ভুল গ্রæপের রক্ত পুশ করায় গাজীপুরের কালীগঞ্জের একটি ক্লিনিকে শিরিন বেগম নামের এক প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে। গত রোববার রাতে ওই এলাকার জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে এ ঘটনা ঘটে। রক্তশূন্য হয়ে পড়া প্রসূতির ‘এ’ পজিটিভ রক্তের প্রয়োজন থাকলেও তাকে পুশ করা হয় ‘বি’ পজিটিভ রক্ত।
ভুল গ্রæপের রক্ত পুশ করায় রোগীর অবস্থা দ্রæত অবনতি হলেও কোনো কার্যকরি পদক্ষেপ না নিয়ে মৃতপ্রায় অবস্থায় প্রসূতিকে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করতে বাধ্য করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনার পর থেকে হাসপাতালের মালিক ও চিকিৎসক পলাতক রয়েছে। বন্ধ রয়েছে তাদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন। নিহত প্রসূতি শিরিন বেগম কালীগঞ্জের তুমলিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ চুয়ারিয়াখোলা গ্রামেরক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাকের স্ত্রী।
এ ঘটনার জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে গিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কাউকে পাওয়া যায়নি। তবে ওই হাসপাতালের ব্যবস্থাপক জহির উদ্দিন মোবাইল ফোনে জানান, রোগীর খারাপ অবস্থা থাকায় তাকে গত রোববার রাতেই ঢাকা পাঠানো হয়েছে। ওই রোগী মারা গেছে কি না তা জানা নেই বলে তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
নিহতের স্বামীর বড় বোন হোসনে আরা বলেন, গত রোববার সকালে আমার ছোট ভাইয়ের বউ হঠাৎ ব্যথা অনুভব করেন। এ সময় একই এলাকার বাসিন্দা ওই জনসেবা হাসপাতালের পরিচালক বন্যা বেগমের কাছে যাওয়া হয় পরামর্শের জন্য। পরে তিনি ওই হাসপাতালের দুইজন নার্স সঙ্গীনি ও পান্নাকে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পাঠান। হাসপাতালে নিয়ে গেলে হাসপাতালের চিকিৎসক ডাক্তার মাসুদ রোগীকে সিজার করেন।
এতে প্রসূতি একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় নিয়ে অপারেশন করার পর ডাক্তার জানায় রোগীর জরায়ু ফেটে গেছে। প্রচুর বিøডিং হচ্ছে, বি পজেটিভ রক্ত দরকার প্রয়োজন। তাদের কথামতো বি পজেটিভ রক্ত যোগাড় করে দেয়া হলে রোগীকে পুশ করা হয়। কিন্তু তাতেও রোগী স্বাভাবিক হচ্ছিল না, শরীর থেকে সব রক্ত বেরিয়ে আসছিল।
পরে যখন পুনরায় রোগীর রক্তের গ্রæপ পরীক্ষা করা হয়, তখন জানা যায় রোগীর রক্তের গ্রæপ এ পজেটিভ। এরপর আবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ পজেটিভ রক্ত যোগাড় করতে বলে প্রসূতির স্বজনদের। এখন আবার এ পজেটিভ রক্ত কেন? স্বজনরা এমন প্রশ্ন করলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনো সমস্যা নেই বলে জানায়।
পরে তড়িগড়ি করে এ পজেটিভ রক্ত সংগ্রহ করে দেয়া হয়। কিন্তু এ পজেটিভ রক্ত পুশ করার কিছুক্ষণ পরেই রোগীর অবস্থায় খারাপ হতে থাকে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সন্ধ্যা পর্যন্ত দেখে রাত ৮টার দিকে রোগীর অবস্থা খারাপ বলে তাকে ঢাকায় পাঠানোর পরামর্শ দেয়। পরে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় নেওয়ার পথে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দুই ব্যাগ এ পজেটিভ রক্তের ব্যাগ রোগীর সঙ্গে দিয়ে দেয়। ঢাকা নেওয়ার পথে রোগীর নিস্তব্ধ হয়ে গেলে উত্তরার একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনসেবা হাসপাতালের এক কর্মচারী জানান, এর আগেও এই হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় একাধিক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। এখানে সার্বক্ষণিক কোনো চিকিৎসক থাকেন না। প্রয়োজন হলে ফোনে ডেকে এনে সিজার করানো হয়। তিনি আরো বলেন, জনসেবা হাসপাতালের পরিচালক বন্যা বেগম একসময় এই হাসতাপালের র্মল মালিক ডা. আসাদুজ্জামান আসাদের রোগী দেখার সিরিয়াল দিতেন। এখন তিনি জনসেবা হাসপাতালের পরিচালক। কাজেই এখানে কী ধরনের চিকিৎসাসেবা পাবে মানুষ, সেটা খুব সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু তারপরও এখানে রোগী আসেন এবং এ রকম ভুল চিকিৎসার শিকার হন।
কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. এসএম মনজুর-এ-এলাহী জানান, জনসেবা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের কাগজপত্র নবায়ন নেই। তাদের পুরনো সব কাগজপত্র মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। তারপরও তারা কীভাবে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে। এ ব্যাপারে তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পরামর্শ করে অতি দ্রæত মেয়াদোত্তীর্ণ হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধের ব্যবস্থা করব।
কালীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আনিসুর রহমান বলেন, এ ব্যপারে কোনো অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসসাদিকজামান বলেন, ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনাটি দুঃখজনক। তবে এ ব্যাপারে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে প্রয়োজনীয় আইনগত যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন