সুফী-সাধক, শায়খুত তাফসীর ওয়াল হাদীস, মুফতিয়ে আজম ও মুনাজিরে বেমিছাল, কলম সম্রাট, বর্ষীয়ান বক্তা ও সংগঠক আল্লামা মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী (রহ.)’র সম্পর্কে সামান্য লেখার উদ্দেশ্যে কলম ধরেছি। বিগত ১০ই জুলাই ২০২০ইং এর পর থেকে এ সুমহান ব্যাক্তিত্বকে নিয়ে দেশে বিদেশে বিভিন্ন ভাষায় যথেষ্ঠ লেখা-লেখি, আলোচনা, সভা-সিম্পোজিয়াম, দোয়া-মীলাদ ও ঈসালে সওয়াব মাহফিল হয়েছে এবং হচ্ছে- আলহামদুলিল্লাহ।
বয়সের দূরত্বের কারনে আল্লামা দুবাগী (রহ.)’র সরাসরি শিষ্য হওয়ার মত সৌভাগ্য আমার হয়নি, তবে এসব উচ্চ মাক্বাম সম্পন্ন বুযুর্গদের সামান্য সময়ের ছুহবত শত বছরের সাধনার চেয়ে উত্তম। আমাদের মত যারা সরাসরি তাঁর ছাত্র হতে পারিনি, আমি মনে করি অনুসন্ধিৎসু যে কেউই তাঁর আম (সাধারন) ছাত্রত্ব থেকে মুক্ত নয়। আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী (রহ.)’র দলীল ভিত্তিক ক্ষুরধার লিখনী, কুরআন-হাদীস অনুযায়ী বয়ান এবং তাঁর ঐতিহ্যময় জীবন থেকে আমরা আমাদের চলার পথের পাথেয় সংগ্রহ করতে পারি সদা-সর্বদা অবিরত।
দ্বীনের মুজাহিদ
২রা ফেব্রুয়ারী ১৯২৯ সালে বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী, শাহজালালের পূণ্যভূমি সিলেটের দুবাগ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে যে সুসন্তানের জন্ম হয়, মা-বাবা বুক ভরা প্রত্যাশা নিয়ে সেই সন্তানের নাম রাখেন মুজাহিদ উদ্দীন যার অর্থ দ্বীনের মুজাহিদ। জনক-জননীর এ নামকরন কতটুকু স্বার্থক ও সফল হয়েছে আমরা আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী (রহ.)’র বাস্তব জীবন বিশ্লেষন করে দেখতে পারি। তার আগে মুজাহিদ শব্দটির একটু ব্যাখ্যা জেনে নেই।
মুজাহিদ আরবী শব্দ, কুরআন-হাদীসের পরিভাষায় যিনি নিজেকে দ্বীনের জিহাদে তথা ধর্মের পথে নিয়োজিত রাখেন বিশেষভাবে সশস্ত্র জিহাদে অংশগ্রহন করেন তাকে মুজাহিদ বলা হয়। পবিত্র কুরআন শরীফের সুরা আনকাবুতের শেষ আয়াতে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন: “যারা আমার পথে (আল্লাহর পথে) সাধনায় রত হয়, আমি (আল্লাহ) আমার পথে পথ প্রদর্শন করি। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎ কর্মপরায়নদের সাথে আছেন।“
বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ সমূহে এর ব্যাখ্যায় লিখা হয়েছে, আল্লাহর পথে চলতে গিয়ে যে সব বাধা-বিপত্তি আসে, তা দূর করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করার নাম জিহাদ। অবিশ্বাসী ও বাতিল পন্থীদের পক্ষ থেকে আগত বাধা-বিপত্তি, নফস বা প্রবৃত্তি এবং শয়তানের পক্ষ থেকে আসা সকল ধরনের বিভ্রান্তি এর অন্তর্ভুক্ত । অবশ্য জিহাদের সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হচ্ছে কাফির-মুশরিকদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া।
যারা এরুপ জিহাদ করে, আল্লাহ পাক তাদেরকে সুপথে পরিচালিত করেন। ভালো-মন্দ, হক্ব-বাতিল, সত্য-মিথ্যা এবং উপকার-অপকার এসব বিষয়ে যখন দোদুল্যমান অবস্থার সৃষ্টি হয়, তখন আল্লাহ তায়ালা জিহাদকারীদেরকে সহজ-সরল ও সঠিক-সুগম পথ প্রদর্শন করেন। আর এভাবে সাধনায় রত জিহাদকারীরাই দ্বীনের প্রকৃত মুজাহিদ।
আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী (রহ.)’র ছাত্র জীবন থেকে শুরু করে জীবনের শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত জিন্দেগী বিশ্লেষন করলে আমরা পাই, শিক্ষাজীবন থেকে তিনি ছিলেন মুনাজির, হক্ব বাতিলের দ্বন্ধে বর্ষীয়ান বক্তা এবং কলমী যুদ্ধা। বিশেষভাবে বৃটেনের জমিনে মীলাদ-ক্বিয়াম বিরুধীদের জবাবে তিনি লিখেন দলীল ভিত্তিক মীলাদে বেনজীর, যা শরীয়তের চারটি ভিত্তি- কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও ক্বিয়াছ এর সমন্বয়ে রচিত। বিশেষতঃ মীলাদ অস্বীকারকারীদের শীর্ষস্থানীয় পূর্বসুরীদের মীলাদ অনুষ্ঠান করা ও অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার সঠিক তত্ত্ব এতে তুলে ধরা হয়েছে। যখন কথা উঠলো হজ্জে গেলে মদীনা শরীফ যিয়ারতের প্রয়োজন নেই, তখন তাদের মুখ বন্ধ করার জন্য রচনা করেন এক নজরে হজ্জ ও যিয়ারত। বিভিন্ন বিতর্কিত মাসাঈলের সুস্পষ্ট সমাধানের জন্য রচনা করেন ফাতওয়ায়ে মুজাহিদিয়া। “ কবর যিয়ারত পারে না” এসব ভন্ডামীর জওয়াব এবং কবর যিয়ারতের সঠিক পদ্ধতি ফাতেহা ও কবর জিয়ারতের মাসাঈলে রয়েছে। বিভিন্ন মসজিদ থেকে যখন ফরজ নামাযের পর সম্মিলিত মুনাজাত বন্ধ হওয়ার উপক্রম তখন প্রকাশিত হল-দোয়ার মাহাত্ম্য। ক্বদমবুছিকে “পায়ে ধরে সালাম” নাম দিয়ে শরীয়তে এর কোন ভিত্তি নেই বলে কিছু বক্তা যখন ঝড় তুলেছিল, তখন পাঠকদের হাতে তুলে দিলেন কুরআন-হাদীস ভিত্তিক কদমবুছির তথ্য। এমনিভাবে জানাযার পর দোয়া আছে ইহা প্রমান করেন-জানাযার নামাযের পর দোয়া করা বইতে। শবে বরাত বলে কিছু নেই বলে যখন ঐ রাতে অনেক মসজিদ বন্ধ করে রাখা হতো, তখন সেই মহান লেখক কুরআন-সুন্নাহর আলোকে রচনা করেন শবে বরাতের ফদ্বীলত। কিছুদিন থেকে আমাদের মাঝে একটি নতুন রোগের সৃষ্টি হয়েছে, বিভিন্ন মসজিদে দেখা যায় টুপি ছাড়াই খালি মাথায় অনেকে নামায আদায় করতেছেন, দ্বীনের মুজাহিদ ব্যথিত হয়েছেন দলীল – প্রমান দিয়ে লিখেছেন, টুপি পরা স্ন্নুাত।
এ সবের ভিত্তিতে সন্দেহাতীত ভাবে আমরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি, আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী ( রহঃ ) একজন খালিছ দ্বীনের মুজাহিদ ছিলেন, আর যারা দ্বীনের মুজাহিদ আল্লাহ পাক তাদের সাথী, সুতরাং দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের কোন ভয় কিংবা চিন্তা নেই।
এক পীর
পীর উর্দু শব্দ যার আরবী হচ্ছে ওলী, বহুবচন আওলিয়া। আরবী ভাষায় ওলী অর্থ যথাক্রমে অনুগত, বন্ধু, নিকটবর্তী, উত্তরাধিকারী এবং সাহায্যকারী ইত্যাদি। পবিত্র কুরআন শরীফের সূরা ইউনুসে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন, “মনে রেখো যারা আল্লাহর ওলী, তাঁদের না কোন ভয়-ভীতি আছে, না তাঁরা হবে চিন্তিত। যারা ঈমান এনেছে এবং তাক্বওয়া অর্জন করেছে।”
জামে কেরামতে আওলিয়া কিতাবে উল্লেখ করা হয় “ওলী সেই ব্যাক্তি, যিনি পাপ থেকে বিরত থেকে অনবরত আনুগত্যের সাধনায় রত থাকেন।“ তাফসীরে মাযহারীতে বর্ণনা করা হয়, ওলায়ত শব্দের অর্থ মহব্বত এবং ইশক্ব, আর ইশক্ব হচ্ছে এমন এক আগুন যা মাহবুব ব্যতীত সব কিছুকে ভস্ম করে। যাকে তাসাউফের পরিভাষায় ফানা ফিল্লাহ বলা হয়। সুলতানুল আরিফীন কিতাবে একটি হাদীসে ক্বুদসী লিখা হয়- “যে আমাকে চায়, সে আমাকে পায়, যে আমাকে পায়, সে আমাকে পরিচয় করতে পারে, যে আমাকে পরিচয় করতে পারে, সে আমাকে মহব্বত করে, যে আমাকে মহব্বত করে, সে আমার আশিক হয়ে যায়, যে আমার আশিক হয়ে যায়, আমি তাকে হত্যা করে ফেলি, আমি যাকে হত্যা করে ফেলি, তাঁর ক্ষতিপূরণ দেয়ার দায়িত্ব আমার, আর সেই ক্ষতিপূরণ হচ্ছি আমি স্বয়ং।” (চলবে)
লেখকঃ ইমাম ও খতীব, শাহজালাল জামে মসজিদ, কিথলী, ইংলেন্ড।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন