বন্দর ও শিল্প নগরী নারায়ণগঞ্জ শহরটি ছোট হলেও এক দশক আগে এক কিলোমিটারের মধ্যেই ৬টি সিনেমা হল ছিল। এর মধ্যে নগরীর দুই নম্বর রেলগেইট এলাকার ‘ডায়মন্ড’ সিনেমা হল এবং মিনাবাজার এলাকার ‘হংস থিয়েটার’ বন্ধ হয়ে বহুতল বাণিজ্যিক ভবনে রূপ লাভ করেছে। বছর তিনেক আগে ভেঙে ফেলা হয় ‘আশা’ ও ‘মাশার’ সিনেমা হল। সেখানে এখন গুদাম। শহরের অদূরে সিদ্ধিরগঞ্জের চারটি সিনেমা হলও বন্ধ হয়ে গেছে। গোদনাইলের ‘বন্ধু’ সিনেমা হলের জায়গায় এখন কমিউনিটি সেন্টার। আদমজীনগরের ‘মুনলাইট’ ও সিদ্ধিরগঞ্জ হাউজিং এলাকার ‘গোধূলি’ সিনেমা হল দুটিও বন্ধ। একই এলাকার ‘রংধনু’ সিনেমা হল ভেঙে এখন খাদ্যগুদাম হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। জালকুড়িতে ‘রাজমহল’চালু থাকলেও সেখানে অশ্লীল সিনেমা প্রদর্শনের অভিযোগ রয়েছে। দর্শক না পেয়ে কয়েক বছর আগে বন্ধ হয়ে গেছে সদর উপজেলার কাশীপুরে ঢাকা-মুন্সিগঞ্জ সড়কের পাশে অবস্থিত ‘সম্রাট’ সিনেমা হল। এটি এখন পোশাক কারখানা। বন্দর উপজেলার ‘রূপালী’ সিনেমা হলের জায়গায় উঠেছে বাণিজ্যিক ভবন। তবে শিল্পনগরী বিসিকের পাশে পঞ্চবটি এলাকায় অবস্থিত ‘বনানী’ সিনেমা হলটি চালু আছে। হলমালিকরা বলেছেন, আয়তনে ছোট হলেও ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে নারায়ণগঞ্জ শহর দেশের অন্যতম ব্যস্ত শহর। রাজধানীর পর অল্পদূরত্বে এতগুলো সিনেমা হল কেবল এই শহরেই ছিল। তখন বাংলা সিনেমারও ছিল সুদিন। নব্বইয়ের দশকেও আগে সিনেমা মুক্তি দেয়া নিয়ে প্রতিযোগিতা হতো। একই সিনেমা চলত একাধিক হলে। গুলশান সিনেমা হলের লাটম্যানের কাজ করেন আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, এক সময় দর্শক সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ত নারায়ণগঞ্জের হলগুলোতে। শহরে সিনেমা হল বেশি থাকায় চলচ্চিত্রের মুক্তি নিয়ে টানাটানি লেগে যেত। সেই স্মৃতি মনে পড়লে এখনও উত্তেজনা কাজ করে। সে সময় মানুষের ভিড় দেখে ভয় পেতাম। টিকেট না পেয়ে দর্শক হল ভাঙচুরও করত। সিনেমা হলে প্লাস্টিকের বোতল কুড়িয়েও দুই-তিনশ’ টাকা আয় করা যেত। আর এখন তিনজন দর্শক দিয়েও সিনেমা চালাতে হচ্ছে। ২০০০ সাল থেকে নারায়ণগঞ্জের সিনেমা হলগুলো দর্শক হারাতে থাকে। এর পেছনে নিম্নমানের সিনেমা, অশ্লীল দৃশ্য প্রদর্শন, পাইরেসি, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতাকে তারা দায়ী করেন। এর ফলে একের পর এক হল বন্ধ হতে শুরু করে। নিউ মেট্রো সিনেমা হল চালু থাকলেও তা চলছে ধুঁকে ধুঁকে। এক সময় এ সিনেমা হলে ২৮ জন কর্মী ছিল। এখন আছেন মাত্র দুজন। তাদেরও বেতন দেওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে বলে জানান ব্যবস্থাপক। প্রায় সময় বিদ্যুৎ বিলও তোলা সম্ভব হয় না। ৩২ বছর গুলশান সিনেমা হলের সঙ্গে যুক্ত আছেন তপন দে। তিনি এখন সিনেমা হলটির ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে। তার বাবাও আমৃত্যু এই হলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দর্শক না পাওয়ার পেছনে বড় কারণ হিসেবে তিনি মানসম্মত সিনেমা তৈরি না হওয়া এবং স্মার্টফোন-ইন্টারনেটের সহজলভ্যতাকে দায়ী করেন। পাশাপাশি দর্শক টানতে হলগুলোর অবকাঠামোর উন্নয়ন প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি। নারায়ণগঞ্জের চিত্রশিল্পী জিয়াউর রহমান বলেন, শুধু ইন্টারনেট না, হলের পরিবেশ এবং ভালো সিনেমাও একটা ব্যাপার। মানুষ শুধু সিনেমা নয়, হলের পরিবেশও উপভোগ করে। অনেক হলেই সাউন্ড সিস্টেম বা স্ক্রিনিং ভালো হচ্ছে না। এসব দিকে উন্নতির পাশাপাশি মানসম্মত সিনেমা উপহার দিলে মানুষ হলে আসবে। পুরনো সিনেমা হলের পাশাপাশি ২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর চলচ্চিত্র উৎসবের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে ৩৫ আসনের ‘সিনোমস্কোপ’ মিনিপ্লেক্স। শহরের ডিআইটিতে আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার ও মিলনায়তনের পরিত্যক্ত পাতাল মেঝেতে সীমিত আসনের আধুনিক একটি সিনেমা হল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন স্থপতি মোহাম্মদ নূরুজ্জামান। তিনি স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতাও। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালিত শীততাপ নিয়ন্ত্রিত মিনিপ্লেক্সটিতে ফোর-কে সিলভারস্ক্রিনের পাশাপাশি সাত দশমিক এক ডলবি ডিজিটাল অডিও সিস্টেম, থ্রি-ডি সিনেমা দেখার ব্যবস্থা রয়েছে। সিনেস্কোপের নির্বাহী পরিচালক রবি বলেন, হলের প্রতি মানুষের টান এখনও আছে। মানুষ যাতে পরিবার নিয়ে সুন্দর একটি পরিবেশে সিনেমা দেখতে পারেন, সেই চিন্তা থেকে সিনেস্কোপের যাত্রা শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, ভালো সিনেমায় ভালো সাড়া পড়ে। গত এক মাসে পরপর তিনটি সিনেমা মুক্তি পাওয়ায় দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়। এর আগেও কয়েকটি সিনেমা ভালো চলেছে। দর্শকদের বড় একটি অংশ নারী। আগেও তেমন ছিল। নারীরা কিন্তু একা আসেন না, দলবেঁধে সিনেমা দেখতে আসেন। যে সিনেমা নারীরা দেখবেন সেই সিনেমাই ব্যবসা-সফল হয়। নারীবান্ধব সিনেমা হলের খুবই অভাব এখন এই শহরে। সিনেস্কোপের উদ্যোক্তা মোহাম্মদ নূরুজ্জামান বলেন, সিনেমার দর্শক আছে। তবে দর্শক সিনেমা হলে না আসার পেছনে কতগুলো কারণ আছে। সিনেমা হলের পরিবেশ, প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে হলমালিকরা চিন্তা করছেন না। সবকিছু থাকার পরও ভালো সিনেমা থাকতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন