সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

ই-পাসপোর্টেও দালালচক্র

ফরম পূরণের কম্পিউটারের দোকান ঘিরেই গড়ে উঠেছে চক্র

হাসান-উজ-জামান | প্রকাশের সময় : ১৯ আগস্ট, ২০২২, ১২:০৫ এএম

অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী, আশপাশের কম্পিউটারে কম্পোজের দোকান ও কিছু ফটকা মিলে শক্তিশালী চক্র গড়ে উঠেছে। মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এদের গ্রেফতার করলেও ছাড়া পেয়েই ফের সক্রিয় হয়ে উঠে
ডিজিটালাইজেশনের যুগে বদলেছে পাসপোর্টের ধরন। এখন নাগরিকদের দেয়া হচ্ছেÑ ই-পাসপোর্ট। ২০১০ সাল পর্যন্ত দেয়া হতো হাতে লেখা পাসপোর্ট। ওই পাসপোর্টের মেয়াদ ২০১৫ সাল পর্যন্ত থাকলেও ২০১০ সালেই চালু হয় মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট। অতঃপর ২০২০ সালে বাংলাদেশ ই-পাসপোর্টের যুগে প্রবেশ করে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশে অত্যাধুনিক পদ্ধতির পাসপোর্ট দেয়া হলেও পাসপোর্ট অফিস রয়ে গেছে সেই সেকেলে অবস্থায়। আগের মতোই দালাল বেস্টিত অফিস। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অফিসটিতে দালাল না ধরলে সময়মতো পাসপোর্ট পাওয়া যায় না। আবেদনের পর ঘুরতে ঘুরতে জুতার তলা ক্ষয় করতে হয়। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অফিসটিতে কর্মরত একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে কেন্দ্র করে দালাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে নাগরিকদের জিম্মি করে অর্থ নেয়া হচ্ছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, দালাল না ধরলে পাসপোর্ট পাওয়া দুরূহ। আবেদন করে এবং টাকা জমা দিয়ে মাসের পর মাস ঘুরেও পাসপোর্ট মেলে না। অথচ দালালদের টাকা দিলেই পাসপোর্ট দ্রæতই হাতে চলে আসে।

জানতে চাইলে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আইয়ুব চৌধ‚রী ইনকিলাবকে বলেন, দালাল থাকলে তা পাসপোর্ট অফিসের গেটের বাইরে। সেখানে বাইরের প্রতারকরাই জড়িত। দালালির সঙ্গে অফিসের কেউ জড়িত রয়েছে, এমন প্রমাণ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেব। বাইরের দালালদের বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা সভায় জানিয়েছি। তবে পাসপোর্ট অফিসে আগের মতো বিশৃঙ্খলা নেই। আগে দৈনিক ১০ হাজারের মতো পাসপোর্ট ডেলিভারী হতো। আর এখন হচ্ছে ২৫ হাজার। গলাকাটা পাসপোর্ট এখন আর কেউ করতে পারে না। রোহিঙ্গারা পাসপোর্ট করতে পারছে না। ই-পাসপোর্ট চালু হয়েছে।

দেশের অধিকাংশ জেলায় পাসপোর্টের আঞ্চলিক অফিস থাকলেও ঢাকায় ৩টি অফিস রয়েছে। এর মধ্যে পাসপোর্ট অফিসের কেন্দ্রীয় কার্যালয় হিসেবে ধরা হয় আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিস। এ আগারগাঁওয়ে অনলাইন ফরমপূরণের নামে গড়ে ওঠা কম্পিউটারের দোকানগুলো ঘিরেই গড়ে উঠেছে পাসপোর্ট দালালচক্র। মাত্র পাঁচ দিন কিংবা সাত দিনের মধ্যেই পাসপোর্ট করে দেয়ার নিশ্চয়তা দেয় এ চক্রের সদস্যরা। শুধু তাই নয়, এনআইডি সংক্রান্ত জটিলতাও এরা তিন দিনের মধ্যে সমাধানের নিশ্চয়তা দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে পাসপোর্ট করতে আসা মানুুষজনের টাকা-পয়সা। কোনো ধরনের ঝামেলা নেই এবং স্বল্পসময়ের মধ্যে পাসপোর্ট হাতে তুলে দেয়ার আশ্বাস পেয়ে অনেকেই দালালেরই দ্বারস্ত হন। এমনই অভিযোগ পাসপোর্ট করতে আসা মানুষদের।

শ্রমিক ভিসায় মালয়েশিয়া যাবার উদ্দেশ্যে চলতি বছরের ৩০ মে পাসপোর্টের জন্য নিয়মানুসারে ফরমপূরণ করে ব্যাংকে টাকা জমা দিয়েছিলেন সাব্বির নামে এক যুবক। গত মঙ্গলবার মো. সাব্বির আগারগাঁও এসেছিলেন পাসপোর্ট নিতে। সেখানে চায়ের দোকানে এ প্রতিবেদকের সাথে কথা হয়। মো. সাব্বির জানায়, সাধারণ পাসপোর্টের জন্য তিনি প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ ফরম জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ ভেরিভিকেশনে তার দীর্ঘ সময় লেগে যায়। ৩০ জুন তার পাসপোর্ট হাতে পাবার কথা ছিল। কিন্তু কি সব জটিলতার কথা বলে তাকে পরে আসতে বলা হয়। ১৬ আগষ্ট পাসপোর্ট ডেলিভারীর ক্ষুদে বার্তা পান তিনি।

সাব্বিরের মতো অনেকের সাথেই কথা হয়। অধিকাংশ ভুক্তভোগীর অভিযোগ, নির্ধারিত সময়ের অনেক পরেই তারা পাসপোর্ট হাতে পেয়েছেন। তাদের অভিযোগ, নিয়মানুসারে আবেদন করে মাসের পর মাস অপেক্ষা করেও পাওয়া যায় না পাসপোর্ট। দালালদের দিয়ে পাসপোর্ট আবেদন করালে তুলনামূলক ভোগান্তি কম। পুলিশ ভেরিফিকেশন, জন্মনিবন্ধন সনদ আর সত্যায়িত করার সিল সবই আছে দালালের কাছে। দরকার শুধু টাকা।
পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের লাইনে দাঁড়ানো অনেকের সাথেই কথা হয়। কেউ কেউ দাঁড়িয়েছেন নিজের পাসপোর্ট নিতে। আবার কেউবা স্বজনের পাসপোর্ট পেতে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানদের অনুপস্থিতে পাসপোর্ট পেতে নির্ধারিত অনুমতি ফরম রয়েছে পাশের কম্পিউটার দোকানে। রক্তের সম্পর্কের পাসপোর্ট গ্রহীতার অনুপস্থিতে এরকম কয়েকজনের সাথেও কথা হয় লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে।

এদিকে নিয়ম মেনে পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ফরমপূরণ থেকে শুরু করে পাসপোর্ট ডেলিভারি পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন বাহানায় গুনতে হচ্ছে টাকা। সব কাজ শেষ হওয়ার পরও পাসপোর্ট হাতে পেতেও টাকা লাগে। এদিকে সেবাপ্রত্যাশীদের সারি দীর্ঘ হলেও দালালদের মাধ্যমে ভেতরে প্রবেশের সুযোগ মিলে অনায়াসে। আনসাররাই কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছে দেয়ার সুযোগ করে দেয়। তবে প্রকাশ্যে লাইনের ব্যবসাটি সম্প্রতি আগের তুলনায় অনেকটাই কমেছে বলে জানা গেছে।

নিজেকে নতুন পাসপোর্ট করতে আসা ভুক্তভোগী সেজে কথা বলতেই পাসপোর্ট অফিসের সামনের কম্পিউটার দোকানের প্রায় সকলেই সাহায্যে করতে এগিয়ে এলেন। কেউ বললেন, মাত্র ২১ দিনে পাসপোর্ট করে দিবেন। জরুরিভিত্তিতে হলে কেউবা ১০ দিনে আবার কেউবা এরচয়েও কম সময়ে পাসপোর্ট করে দেয়ার নিশ্চয়তা দেন। এ সময় এনআইডি কার্ডে ঝামেলা আছে জানালে তারা মাত্র ২ দিনে সেটিও সমাধান করে নতুন এনআইডি করে দেয়ার প্রতিশ্রতি দেন। এনআইডি সংশোধন ও নতুন পাসপোর্ট করে দিবে বলে ফরমপূরণের একটি কম্পিউটারের দোকানে উপস্থিত হলে দোকানি পাশে বসে থাকা এক নারীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। সুমাইয়া এসব কাজের জন্য মোট ২৫ হাজার টাকা দাবি করেন। এরপর রাস্তার বিপরীত পাশের দোকানগুলোতে গিয়ে পরিচয় হয় জনৈকা তানজিনার সাথে। তিনি এনআইডি সংশোধনসহ নতুন পাসপোর্টের জন্য ২২ হাজার টাকার চাহিদা করেন। পাসপোর্ট প্রত্যাশীর নামে মামলা না থাকলে, পুলিশ ভেরিফিকেশনের দায়িত্বও তার। নিজের উপস্থিতি ছাড়াই এনআইডি সংশোধন ও পাসপোর্ট মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে হাতে তুলে দিবেন বলে জানান। ওই সময় পুরো নাম ঠিকানা পরিবর্তন করে নিতে আসা এক ভদ্রলোকের কাছে তিনি ৮৫ হাজার টাকা দাবি করেন। শেষ পর্যন্ত এ প্রতিবেদককে গুরুত্ব কম দিয়ে ওই লোকের সাথে একান্তে কথা বলতে থাকেন।

জানা যায়, মাঝেমধ্যে র‌্যাব পুলিশের অভিযানে দালালচক্র ধড়া পড়ে। তখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়। কিন্তু দালালরা বেশিদিন হাজতে থাকেন না। জামিন পেয়ে আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে।
আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের বাইরে প্রতারক ও দালালচক্রের খপ্পড় এড়াতে পাসপোর্ট বিষয়ে তথ্য জানতে গেলেও মেলে না সুরাহা। হাজার হাজার মানুষের কত জনকেই বা সমাধান দিবেন। তাই পরোক্ষভাবে নির্ধারিত দালালদের দিয়ে পাসপোর্ট করার ইঙ্গিত কিংবা কোনো তথ্যই না দিয়ে কৌশলে এড়িয়ে যান বলে অনেকের অভিযোগ। গ্রাহক নিজ উদ্যোগে লাইনে দাঁড়িয়ে আবেদনপত্র জমা দিলে তথ্য ভুল দেখিয়ে দিনের পর দিন ফেরত দেয়া হয়। আবার যারা দেরি করে হলেও পাসপোর্ট হাতে পাচ্ছেন তাদের পাসপোর্টের তথ্যে রয়েছে নানা অসঙ্গতি। একাধিক দালাদের সাথে কথা হলে তারা জানান, সরকারি ফি থেকে যা বেশি নেয়া হয় তার মোটা অংশই চলে যায় অসাধু কর্মচারী ও আনসার সদস্যের কাছে।

অথচ ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের সেবা প্রদান প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী, মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট ইস্যু করতে ১৫ কর্মদিবস এবং জরুরি ফি এবং পুলিশ প্রতিবেদন প্রাপ্তি সাপেক্ষে সাত কর্মদিবসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। অপরদিকে ই-পাসপোর্ট প্রক্রিয়ায় বিতরণের ধরন অনুযায়ী সাধারণ ১৫ কর্মদিবসের মাঝে, জরুরি সাত কর্মদিবসের মাঝে এবং অতীব জরুরি দুই কর্মদিবসের মাঝে শেষ হওয়ার কথা। এছাড়াও ভিসা ইস্যুর ক্ষেত্রে শ্রেণিভেদে এবং অনুক‚ল তদন্ত প্রতিবেদন সাপেক্ষে তিন কর্মদিবস থেকে ৩০ কর্মদিবসের মাঝে সেবা নিশ্চিত করার কথা। এ ক্ষেত্রে আইন থাকলেও তার প্রয়োগ দেখা যায় না।

একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের ৬৯টি আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে প্রতি মাসে গড়ে ২ লাখ ২৬ হাজারের বেশি পাসপোর্টের আবেদন জমা হয়। এর মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ জমা হয় দালালের মাধ্যমে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
Amirul Muminin alomgir ১৯ আগস্ট, ২০২২, ৩:৪৯ এএম says : 0
সিলেট পাসপোর্ট অফিসে দালাল ছাড়া একটি পাসপোর্ট করা সম্ভব নয়। দলালের মাধ্যমে প্রতি পাসপোর্টে আর্জেন্ট ১২৫০০/-ও সাধারণ ১০৫০০/-টাকা। কেউ অভিযোগ করলে তার পাসপোর্ট আর হবেনা, বেশি কথা বল্লে মারপিট ও হতে পারে।
Total Reply(1)
Harunur Rashid ১৯ আগস্ট, ২০২২, ১১:১০ এএম says : 0
Great going. Is there any thing left that can be done the legal way or everything is just thing of the past.
মোহাম্মদ শাহআলম ১৯ আগস্ট, ২০২২, ৮:২৬ এএম says : 0
পাসপোর্ট অফিস যদি দুর্নিতি মুক্ত করিতে চান অফিসের বাহিরের কম্পিউটারএর দোকানের ব‍্যাবসা বন্দ করুন এবং সহায়তার জন‍্য অফিসের ভিতরে সরকারি 5/10 টি কমপিউটার copyier এবং scaner মেশিন রাখুন দুজন আর্মি সদস‍্য পাসে বসে অফিস আওয়ার শেষ পযর্ন্ত রোজ মনিটর করিবে।দেখবেন ঘুস ও দুর্নিতি নেই ইনশাআল্লাহ।
Total Reply(1)
Harunur Rashid ১৯ আগস্ট, ২০২২, ১১:১২ এএম says : 0
At this time even army can't be trusted.
Amirul Muminin alomgir ১৯ আগস্ট, ২০২২, ১:০০ এএম says : 0
সিলেট পাসপোর্ট অফিসে দালাল ছাড়া একটি পাসপোর্ট করা সম্ভব নয়। দলালের মাধ্যমে প্রতি পাসপোর্টে আর্জেন্ট ১২৫০০/-ও সাধারণ ১০৫০০/-টাকা। কেউ অভিযোগ করলে তার পাসপোর্ট আর হবেনা, বেশি কথা বল্লে মারপিট ও হতে পারে।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন