শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

কেন সিফ্ফিন-কেন কারবালা?

নাজির আহমদ জীবন | প্রকাশের সময় : ৪ আগস্ট, ২০২২, ১২:২৭ এএম

পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে দুঃখ জনক, বেদনা দায়ক ও নৃশংস যুদ্ধ হলো - “কারবালায়” ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দের-১০ ই অক্টোবর, ৬১ হিজরীর ১০ই মহররম, শুক্রবার হযরত ইমাম হোসেন (রাঃ) ও পাপিষ্ট এজিদ এর মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধ। পৃথিবীতে বহু যুদ্ধ হয়েছে-হচ্ছে ও হবে, কিন্তু প্রিয় নবীর সাহাবী হয়ে ও তারা যে নিৃশংস ও লজ্জাজনক হত্যাকান্ড সংঘটিত করেছে এর কোন তুলনা চলে না।

আমাদের জানা দরকার এর প্রকৃত ইতিহাস। ইতিহাসের কাল প্রবাহে ‘বনি-কুরাইশ’ দু’টি ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। একটি হাশেমি ও অপরটি উমাইয়া। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নবী করীম (সাঃ) এর আদি পুরুষ হযরত হাশিম থেকেই এ দু’টি গোত্রের মধ্যে জাতি বিদ্বেষের বিষাক্ত ধারা প্রবাহিত হয়ে আসছে। উমাইয়া এবং হাশেমিদের এ দ্ব›দ্ধ চরম আকার নেয় প্রিয় নবীজি হাশেমি বংশে জন্ম নেয়াতে। মুয়াবিয়া ও তার বাপ আবু সূফিয়ান মক্কা বিজয়ের পূর্ব থেকে নবীজির বিরোধিতা করছিল। বদর যুদ্ধে অপমান জনক পরাজয় ও বহু প্রাণহানি এই দুই শত্রুকে আরো নবী বিদ্বেষী করে তুললো। আবু সূফিয়ান, হিন্দা, মুয়াবিয়া, মারওয়ান চক্র বাঘের বিষাক্ত নখ দিয়ে গোপনে আততায়ীর মাধ্যমে নবীজিকে হত্যার চেষ্টা চালায়।

আরবের সব গোত্রকে একত্র করে এবং ইহুদিদের সাথে হাত মিলায়ে নবীজীকে চিরতরে শেষ করার জন্য আবু সূফিয়ান ‘জংগে আহযাব’ করে। আবু জেহেল,, আবু লাহাব; আবু সূফিয়ান প্রমুখ ইসলাম ও মহানবী (সাঃ) এর শত্রুদের মধ্যে জঘন্যতম শত্রু ছিল-আবু সূফিয়ান। আর ঘোরতর শত্রু “ওতবা”। ওই ওতবার মেয়ের নাম ‘হিন্দা’। এই পাপিষ্ট রাক্ষসী ওহুদ যুদ্ধে প্রিয় নবীর চাচা হযরত হামযা (রাঃ) শহীদ হলে পেট চিরে কলিজা বের করে চিবিয়ে খায় এবং হাত ও নাক কেটে নেয় গলার অলঙ্কার পড়বে বলে। প্রিয় নবী (সঃ) ওই পিশাচির মুখ দেখতে চান নাই। ওই কলিজা ভক্ষণ কারীর ছেলে হচ্ছে মুয়াবিয়া। মক্কা বিজয়ের পর উপায় না দেখে এরা ছদ্মবেশে ইসলামে আশ্রয় নেয়। গোপন ইচ্ছা নবী বংশকে শেষ করা। ইসলামকে ধ্বংস করা।

ইসলামে যে ইসলামিক গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাসূল (সাঃ) যা খোলাফায়ে রাশেদিন পর্যন্ত চলে তার পর শুরু হয় রাজতন্ত্র মুয়াবিয়ার মাধ্যমে। সংক্ষিপ্ত ইতিহাস হযরত ওমর (রাঃ) এর সময় মুয়াবিয়া চার বছর দামেষ্কের গভর্ণর ছিলেন। ওমর (রাঃ) কে মুয়াবিয়া বড় ভয় করেতেন। তাই তার শাসনামলে তেমন ব্যতিক্রম করতে সাহস করেন নি। হযরত ওসমান (রাঃ) মুয়াবিয়ার ঘণিষ্ঠ আত্মীয় ও কোমল প্রকৃতির শাসক ছিলেন। সেই সুযোগে মুয়াবিয়া নিজেকে স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে বহু ধন সম্পদ গড়েন ও স্বীয় সমর্থনে ব্যাপক সৈন্য ও জনমত গড়ে তুলেন। উদ্দেশ্য একদিন কেন্দ্রিয় ক্ষমতা গ্রহণ।

হযরত ওসমানের খেলাফত প্রাপ্তির পর যখন হযরত আলী (রাঃ) খলিফা হলেন তখন তার বিরুদ্ধে ব্যাপক সৈন্য ও জনসমর্থন ক্রয়ে তার ক্ষমতা ও ধন সম্পদ ব্যবহার করেন। দীর্ঘদিন সিরিয়ার গভর্ণর থাকার ফলে চতুর ও উচ্চভিলাষি মুয়াবিয়া অত্যন্ত শক্তিশালী গভর্ণরে পরিণত হন। হযরত আলী (রাঃ) এর খেলাফত কালে তিনি বিভিন্ন ওজুহাতে হযরত আলীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেন। কোন রকম মিমাংসায় রাজী হলেন না। তখন খলিফা আলীর জন্য যুদ্ধ করা ওয়াজিব হয়ে পড়ে। উভয় পক্ষ ফোরাত নদীর পশ্চিম তীরে ‘আর রাক্কার’ নিকট ‘সিফ্ফিন’ নামক স্থানে মুখোমুখি হন। মুয়াবিয়ার বাহিনী পূর্বেই ফোরাত নদীর উপর অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে যাতে আলী (রাঃ) এর বাহিনী এক ফোটা পানি ও না পায়। ইয়জিদ কারবালায় তার বাপের এ নিতিই পালন করেছিল। হযরত আলী তখন লোক মারফত জানালেন, “আল্লাহর নেয়ামত পানি থেকে বঞ্চিত করার অধিকার কারও নেই।” মুয়াবিয়া জানালেন, “যুদ্ধে সব কিছুই জায়েজ।” এর পর হযরত ইমাম হোসেন (রাঃ) পিতার নির্দেশে যুদ্ধ করে ফোরাত মুক্ত করলেন।

এরপর প্রকৃত যুদ্ধ শুরু হলো। সিফ্ফানের যুদ্ধের অন্যতম ঘটনা হলো, রাসূল (সাঃ) এর প্রিয় বদলি সাহাবি হযরত আম্মার বিন ইয়াসির (রাঃ) ও মহান রাসূল প্রেমিক হযরত ওয়ায়েশক্বরনী (রাঃ) এর শাহাদত। তখন তাঁর বয়স ছিল একানব্বই বছর। রাসূল প্রেম ও ন্যায় ও সত্যের প্রতি তাঁর গভীর ভালবাসা তাঁকে এ বয়সেও যুদ্ধে টেনে আনে। প্রিয় ভাইরা রাসূল প্রেমে এনারা কোথায় আর আমরা কোথায়?

যুদ্ধে যখন হযরত আলীর বিজয় নিশ্চিত তখন মুয়াবিয়া কুটকৌশলের আশ্রয় নেন। এর পর বাধ্য হয়ে হযরত আলী সন্ধী করেন। এর ফলে সৃষ্টি হলো খারেজী নাম একটি রাজনৈতিক দল যারা সন্ধীতে রাজী ছিল না। তাই এর বেশ কিছুদিন পর হযরত আলী এদের হাতে নামাজ পড়া অবস্থায় মসজিদে শহীদ হলেন। এরপর ইমাম হাসান জনগণের ইচ্ছাতে খলিফা হলেন। কিন্তু মুয়াবিয়া তা মেনে নিল না। তাই কুট কৌশলে বিষ প্রয়োগে উনাকে শহীদ করেন। ন্যায় ও সত্যের ঝান্ডা সম্মোন্নত রাখতে হোসেন এগিয়ে এলেন। ইমাম হাসানের সাথে সম্পাদিত সন্ধি চুক্ষিতে মুয়াবিয়ার পর হোসাইন খিলাফত লাভের শর্ত সুস্পষ্ট ভাবে স্বীকৃত হলেও মুয়াবিয়া এর অবমাননা করে নিজ পুত্র ইয়াজীদকে ৬৭৯ খ্রিষ্টাব্দে উত্তরাধিকারী নিযুক্ত করেন। তাই ইয়াজীদ ইমাম হোসেনকে মেনে নিল না। তিনি মনে করলেন তার পিতা মুয়াবিয়া কর্তৃক তিনি নিয়োজিত খলিফা। কিন্তু এটা ছিল তরবারির বলে ও অন্যায় ভাবে মনোনীত। যার ফলে সৃষ্টি হলো দ্বন্দ্ব যা রূপ নিল যুদ্ধে। কারণ; ইয়াজিদ ছিল একাধারে নিষ্ঠুর ও বিশ্বাস ঘাতক। শাসন ব্যাপারে তিনি ন্যায় অন্যায়ের কোন ধার ধারতেন না। তার সহচরগণ ছিল নীচ ও জঘন্য নোংরা। আমোদ প্রমোদ ছিল তাদের আনন্দের বিষয়।

কারবালা ছিল অপরিহার্য পরিণতি এর কোন বিকল্প পথ ছিল না। সত্য ন্যায়ের সংগ্রামী যোদ্ধা হযরত হোসেন (রাঃ) বাধ্য হয়েই যুদ্ধ করেছিলেন। গণতন্ত্র ও ইসলামকে রক্ষার জন্য। কিন্তু এ জন্য উনাকে এবং উনার পরিবার বর্গকে চরম মূল্য দিতে হলো।

মুয়াবিয়া তার দীর্ঘ ক্ষমতার জীবনে বহু ভুল করেন। তার মধ্যে চারটি হলো ঃ
১. ইসলামের বৈধ খেলাফত হযরত আলী (রাঃ) এর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করা।
২. সিফ্ফিনের যুদ্ধে নিজের অপমান জনক পরাজয় রোধে পবিত্র কোরআন নিয়ে প্রতারণা ও সালিশের নামে ধোকাবাজি করা।

৩. ইমাম হাসানকে কুট কৌশলে ও বলপূর্বক ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা, তারপর ষড়যন্ত্র করে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা।

৪. সে সময়ের ৭০ হাজার মসজিদে জুম্মার খুতবায় নবী (সাঃ) এর পবিত্র বংশধরদের উপর অভিসম্পাত বর্ষণের প্রথা চালু করা ও ব্যক্তি স্বার্থে রাসুল (সাঃ) এর বহু সাহাবী ও রাসূল প্রেমিকদের নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করা।
তাই, হযরত হাসান বসরি (রঃ) অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলে গেছেন যে; মুয়াবিয়ার চারটি কাজের যে কোন একটির কারণে তার ‘আকেবাত’ (পরকাল) যে ধ্বংস হয়ে গেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

আসেন আমরা এ থেকে শিক্ষা নেই। কারণ; সময়টা শেষ জামানা। ইমাম মাহ্দী (আঃ) এর প্রকাশের সময়।
পানি নিয়ে রাজনীতি : “ফিরে এলো আজ সেই মহ্ররম মাহিনা ত্যাগ চাই মর্শিয়া ক্রন্দন চাহিনা।” আরবী নববর্ষের প্রথম মাস হ’ল ‘মহররম’। মহররম অর্থ নিষিদ্ধ বা পবিত্র। অর্থাৎ এ মাসে কোনরূপ যুদ্ধ বিগ্রহ ঝগড়া-ফাসাদ নিষিদ্ধ বা নাজায়েজ। রাসূল (সাঃ) এ মাসে কখনো কাফেরদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হননি। মহররম এর দশ তারিখকে বলা হয় ‘আশুরা’। একক দিন হিসাবে ১০-ই মহররম যত ঐতিহাসিক ও সৃষ্টিগত ঘটনা ঘটেছে অন্য কোন দিনে তা হয় নাই।

হাদীস শরীফে আছে; “রাসূল (সাঃ) এর উম্মতদের গোনাহ মাফের ওয়াদা আল্লাহপাক এ দিনেই করেছিলেন। জিব্রাইল (আঃ) এ দিনে পৃথিবীতে সর্বপ্রথম রহমতের ভান্ডার নিয়ে আসেন, আর আঝোর ধারায় রহমতের বৃষ্টির সূচনা হয়েছিল এ দিনে। এ দিন আল্লাহপাক আরশে আজীমে সমাসীন হন; এ দিনে রাসুল (সাঃ) কে চিরতরে নিষ্পাপ ঘোষনা করা হয়। এ দিন দুনিয়া ধ্বংস প্রাপ্ত হবে।

পৃথিবীতে কোন বড় কাজ, বড় আদর্শের প্রতিষ্ঠা, বড় আত্মত্যাগ ছাড়া সম্ভব নয়। সেদিন কারবালার মরুপ্রান্তরে হযরত ইমাম হোসেন (রাঃ) এর বড় আত্মত্যাগ ও মর্মান্তিক শাহাদতের মধ্য দিয়ে যে কারবালার সূচনা হয়েছে তা আজও থেমে যাই নাই। যুগে যুগে যে কত কারবালা ঘটেছে, কত প্রাণের রক্তে এ মাটির পৃথিবী সিক্ত হয়েছে এর হিসাব করা সম্ভব নয়। (চলবে)

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত হিসাব কর্মকর্তা

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন