনি দ্বীনী মাদরাসা ও মকতব প্রতিষ্ঠার দাওয়াত দিতেন। তাঁর লক্ষ্য ছিলো মুসলমানদের কোনো একটি জনপদও যেন দ্বীনি মাদরাসা ও মকতব থেকে খালি না থাকে। তখনকার সময় এটা যে কী কঠিন ও বিপদসঙ্কুল কাজ ছিলো বর্তমান অবস্থায় কেউ তা যথার্র্থ কল্পনাও করতে পারবে না। তাঁর বড় বৈশিষ্ট্য এই যে শরিয়ত ও তরিকতকে তিনি সমার্থক বলে বিশ^াস করেন। আপন ভক্ত-মুরিদদেরও তিনি এভাবেই গড়ে তুলেছেন। তিনি বলেন, শরিয়ত ছাড়া তাছাউফ এবং তাছাউফ ছাড়া শরিয়ত কোনোটা বিশুদ্ধ পথ নয়। তিনি সবসময় বলে আসছেন, মুরশিদ যদি নিজের জীবনে শরিয়তের পূর্ণ অনুসরণকারী হন তাহলেই তিনি প্রকৃত মুরশিদ; যিনি শরিয়তের পূর্ণ অনুসণ করে চলে না, সে ব্যক্তি মুরশিদ হওয়ার যোগ্য কিছুতেই হতে পারে না। তাঁর শীষ্য আহমদ আলজুব্বালী বলেন, ‘আমাদের শায়খ তাঁর জীবনে ছোট থেকে ছোট কোনো সুন্নত ছেড়ে দিতে আমরা দেখেনি। বড় কোনো সুন্নত তরক করার কথা তো তাঁর সম্পর্কে কল্পনাও করা যায় না। যেমন সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখতেন এবং রমজানে ইতিকাফ করতেন। তিনি পথভোলা মানুষকে ডেকেছেন আল্লাহর পথে, দ্বীনের পথে, সত্য-ন্যায়ের পথে। যে পথটি সরাসরি চলে গেছে আলোর গভীরে। একবার তিনি শুনতে পেলেন, রাজধানী ইস্তাম্বুল থেকে ৯০০ কিলোমিটার দূরের তার এক ছাত্র জনৈক ব্যক্তিকে দাড়ি রাখার কথা বললে; ওই ব্যক্তি বলে উঠ- যদি শায়েখ আফেন্দি নিজে এসে আমাকে অনুরোধ করে, তবেই আমি দাড়ি রাখবো। শায়েখ আফেন্দি রহ. এ কথা শোনে বাসে চড়ে ওই ব্যক্তির বাড়িতে গেলেন। (চলবে)
লেখক: শিক্ষাবিদ, আলেম ও খতিব মদিনা জামে মসজিদ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন